সারিউল ইসলাম, মুর্শিদাবাদ, আপনজন: ওয়াকফ ইস্যুতে তিনজনের মৃত্যু হল মুর্শিদাবাদে। সংশোধিত ওয়াকফ আইন বাতিলের দাবিতে উত্তাল মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকা। গত কয়েকদিন ধরেই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ, হিংসা, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চলেছে। শুক্রবার অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সুতি, উমরপুর ও ধুলিয়ান। শুরু হয় পথ অবরোধ, পুলিশের উপর বোমা ও ইট-পাটকেল ছোড়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ। পুলিশ পাল্টা লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সরকারি ও বেসরকারি বাস, অ্যাম্বুল্যান্স, মোটরবাইক, এমনকি ট্র্যাফিক গার্ড অফিসেও আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। রেলগেটের রিলে রুমে ভাঙচুর চালানো হয়। রেললাইনে অবরোধের জেরে আজিমগঞ্জ-ফারাক্কা শাখায় বন্ধ হয়ে পড়ে ট্রেন চলাচল। শুক্রবার রাতের সব ট্রেন পাকুড়-নলহাটি হয়ে আজিমগঞ্জ রুটে পাঠানো হয়। যদিও শনিবার সকাল থেকে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক। অন্যদিকে ধুলিয়ানে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভাঙচুর চালিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একাধিক দোকানে লুঠপাট চালায় দুষ্কৃতিরা। এমনকি সাংসদ খলিলুর রহমানের ধুলিয়ানের বাড়ি ভাঙচুর, সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ। ফারাক্কার বিধায়ক মনিরুল ইসলামের বাড়ি এবং তাঁর দাদা কাওসার আলির বাড়িতেও চালানো হয় হামলা। শনিবার সকালে বিএসএফের গুলিতে গোলাম মহিউদ্দিন শেখ, ২১ বছর, হাসান সেখ ১২ বছর বয়স ও নাবালক ধুলিয়ানে গুলিবিদ্ধ হয়।
এদিন সকালে সামসেরগঞ্জ থানার জাফরাবাদ এলাকায় একটি বাড়ি থেকে বাবা-ছেলের রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তারা হলেন, হরগোবিন্দ দাস (৭২) ও চন্দন দাস (৪০)। অভিযোগ, ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। অন্যদিকে ১৬ বছরের নাবালক মোসারফ হোসেন পুলিশের গুলিতে জখম হয়েছিল শুক্রবার, শনিবার দুপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার। মৃতের মায়ের দাবি, “ছেলে মামার বাড়ি থেকে বাড়ি ফিরছিল, পথিমধ্যে পুলিশ গুলি চালালে তাঁর বুকে গুলি লাগে।”
শুক্রবার সন্ধ্যায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নামানো হয় বিএসএফ। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে ওঠে যে, শনিবার সকালে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নতুন করে আবার উত্তেজনা ছড়ায় ধুলিয়ান শহর এলাকায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে আহত হন মালদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহম্মদ জামাল। এই প্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের উপর চরম ভর্ৎসনা করে কলকাতা হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চ মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেয়। বিচারপতি সৌমেন সেন ও বিচারপতি রাজা বসু চৌধুরীর বেঞ্চ জানায়, আগামী ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী কাজ করবে। ইতিমধ্যে ধুলিয়ান, সুতি ও সামশেরগঞ্জে মোতায়েন হয়েছে সাত কোম্পানি বিএসএফ। জেলার অন্যান্য স্পর্শকাতর এলাকাগুলিতেও বাহিনী পাঠানো হচ্ছে বলে সূত্রের খবর। রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার জানিয়েছেন, পুলিশ মানুষের জীবন রক্ষায় বদ্ধপরিকর। প্রয়োজন হলে পুলিশ প্রাণ দেবে, কিন্তু দুষ্কৃতীদের বরদাস্ত করবে না। তিনি আরও জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ চার রাউন্ড গুলি চালাতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার বার্তাও দেন তিনি।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব শনিবার ভিডিও কনফারেন্সে রাজ্যের মুখ্যসচিব ও ডিজিপির সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি জানান, ইতিমধ্যে শুধু ধুলিয়ানে ৩০০ বিএসএফ মোতায়েন করা হয়েছে এবং প্রয়োজনে আরও বাহিনী পাঠানো হবে। শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাতভর ধরপাকড় চলবে বলে পুলিশ সূত্রে খবর। এদিকে শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশক রাজিব কুমার সুতি থানায় পৌঁছান। তিনি সরেজমিনে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন। অন্যদিকে শনিবার রাতে সাংসদ খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, পরিস্থিতি ৯০ শতাংশ আয়ত্তে এসেছে, বাকি স্পর্শকাতর এলাকার তালিকা প্রশাসনের হাতে দেওয়া হল। তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় তিনি বলেন, এই ধরনের মৃত্যু কখনোই কাম্য নয়, আমরা সবাইকে শান্ত থাকার বার্তা দিচ্ছি।প্রশাসনিক সূত্রে খবর, ইন্টারনেট পরিষেবা আপাতত বন্ধ থাকছে, জারি থাকছে ১৬৩(১৪৪) ধারা। এই ঘটনায় তিনজনের মৃত্যুর পর থমথমে ধুলিয়ান-সুতি সহ জঙ্গিপুর মহকুমার বিভিন্ন এলাকা।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct