যখন সম্পাদক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বিভেদ কি আরও গভীর হচ্ছে?’, তখন আমি তাৎক্ষণিকভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, গণসহিংসতা ও গো-রক্ষা, যা আমাদের সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করেছে, এমনকি হিজাব, হালাল মাংস এবং লাউডস্পিকারে আজান নিয়ে তৈরি বিতর্কগুলি, যা সম্প্রতি আমাদের দেশের মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক করার জন্য কাজ করেছে, সেই হতাশাজনক পরিচিত শোকাবহ ঘটনাগুলির কথা ভাবিনি, যা নিশ্চিতভাবে তার প্রশ্নটিকে উত্থাপন করেছে।’ এমনটাই বলেছেন লোকসভার কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর। লিখেছেন শশী থারুর।
যখন সম্পাদক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বিভেদ কি আরও গভীর হচ্ছে?’, তখন আমি তাৎক্ষণিকভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, গণসহিংসতা ও গো-রক্ষা, যা আমাদের সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করেছে, এমনকি হিজাব, হালাল মাংস এবং লাউডস্পিকারে আজান নিয়ে তৈরি বিতর্কগুলি, যা সম্প্রতি আমাদের দেশের মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক করার জন্য কাজ করেছে, সেই হতাশাজনক পরিচিত শোকাবহ ঘটনাগুলির কথা ভাবিনি, যা নিশ্চিতভাবে তার প্রশ্নটিকে উত্থাপন করেছে।’ এমনটাই বলেছেন লোকসভার কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর।
ভারতের পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক এবং অল ইন্ডিয়া প্রফেশনাল্স কংগ্রেস-এর চেয়ারম্যান থারুর ইন্ডিয়া টুডে-এর একটি কলামে আরও বলেছেন, ‘এর পরিবর্তে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে আমার নজরে আসা তিনটি আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ ঘটনার কথা আমাকে ভাবিত করেছে, যা সরাসরি বিভাজনকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। অন্তত, আমার দৃষ্টিতে।
ভারতের জাতিগত বিভেদ সম্পর্কে শশী থারুরের পর্যবেক্ষণটি নিচে তুলে ধরা হল:
প্রথম ঘটনা: সম্প্রতি জয়পুরে, একজন স্বর্ণকেশী লেবানিজ মহিলার সাথে আমার সাক্ষাত ঘটে, যিনি ১৫ বছর ধরে হস্তশিল্প এবং গহনা ব্যবসা করতে ভারতে আসছিলেন। দৃশ্যত বিদেশী বলে মনে হলেও, অতীতে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হত। যখন সে নিজেকে নুর নামে পরিচয় দিত, তখন লোকেরা বলত, ‘ওহ্, কী সুন্দর নাম! ভারতে আমাদের একই নাম! আমরা জানি এর অর্থ আলো!’
ইদানিং, নূর বলেছেন সবকিছু বদলে গেছে। যখন তিনি বলেন তার নাম নুর, তখন তার প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে হয়, ‘ওহ, তুমি মুসলিম?’ প্রশ্ন এবং প্রশ্নের সুরই সবটা বলে দেয়। এখন তিনি নিশ্চিত নন যে, তিনি আর আগের মতো আসা-যাওয়া করবেন।
দ্বিতীয় ঘটনা: একজন প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত, যিনি পাকিস্তান এবং ইসলামী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তার কর্মজীবনে বাজপাখি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তিনি আমাকে তার বন্ধু কাবুলের একজন বিখ্যাত শল্যচিকিৎসকের কথা বলেছেন। তার দেশে তালেবানদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব দেখে শল্যচিকিৎসক রাষ্ট্রদূতের উৎসাহে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের পুনরুত্থিত ইসলামী মৌলবাদ থেকে মুক্ত থাকার এবং পড়াশোনা করার জন্য ভারতে (পাকিস্তানে নয়!) পাঠিয়ে দেন।’
তারা গুরগাঁওয়ে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন, একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করান। কিন্তু এক বছরের মধ্যে তারা বুঝতে পারেন যে এটি আর সেই ভারত নয়, যা শল্যচিকিৎসক তার সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় মানসপটে রেখেছিলেন। সবচেয়ে বেদনাদায়ক আঘাতটি আসে, যখন তাদের শিশুদের বহতল ভবনের খেলার সাথীরা তাদের ঘোষণা করে, ‘আমাদের বাবা-মা আমাদের বলেছেন তোমরা মুসলিম বলে তোমাদের সাথে না খেলতে।’
আমার রাষ্ট্রদূত বন্ধু, মানসিক ধাক্কা এবং হতাশায় জানান যে তিনি শল্যচিকিৎসককে পরামর্শ দিয়েছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের দুবাই বা লন্ডনে নিয়ে যাও। আমি লজ্জিত যে আমি তোমাকে আমার দেশে তাদের লালন-পালন করতে উৎসাহিত করেছি।’
তৃতীয় ঘটনা: জাতিসংঘে একজন অভিজ্ঞ ভারতীয় শান্তি আলোচক, যিনি মধ্যপ্রাচ্যের অনেক সঙ্কটপূর্ণ স্থানে কাজ করেছেন, তিনি একটি আরব দেশে দাড়ি, পাগড়ি এবং কালাশনিকভ সজ্জিত একজন ইসলামী উগ্রপন্থীর সাথে উত্তেজনাপূর্ণ বৈঠকে বসেছিলেন। তারা একটি কন্টকময় বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিল। যদিও রমজান মাস ছিল, বরফ ভেঙে গেল, যখন উগ্রপন্থীটি জাতিসংঘের কর্মীকে সিগারেট সাধল, জ্বালিয়ে দিল উঠল, বিস্তর রসিকতা করল এবং হাসিতামাশা করল।
কিস্তু, যখন উগ্রপন্থীটি প্রায় স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আর আপনি কোথা থেকে এসেছেন?’ জাতিসংঘের কর্মকর্তা যখন বললেন ‘ভারত’, তখন আবহ তাৎক্ষণিকভাবে বদলে গেল। তিনি বললেন, ‘ভারত? আমি শুনেছি আপনারা সেখানে মুসলমানদের সাথে কেমন আচরণ করছেন। বেরিয়ে যান জাতিসংঘের কর্মী, নইলে আপনার সাথে যা ঘটবে তার জন্য আমি দায়ী থাকব না।’
জাতিসংঘের কর্মকর্তা পুনরায় বলার চেষ্টা করলেন যে উগ্রপন্থীকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে, তার সাথে থাকা ইউরোপীয় জাতিসংঘের কর্মকর্তাও বললেন, কিন্তু উগ্রপন্থী শান্ত হলেন না। তিনি বললেন, তার সূত্র একাধিক ছিল, সে উগ্রপন্থী হতে পারে, কিন্তু সে বিশ্বের গণমাধ্যমে পড়েছে এবং দেখেছে। সভার দফারফা হয়ে গেল। ভারতীয় তার চামড়া বাঁচিয়ে নিয়ে প্রস্থান করলেন।
এই তিনটিই সম্পর্কহীন এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা, আমার নজরে এসেছে দুই বা তিন সপ্তাহের ব্যবধানে, যা আমাদের সমাজে জাতিগত বিভাজন কতটা গভীর হয়েছে তা প্রকাশ করে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের রাজনীতিতে যে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, তার অনিবার্য প্রভাব পড়েছে, যা বিষ ছড়িয়ে দেয়া অপশক্তির নির্বাচনী লাভের চেয়েও অনেক বেশি। এটি আমাদের সমাজকে বিষাক্ত করে তুলেছে, ভারতকে এমন কিছুতে পরিণত করেছে, যেটি কখনও ছিল না।
যা বদলেছে, তার চুলচেরা বিবরণ দেয়া যেতে পারে। এখন গণমাধ্যমগুলি থেকে এমন কিছু বলা হচ্ছে, এবং সামাজিক মাধ্যমগুলির দ্বারা সেগুলি রেকর্ড করা হচ্ছে এবং ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে, যা অতীতে আপনার বসার ঘরে বন্ধ দরজার আড়ালেও বলা অনুচিত বলে বিবেচিত হত। ধর্মান্ধতা প্রকাশ্যে প্রকাশ করা হচ্ছে এবং ঘৃণামূলক বক্তব্য এতটাই সাধারণ হয়ে উঠেছে যে, এখন আর তা নিয়ে কোনও সমালোচনা করা হয় না।
একটা সময় ছিল, যখন ভারতের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ স্থাপন করতে এবং এর পক্ষে জনসাধারণের সম্মতি প্রকাশ করতে তাদের চেষ্টার বাইরে চলে যেত। আজ, কর্তৃপক্ষ এই ধরনের বক্তব্যের নিন্দা করার জন্য খুব কমই আওয়াজ তোলে এবং যদি সহিংসতা ঘটে, তাহলে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয় না।
আমার শৈশবে, অমর আকবর অ্যান্থনির মতো চলচ্চিত্রের উপর বিনোদন কর মওকুফ করা হত, যেটিতে, শৈশবে বিচ্ছিন্ন তিনজন ছোট বাচ্চার গল্প ছিল যারা হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রিস্টান হিসেবে বড় হয় এবং শেষে খারাপ লোকদের পরাজিত করার জন্য একত্রিত হয়। এখন, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর মতো চলচ্চিত্রের উপর এটি মওকুফ করা হয়, যার প্রদর্শনের ফলে পৃষ্ঠপোষকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ঝুঁকে পড়ে।
বিশ্ব একসময় যে ভারতবর্ষকে জানত, সেখানকার ভারতীয়দের প্রতি মুসলিম বিশ্ব জুড়ে সম্মান ও মর্যাদার সাথে আচরণ করা হত, বিশেষ করে এই কারণে যে, তাদেরকে এমন একটি দেশ হিসেবে দেখা হত, যেখানে মুসলমানরা গর্বের সাথে তাদের নিজের বলে মনে করত। আজ, ভারতীয়রা মুসলমানদের উপর নির্যাতন এবং ব্যাপক ইসলাম বিদ্বেষের সাথে যুক্ত।
একটা সময় ছিল, যখন আমরা বিদেশীদের কাছে গর্ব করতাম যে ভারতে ১৮ কোটি মুসলমান থাকা সত্ত্বেও, ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন তালেবান, আল-কায়েদা বা দায়েশের সাথে যোগ দিয়েছিল, কারণ ভারতীয় মুসলমানদের ভারতের সাথে তীব্র নাড়ির টান ছিল এবং এর সাফল্যে তাদের অংশীদারিত্ব ছিল।
আজ, আলোচনা বাড়ছে ক্রমশ ভীত এবং বিচ্ছিন্ন সংখ্যালঘুদের নিয়ে, যেখানেই বিকল্প থাকুক না কেন, মুসলমানরা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার রাস্তা বেছে নিচ্ছে এবং অন্যরা ইসলামিক প্রচারের দ্বারা নয়, বরং ভারতে তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উগ্রপন্থী হয়ে উঠছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এখন ধারণা করছেন যে চরমপন্থার প্রতি গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে।
সাম্প্রদায়িক বিভাজন কেবল গভীরই হচ্ছে না, এটি আমাদের সমাজকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা আমাদের সকলের জন্য অপ্রত্যাশিত পরিণতি এবং অকথ্য বিপদ ডেকে আনছে। জাতীয় সংহতির যুগের যবনিকা ঘটেছে। আমরা কেবল আশা করতে পারি যে, আমাদের শাসকরা জাতীয় ভাঙনের যুগ রোধ করার জন্য যথেষ্ট প্রজ্ঞা খুঁজে পাবেন।
সৌ: ইন্ডিয়া টুডে
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct