মহবুবুর রহমান: “ওয়াকফ আইন সংশোধনী বিল-২০২৪ “, মুসলিম ধর্মীয় স্বাধীনতায় এক গভীর আঘাত এবং এটি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি একটি গুরুতর অবমাননা। এই বিলের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, যেখানে বিরোধী রাজনৈতিক দল, মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এবং অন্যান্য মুসলিম সংগঠন একত্রিত হয়ে এই বিলের বিরোধিতা করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, সংসদের যৌথ কমিটির বৈঠকে বিরোধী পক্ষের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো একতরফা বাতিল করা হয়েছে, আর সরকার পক্ষের সংশোধনীগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি চরম অবমাননা।
কোমিটির বৈঠকে বিরোধীদের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে একপেশে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা কেবল একটি প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। যদিও কমিটির চেয়ারম্যান, বিজেপি সাংসদ জগদম্বিকা পাল দাবি করেছেন যে, সকল সদস্যের মতামত গণতান্ত্রিকভাবে বিবেচনা করা হয়েছে, বাস্তবতা হলো বিরোধী পক্ষের মতামতকে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একপেশে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা জনগণের প্রতি অসম্মান।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এবং অন্যান্য মুসলিম সংগঠন বারবার স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, তারা কখনোই ওয়াকফ সম্পত্তিতে সরকারের হস্তক্ষেপ মেনে নেবে না। ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলিমদের ব্যক্তিগত দান, যা তাদের ধর্মীয় অধিকার। সরকারের কোনো অনধিকার প্রবেশ সম্পূর্ণ বেআইনি এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতায় সরাসরি আঘাত। এই কারণে ভারতীয় মুসলমানরা এই ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪ সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এই বিলের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মুসলিম নাগরিক নিজেদের মতামত জানিয়ে ইমেল পাঠিয়েছেন। মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের উদ্যোগে একেবারে ৩৬ মিলিয়ন মানুষের ইমেল পাঠানো হয়েছে, আর অন্যান্য মুসলিম সংগঠনগুলোও লক্ষ লক্ষ ইমেল পাঠিয়েছে। কিন্তু, এসবের কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। সংসদীয় কমিটি একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মুসলিম সংগঠনগুলোর বক্তব্যকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বেঙ্গালুরুর বোর্ড সভায় সব মুসলিম সংগঠন একত্রিত হয়ে ঘোষণা করেছে যে, তারা তাদের উপাসনালয় এবং ওয়াকফ সম্পত্তিতে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ মেনে নেবে না।
এই পরিস্থিতিতে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোকে একত্রিত হয়ে এই বিলের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজন। সরকারের উচিত এই সংশোধনী বিলটি পুনর্বিবেচনা করা এবং পূর্বের আইনটি বহাল রাখা। ওয়াকফ আইন সংশোধনী বিল মুসলিম ধর্মীয় স্বাধীনতায় গভীর প্রভাব ফেলবে। এতে কিছু ধারা ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেবে এবং জেলা শাসকদের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করবে, যার ফলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে এবং সরকারের আরো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে, যা সরাসরি অসাংবিধানিক এবং মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।
এছাড়া, সরকারের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এমন একটি ধারা রয়েছে, যা বলছে, ইসলাম ধর্মে অন্তত পাঁচ বছর সময় ধরে থাকা ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ ওয়াকফ সম্পত্তি দান করতে পারবেন না। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত ধর্মীয় অধিকারকে অনধিকারভাবে চ্যালেঞ্জ করে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতায় এক গুরুতর হস্তক্ষেপ।
এরই মধ্যে, ২ এপ্রিল ২০২৫ সালে লোকসভায় এই বিলটি পাশ করা হয়েছে এবং ৩ এপ্রিল ২০২৫ সালে রাজ্যসভাতেও পাশ হয়েছে। দেশের সমূহ মুসলিম সমাজ এই বিলের বিরুদ্ধে। এই প্রক্রিয়া দেশের মুসলিমদের তীব্র বিরোধিতার পরও চলছে, যা গভীর উদ্বেগজনক। প্রশ্ন ওঠছে, কেন মুসলিমদের প্রতি সরকারের এই অনৈতিক হস্তক্ষেপ? সরকারের দাবি করা ‘দরিদ্র মুসলিম’ হিতের নামে এই বিল তৈরি হলেও, বাস্তবতা হলো মুসলিমদের বিরুদ্ধে! সরকার একের পর এক ষড়যন্ত্র করছে, মুসলিমদের মারধর করা হচ্ছে, মব লিঞ্চিং করা হচ্ছে।
মুলত, মুসলিমদের জন্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সরকারের নয়, কারণ যাদের সম্পত্তি তাদেরই কর্তৃত্ব থাকবে। মুসলিমরা নিজেরাই তাদের সম্পত্তি দেখাশোনা করে আসছে দীর্ঘকাল। অথচ, সরকার তাদের সম্পত্তিতে অনধিকার প্রবেশ করতে মরিয়া। এর মাধ্যমে, সরকারের উদ্দেশ্য স্পষ্ট যে, তারা মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকারকে বঞ্চিত করতে চাইছে।
এই বিলটির মধ্যে যেগুলি সবচেয়ে বিতর্কিত তা হলো, এতে বলা হয়েছে ওয়াকফ বোর্ডে কমপক্ষে দু’জন মহিলা এবং দু’জন অ-মুসলিম সদস্য থাকতে হবে। তবে, প্রশ্ন উঠছে, কেন অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এমন বিধান নেই? কেন শুধুমাত্র মুসলিমদের ওয়াকফ বোর্ডে অ-মুসলিম সদস্য থাকতে হবে? এটি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ করে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অসাম্য সৃষ্টি করবে। এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের পরিপন্থী।
এছাড়া, সরকারের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে এমন একটি ধারা রয়েছে, যা বলছে, ইসলাম ধর্মে অন্তত পাঁচ বছর সময় ধরে থাকা ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ ওয়াকফ সম্পত্তি দান করতে পারবেন না। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত ধর্মীয় অধিকারে অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতায় একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ।এটা অসাংবিধানিক।
সম্প্রতি ২ এপ্রিল,২০২৫ লোকসভায় এই অযৌক্তিক অহেতুক বিল টি সরকার উত্থাপন করে পাশ করিয়ে নেয়।এবং ৩ এপ্রিল ২০২৫ এই অনৈতিক বিলকে রাজ্যসভায়ও ক্ষমতাবলে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়! অথচ দেশের সমূহ মুসলিম এই বিলের বিরুদ্ধে! ভাবতে অবাক লাগে, দরিদ্র মুসলিম হিতে (সরকারের ভাষ্য) হঠাৎ এতো দরদ!? অথচ মুসলিমদের কে এই সরকারের দোসররাই অহরহ চোর,বিদেশি, বাংলাদেশি,জেহাদি, ইত্যাদি অনৈতিক টেগ লাগায়! মুসলিমদের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করে,মারধর করে, মব লিঞ্চিং করে! তার মানে স্পষ্ট! বিদ্বজ্জন মাত্রেই জ্ঞাত।
আশ্চর্যের বিষয় হলো,যাদের হিতে বিলটি তারাই না করছে! আসলে তারা চায় না সরকার এতে নাক গলাক! যাদের সম্পত্তি, তারা নিজেরাই চিরাচরিতভাবে এর দেখভাল করে আসছে। এ সম্পদ সম্পূর্ণ ধর্মীয়, যা মুসলিম সম্প্রদায় বিভিন্ন সময় পূণ্যার্থে পরম স্রষ্টার নামে দান করেছেন। এতে নাকি গলানোর কারো বিন্দু পরিমাণ এক্তিয়ার নেই। অথচ সরকার জোরপূর্বক অনধিকার প্রবেশ করতে মরিয়া প্রয়াস চালাচ্ছে! সরকারের উচিত এ বিল কে যথাত্বরিত প্রত্যাহার করা।
পরিতাপের বিষয় হলো দেশের সমূহ মুসলিমের বিরোধ সত্ত্বেও সরকার এই সংশোধনীতে একতরফা মনোভাব নিয়ে কাজ করছে, যা শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ নয়, বরং দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি অবজ্ঞা। সরকারের এই পদক্ষেপ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এটি দেশের ধর্মীয় ও সাংবিধানিক ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলবে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের সমাজে গভীর ক্ষত তৈরি করবে। আমরা সমূহ ভারতীয় মুসলিম ভারতের শ্রদ্ধেয়া রাষ্ট্রপতি মাননীয় দ্রৌপদি মুর্মু মহোদয়াকে এই বিল স্বাক্ষর না করতে ও নাকচ করতে আকুল আবেদন জানাচ্ছি। আশা করি মাননীয়া শ্রদ্ধেয়া রাষ্ট্রপতি দেশের সংবিধানের মূল্যবোধ রক্ষায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর এই আবেদন মঞ্জুর করে তথা ওয়াকফ সংশোধনী বিল-২০১৪ নাকচ করে পূর্ববৎ ওয়াকফ বোর্ড বহাল রেখে বাধিত করবেন।পরম শ্রষ্টা সমীপে আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনায়।
*** মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct