পাশারুল আলম: “নব আনন্দ জাগে হৃদয়ে আজি,/ ঈদের বাঁশি বাজে সুমধুর বাজি।”
ঈদুল ফিতর—একটি নাম, যার সঙ্গে মিশে আছে অফুরন্ত আনন্দ, পবিত্রতা ও মানবতার উদ্ভাস। মুসলিম জাতির আত্মসংযম, সাধনা ও ত্যাগের এক মাস সিয়ামের পর আসে এই পবিত্র দিনটি। শাওয়াল মাসের প্রথম সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে উদিত হয় কল্যাণ, ক্ষমা, ভ্রাতৃত্ব এবং মহামিলনের এক অনন্য আলোকচ্ছটা। ঈদ শুধু উৎসব নয়, এটি আত্মশুদ্ধি, সামাজিক সম্প্রীতি আর মানবিক মর্যাদার এক চিরন্তন বার্তা।
ঈদুল ফিতরের ঐতিহাসিক পটভূমি:
ঈদুল ফিতরের সূচনা ইসলামের দ্বিতীয় হিজরিতেই। নবী করিম হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরতের পর মুসলিম সমাজের মধ্যে এই উৎসবের প্রচলন করেন। পূর্বে মদিনাবাসী দুটি খেলা-উৎসবে মেতে উঠত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন—
“আল্লাহ তোমাদের সেই দুটি দিনের পরিবর্তে আরও উত্তম দুটি দিন দান করেছেন—একটি ঈদুল ফিতর, অন্যটি ঈদুল আজহা।”
(সূত্র: সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং ১১৩৪)
ঈদুল ফিতর তাই শুধু রোজা সমাপ্তির দিন নয়; এটি কৃতজ্ঞতার, ক্ষমা লাভের ও মানবিক পুনর্জাগরণের অনন্য উপলক্ষ।
ঈদুল ফিতরের প্রস্তুতি ও রীতি
রমজানের শেষ দশকে ঈদের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়। ‘চাঁদ রাত’ যেন এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। আলোকসজ্জায় উদ্ভাসিত নগরপথ, সুগন্ধি আতরের ঘ্রাণ, শিশুদের হাসি, আর দোয়া-ইস্তেগফারের ধ্বনিতে মুখরিত হয় প্রতিটি গৃহ।
“আলোয় আলোয় ভরে যায় পথ,
ঈদের রাতে হাসে নব চাঁদ।”
— (কাজী নজরুল ইসলাম)
ঈদের দিন সকালে পবিত্র গোসল, আতর মেখে, উত্তম পোশাক পরিধান করে মানুষ যখন নামাজগাহের দিকে অগ্রসর হয়, তখন সেই দৃশ্য যেন ভ্রাতৃত্বের এক অপূর্ব নিদর্শন। ঈদের নামাজের পর কোলাকুলি, হাত মেলানো, শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে হৃদয়ের সকল কালিমা মুছে যায়। “ঈদ মোবারক” ধ্বনিতে মুখরিত হয় জনপদ। ঈদের সকাল শুরু হয় মিষ্টি খেজুর দিয়ে, যেন জীবনের তিক্ততা ভুলে মিষ্টতার এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
ঈদুল ফিতরের সামাজিক তাৎপর্য:
ঈদ আত্মীয়তা, সৌহার্দ্য আর সামাজিক বন্ধনের অনুপম প্রকাশ। ধনী-গরিব, জাতি-বর্ণ-ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে মানুষ একত্র হয়।
“ধনী-গরিবের নাই তফাৎ,
ঈদের খুশিতে সমান নিঃসন্দেহ।”
— (আব্দুল হাকিম)
এই দিনে কেউ থাকে না একা বা উপেক্ষিত। জাকাতুল ফিতর এবং সদকার মাধ্যমে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুখেও হাসি ফুটে। ঈদের শুভক্ষণে দরিদ্রের হাতটি যখন ভরে ওঠে খাদ্য, বস্ত্র আর ভালবাসায়, তখন প্রকৃত ঈদের আনন্দ পূর্ণতা পায়।
ঈদুল ফিতরের অর্থনৈতিক তাৎপর্য:
ঈদ শুধু আবেগের নয়, অর্থনীতিরও এক প্রাণবন্ত সময়। নতুন পোশাক, খাবার, খেলনা, সাজসজ্জার পণ্য কেনাকাটায় বাজার গমগম করে।
“বিপণি পল্লী করিছে আহ্বান,
ঈদের বাজারে খুশির সন্ধান।”
ছোট ছোট কারিগর, দোকানি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও এই সময়ে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করেন। ঈদের অর্থনৈতিক প্রভাব সমাজে সাম্য ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে।
ঈদুল ফিতরের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য:
ঈদ মানে আত্মশুদ্ধি। এক মাসের সংযম, ধৈর্য, দয়া ও ত্যাগের পর এই দিন আসে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর অবসরে।
“মাগফিরাতের নূর জ্বলে অন্তরে,
ঈদের মোবারক আলো এই ভোরে।”
নবজাগরণের এই দিনে মানুষ প্রতিজ্ঞা করে—সততা, দয়া, ক্ষমা, আর সহমর্মিতায় জীবনকে সাজাবে। পার্থিব দুঃখ-কষ্ট ভুলে ঈদুল ফিতরের ভোরে মানুষ যেন নতুন আলোর দিকে যাত্রা শুরু করে।
ঈদুল ফিতরের বৈশ্বিক তাৎপর্য:
ঈদ বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিমের হৃদয়ে একসঙ্গে ছড়িয়ে দেয় আনন্দের স্পন্দন। মক্কা, জাকার্তা, ঢাকা, কায়রো কিংবা ইস্তাম্বুল—যেখানেই হোক, ঈদের নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে থাকে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের ছবি।
“জাতি-ধর্মের ভেদ ভুলিয়া
ঈদের সকালে দাঁড়াইয়া,
একই কাতারে নামাজ পড়ে
দুনিয়ার মুসলিম ভ্রাতারা।”
ঈদ তাই কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটি সামষ্টিক বন্ধনেরও এক অনন্য নিদর্শন।
পরিশেষে বলা যায়, ঈদুল ফিতর এক স্বর্গীয় আহ্বান—আনন্দ, সংযম আর মানবিকতায় পূর্ণ। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে জেগে ওঠে সামাজিক সমতা, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এবং মানবিক মূল্যবোধের উজ্জ্বল আলো।
“ঈদ আসে বারতা নিয়ে শান্তির,
ভ্রাতৃত্বের, ভালোবাসার, কল্যাণের।”
আজকের দুনিয়ায় ঈদের প্রকৃত শিক্ষা—দুঃখীর পাশে দাঁড়ানো, প্রতিবেশীর খোঁজ নেওয়া, হৃদয়কে শুদ্ধ করা—এই মূল্যবোধ যদি আমরা রক্ষা করি, তবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি, সৌহার্দ্য আর সমৃদ্ধি।
ঈদুল ফিতর হোক মানবতার এক অমলিন উৎসব, যেখানে সকলে মিলে গাইব—
“এসো মিলি সকলে, ঈদের আনন্দে,
ভুলে থাকি হিংসা আর দ্বন্দ্ব বিভেদে।”
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct