বাঙালিদের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পূর্বে বা তারও আগে যখন ধর্ম এবং রাজনৈতিক বিভেদ এই চরম পর্যায়ে সমাজে পরিলক্ষিত হয়নি তখন ভক্ষিতেরা হতো দুর্বল এবং দরিদ্র। আর বর্তমান যুগে মেরুকরণের রাজনীতিতে এখনো সারা গোবলয় কে টেক্কা দিতে না পারলেও দুই জাতির মধ্যে হানাহানি করে আবার কখনো রাজনৈতিক দলগুলির চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তিদের কখনো বিরুদ্ধ দলের আবার কখনো নিজেদের দলের ই মধ্যে চেয়ার থেকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য টানাটানি করে দুপক্ষের লড়াই লাগিয়ে দেওয়াকে অনেক বাঙালি একটি নিষিদ্ধ আনন্দ হিসেবে দেখে। লিখেছেন তন্ময় সিংহ।
কাক তার স্বজাতির মাংস খায় না, কিন্তু বাঙালি কাকের সমকক্ষ হতে পারেনি, বাঙালিরা একে অপরের মাংস ভক্ষণ করে, এর সর্বশেষ উদাহরণটি আমরা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে দেখলাম যখন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অন্তর্গত একটি কলেজে বক্তৃতা দান করার সময় বামমনস্ক ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে বক্তব্য চলাকালীন বাধাদান করার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে এ অনুষ্ঠানটি ভঙ্গ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা করলেন। উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীর পাশে থেকে তাকে উৎসাহিত করেন এবং সম্পূর্ণ ঘটনাটিতে মেজাজ না হারিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিদেশে তাঁর রাজ্যের সহ নাগরিকের প্রতি সংযত হওয়ার আবেদনই জানালেন বলে আমরা সমাজ মাধ্যমে প্রাপ্ত ভিডিওতে দেখলাম। এই ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের বুকে ঘটে যাওয়া আরজি করে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদ করলেন এবং তারা সেই সম্প্রদায় থেকে এসেছেন বলে জানালেন। আরজিকর ঘটনা নৃশংস ও নিন্দনীয়, কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়াই ঘটনা কাম্য নয়। পরবর্তীকালে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্ত এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য ও অনুসন্ধান সার্বিক ভাবে একই দিকে দিশা নির্দেশ করেছে এবং প্রাথমিকভাবে কোর্টের আদেশও এসেছে ও কেসটি উচ্চতর বর্তমানে বিচারাধীন। কিন্তু স্বজাতির একজন প্রতিনিধি যিনি রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান তাকে বিদেশের মাটিতে অপদস্থ করার এই প্রয়াস বাঙ্গালির জন্য কোনদিনই গৌরব জনক নয়।
বাঙালিরা নিজেরাই নিজের মাংস খায় তার উদাহরণ আমরা বর্তমানে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সাংবিধানিক প্রধানের সাথে বিদেশের মাটিতে এই ঘটনা এই প্রথম। এর আগেও সপরিবারে ছুটি কাটাতে পশ্চিমবঙ্গের গ্রীষ্মকালে ইংল্যান্ডে আসতেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু যিনি ইংল্যান্ডের কলেজ থেকে আইনের ডিগ্রি নিলেও, প্রাথমিকের ইংরেজি বন্ধ করে বাংলার যুব সমাজকে দীর্ঘ ৩০ বছর অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিলেন। তখন চরিত্রগতভাবে কাঁকড়ার জাত হলেও লোকাল পার্টি অফিসের ভয়ে বাঙালি প্রতিবাদ লিপিবদ্ধ করতে পারেনি সেই অর্থে । বিরোধীদলের মুখপত্রের সারা বাংলায় না থাকা এবং সোশ্যাল মিডিয়া না থাকাও হয়তো এর কারণ। ২০১১ এর পরবর্তীতে লোকাল পার্টি অফিসের জুলুমের ঘটনা অনেক বিক্ষিপ্ত এবং বিরোধী দলের মুখপত্র ও সোশ্যাল মিডিয়া সর্বত্র। তাই এককালের দীর্ঘদিনের শাসক দলটি নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে মাঝে মাঝেই এই ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয় যা হয়তো ব্যালট বাক্সে দলের পক্ষে তাদের প্রতিফলন ঘটাতে না পারলেও জনমানসে এবং টিভির সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় তাদের জীবিত করে রাখে। বাঙালি জাতির এই নিজেদের মধ্যে আত্মঘাতী গোল করার প্রবণতা চিরকালীন।
বাঙালিদের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পূর্বে বা তারও আগে যখন ধর্ম এবং রাজনৈতিক বিভেদ এই চরম পর্যায়ে সমাজে পরিলক্ষিত হয়নি তখন ভক্ষিতেরা হতো দুর্বল এবং দরিদ্র। আর বর্তমান যুগে মেরুকরণের রাজনীতিতে এখনো সারা গোবলয় কে টেক্কা দিতে না পারলেও দুই জাতির মধ্যে হানাহানি করে আবার কখনো রাজনৈতিক দলগুলির চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তিদের কখনো বিরুদ্ধ দলের আবার কখনো নিজেদের দলের ই মধ্যে চেয়ার থেকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য টানাটানি করে দুপক্ষের লড়াই লাগিয়ে দেওয়াকে অনেক বাঙালি একটি নিষিদ্ধ আনন্দ হিসেবে দেখে। এই সিদ্ধান্ত অনেক সময় আত্মঘাতী হলেও গোপনে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত নিষিদ্ধ বলেই এর চর্চা যথেষ্ট হয়। বর্তমানে হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির রিলসের যুগেও বেকার যুবক সম্প্রদায় অনেক ক্ষেত্রে অর্ধ উলঙ্গ রিস্কের থেকেও এই ট্রোলিং এর মজা গ্রহণ সুখকর বলে মনে করে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তৎকালীন যুগে এই ট্রোলিং হাত থেকে রক্ষা পাননি।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যখন গোটা বাংলা গ্রাস করে ফেলেছিল, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাথমিক নীরবতা সকলের মধ্যে বিস্ময় জাগিয়ে তোলে। রবীন্দ্রনাথ ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে মজফফরপুর থেকে তাঁর বক্তব্যে এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর মতামত রাখেন। পরবর্তীকালে এই সময় থেকেই স্বদেশপ্রেমের ভাবনা জাগরিত হয় প্রথমত বাঙালি এবং পরবর্তীতে সারা ভারতের নাগরিকদের মধ্যে। বাংলা কে দ্বিখণ্ডিত করে বাঙালি জাতিকে দুর্বল করার প্রয়াস আবার কখনো ধর্মের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রয়াস শুরু করেছিল ইংরেজরাই। এই সময়কার রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অবস্থানের উপর রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন চিহ্ন তুলে ধরলেও এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে দেশ প্রেম সারা বাংলাতে ছড়িয়েছিল তার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন ।তিনি মনে করেছিলেন, পরের কাছ থেকে সুস্পষ্ট আঘাত পেয়ে পরতন্ত্রতা শিথিল হলে নিজেদের ঐক্য সুদৃঢ় হয়ে উঠবে।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সক্রিয়ভাবে করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে হয়েছিল এই দেশ প্রেম একটা শক্তি, তার নাম দেশ প্রেম। এই শক্তি যখন হৃদয়ের সম্মিলনের মধ্যে দিয়ে যায় তখন তা পরিণত হয় এক মহাশক্তিতে। এই মহাশক্তি দিয়ে রাজশক্তির বিরুদ্ধে যে প্রবল লড়াই করা যায়। সেই মুহূর্তে অমিত ক্ষমতার অধিকারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে সেই লড়াইটারই সূচনাপর্ব রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় পরিচয় পেলেও এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বাংলায় এই দেশপ্রেমের উন্মেষ রবীন্দ্রনাথের আগে কেউ এভাবে দর্শন করতে পারেন নি। ১৯০৪ সালের ১৬ জুন বঙ্গদর্শনে দীনেশচন্দ্র সেনের সাহিত্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে বিলিতি সভ্যতার মোহ কেটে গিয়ে আমাদের দেশ যথানিয়মে আমাদের হৃদয়কে পাইতেছে। ইহাই পরম লাভ। ধনলাভের চেয়ে ইহা অল্প নহে। দূরদর্শী কবি তখনও ভাবেনি যে জাতি হিসেবে পরবর্তীতে বাঙালিদের ইতিহাস সব দিনে কাঁকড়ার হয়ে থাকবে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল হয়ে পৃথিবীতে সমস্ত ক্ষেত্রেই বাংলাকে গর্বিত করার মানুষেরা নিজভূমে অর্থাৎ বাংলা সমাজ থেকেই যে শ্লেষ ও অশ্রদ্ধা পেয়ে আসছেন তা পরবর্তী একশ বছরে ব্যস্তানুপাতিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ট্রোল নামক ভয়ঙ্কর মহামারীর জন্ম দেবে। যার ছোঁয়া থেকে বাদ যাবে না স্বাধীন ভারতের কোন ব্যক্তিত্বই বিশেষত মৃত মহাপুরুষরাও এই ট্রোলিং এর শিকার হবেন। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তো সিলেবাসের মধ্যেই আছেন।
যদিও ওই কলেজে বক্তৃতার সময় বিরোধিতা করা ছাত্রদের মনে রাখা উচিত যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর এই সফর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি সফর । এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, তাঁর এই বিদেশ ভ্রমণ কর্মসূচি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই শাসকদলের কিছু সোস্যাল মিডিয়ায় অপ্রাসঙ্গিক প্রচারের সুবিধা নিয়ে এই বাম এবং অতি বাম সংগঠনের বিভিন্ন জন বিষয়টি নিয়ে অহেতুক জলঘোলা এবং টেনে নামিয়ে আনার একটি চেষ্টা নিয়মিতভাবে করে চলছিলেন। যদিও এ সময়টি যদি তারা কোন বিখ্যাত জনকে অপদস্ত করার এবং বাংলাকে কালিমা লিপ্ত করার চক্রান্ত করার বদলে নিজেদের বিখ্যাত করার পরিবর্তে বিরোধী দল হিসেবে তাদের ভুল-ত্রুটিগুলি সংশোধন করতেন তাহলে হয়তো ২০২৬ এর নির্বাচনে বিরোধী দল হিসেবে বিধানসভায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হত। কিন্তু ট্রোলিং এ বিশ্বাসী ও হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির প্রাজ্ঞ পরামর্শদাতারা তাঁদের পূর্বসূরীদের পথ অনুসরণ করে পশ্চিমবঙ্গে কম্পিউটার নিষিদ্ধ করার মতো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেউ ইংল্যান্ডে অপদস্থ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ কে আরেকবার পশ্চাদ্ধাবন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেখানে ভারতের চিরাচরিত ঐতিহ্য বিরোধী দলগুলিও বিদেশ ভ্রমণ কালে দেশের সরকারের আদর্শকেই সাধারণত তুলে ধরে।
নীরদ সি চৌধুরী আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘আত্মঘাতী বাঙালি’। কিন্তু আমরা যে ‘আত্মঘাত’কে এত দিনে রীতিমতো ‘সংস্কৃতি’তে রূপান্তর করে ফেলেছি, তার নবতম উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অন্তর্গত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে কতিপয় বাঙালিদের কাছ থেকেই বক্তব্য রাখার সময় বিরোধিতার সম্মুখীন হওয়া তাও বিদেশের মাটিতে। এর আগে বিদেশের মাটিতে বিগত ৫০ বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাঙালি সৌরভ গাঙ্গুলীকে এই দলের পক্ষ থেকেই অপমান ও সোশ্যাল মিডিয়া ট্রোলিং এর শিকার হতে হয়েছিল। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রে প্রত্যেকের নিজের বক্তব্য রাখার অধিকার আছে, এসম্পর্কে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু বিদেশের মাটিতে আমাদের কোন অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর গরিমা রক্ষা করার দায়িত্ব সেই দেশের বিভিন্ন সূত্রে যাওয়া প্রত্যেক অনাবাসী ভারতবাসীর ও বটে। সেইখানে ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশ নয় শুধু মাত্র রাজনীতির কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে অপমান করার ঘটনা রাজনীতিগত ভাবে দেউলিয়াপনা ছাড়াও আমাদের আত্মঘাতী বাঙালির চিরাচরিত কাঁকড়ার চরিত্রের পরিচয় বহন করে।
** মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct