বিশেষ কলমে রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি ও রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নাপরাজিত মুখোপাধ্যায়: ভারতবর্ষ ১৯৭৪ সালে পোখরানে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়।এই বিস্ফোরণটি শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী (প্রধানমন্ত্রি) তত্ত্বাবধানে হয় এবং ভারতের পারমাণবিক অস্ত্রের সুচনা হয়। তার আগে জওহর লাল নেহেরুর সময় থেকে পারমাণবিক অনুসন্ধান কাজ চলছিলো যেটা শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য প্রযুক্তি তৈরি করা হচ্ছিলো। চীন ১৯৬৪ সালে, লপনুর নামে একটি জায়গায় পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় এবং পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়। পাকিস্তান ১৯৮৮ সালে জেনারেল জয়াউল হকের আমলে কাহুটাতে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় এবং পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়। এই তথ্য থেকে এটা বোঝা যাছে যে ভারতের দুই মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কূটনীতিবিদরা বলে যে যখন দুটি দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকে তখন NUCLEAR DETERENCE এর জন্য দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অপরের ওপর পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে না। কারণ তাঁরা জানে যে এইটি ব্যাবহার হোলে ফলাফল ভয়ানক হবে। ততস্বত্বেও সাবধানতা রাখার জন্য দুই দেশের মধ্যে নানান চুক্তি করা হয়েছে।
১৯৯৯ সালে শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী, প্রধানমন্ত্রির নেতৃতে একটি দল লাহোরে যায় ও তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মিয়া নওয়াজ শরিফের সঙ্গে আলোচনা করে। পরবর্তীকালে একটি মউ সাক্ষরিত হয় যেটা লাহোর চুক্তি নামে পরিচিত।অক্টোবর ৩, ২০০৫ সালে লাহোর চুক্তির পরিপেক্ষিতে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যেটার নাম হল Indo Pak Agreement on Reducing Risk from Accidents Relating to Nuclear Weapons এই চুক্তিতে দুই পক্ষকে কিভাবে পারমাণবিক দুর্ঘটনা এড়ানো যায় এবং যদি কোনও দুর্ঘটনা হয় তাহলে একে অপরকে জানাতে হবে। এর জন্য ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি হটলাইন তৈরি থাকবে মাঝে মাঝে দুই পক্ষ একসাথে আলোচনা করবে যাতে এই চুক্তিটি ভাল ভাবে ব্যবহৃত হয়। এই চুক্তিটি পাঁচ বছরের জন্য করা হয়ে ছিল। এছাড়া ২০০৫ সালে Indo Pak Ballistic Missile Treaty সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে বলা হয় যে একে অপরকে ৭২ ঘণ্টার নোটিশ দেবে যদি উহারা ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে। এছাড়া এই ক্ষেপনাস্ত্র যেন নিয়ন্ত্রণ রেখা, জম্মু ও কাশ্মির অথবা সীমান্ত এলাকা পার না করে। বলা হয়ে ছিল যে এই পরীক্ষা সীমান্তের ৭০ কিমি দূরত্ব রেখে করা হবে। কিন্তু এই চুক্তিতে একটি ঘাটতি ছিল কেননা চুক্তি খালি ক্ষেপনাস্ত্র ও ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র জন্য লাগু হবে কিন্তু পৃথিবী থেকে আকাশে নিক্ষেপ করা ক্ষেপনাস্ত্রর জন্য লাগু হবে না। দুমাস আগে ২০২২ সালে পাক আর্মি থেকে খুব হইচই করা হয় যে ভারত থেকে একটি ব্রাম্মস ক্ষেপনাস্ত্র পাক সীমানা অতিক্রম করে গিয়ে পড়ে। এই ঘটনাটি নিয়ে ভারত সরকার খুব চিন্তিত হয় এবং বায়ুসেনা কত্তিপক্ষএর বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।এখানে প্রশ্ন হচ্ছে যে ২০০৫ সালের চুক্তি কি লঙ্ঘন হয়েছে?
আমাদের কাছে যা তথ্য আছে তা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে ভারতের কাছে ৪৫ থেকে ৯৫ টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে যেখানে পাকিস্তানের কাছে ৩০ থেকে ৫০ টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে। (Data from armscontrol.org).
ভারতের সঙ্গে চীনের এরকম কোনও চুক্তি নেই। আবার ভারত ১৯৭০ সালের Non-Proliferation Treaty তে স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু ভারত Treaty on Prohibition of Nuclear Weapons (TPNW) January 28, 2021 এ স্বাক্ষর করে। আশ্চর্যের বিষয় হল যে ইউ.এন.ওর নিরাপত্তা পরিষদের যে পাঁচজনের স্থায়ী সদস্য আছেন যার মধ্যে চীন হচ্ছে একজন এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। অর্থাৎ ভারত চীনের মধ্যে কোনও পারমাণবিক বিষয়ে চুক্তি নেই যেটা নাকি পাকিস্তানের সঙ্গে আছে।
এই বিষয়ে একটি অনুসন্ধানের পরীক্ষামূলক প্রতিবেদন Sandia National Laboratory Research Fellow শ্রী সীতাকান্ত মিশ্র এবং মনসুর আহমেদ তৈরি করে যার নাম হল “Co.operation Mesaures to Support the Indo-Pak Agreement on Reducing Rish from Accidents Relating to Nuclear Weapons. এই প্রতিবেদনের ভিত্তি হল যে কোনও সময়ে উভয়ের মধ্যে একটি পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘোটতে পারে। যার ফল ভয়ানক হতে পারে। তার জন্য ওনারা কতগুলি সুপারিশ দিয়েছেন।
ভারত ২০১৫ সালে মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিম চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যেটা নাকি জি৭ দেশ গুলি আগেই স্বাক্ষর করেছিল। এই চুক্তির পরবর্তী ভারত মিসাইল প্রজুক্তির নিয়ন্ত্রনে এসে গেল।
নাগরিক প্রতিরক্ষা এবং সুরক্ষা পারমাণবিক শক্তি হওয়ার জন্য খুবই জরুরী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন এবং বিভিন্ন ইউরোপের দেশ গুলিতে নাগরিক সচেতনতা ৫০ এর দশক থেকে শুরু করা হয়। বিভিন্ন চলচিত্রর মাধ্যমে বাচ্চাদের স্কুলে এবং কলেজে এই বিষয়ে সচেতন করা হত। শহর অঞ্চল গুলিতে পারমাণবিক যুদ্ধ হলে কি ধরনের নাগরিক সুরক্ষা ও পরিষেবা দেওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে সুব্যবস্থা করা আছে। যেরকম নাকি ভূমি গর্ভে বাসস্থান, সেখানে বাতানুকূল, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং শুখনো খাবার রাখার ব্যাবস্থা করা আছে। এছাড়া শহরে ভূগর্ভস্থ বাসস্থান চিনহিত করা আছে। মাঝে মাঝেই নাগরিক সুরক্ষা দপ্তর নাগরিকদের জন্য মক ড্রিল করা হয়। যে কোনও পারমাণবিক যুদ্ধে তেজস্ক্রিয় বিকিরন একটি অঙ্গ। এর ফলে স্বাস্থ্যজনিত নানারকম বিকার হওয়া শুরু করে। তার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং ভূমিগর্ভস্থ বাসস্থানে চিকিৎসার সুব্যবস্থা ও সুবিধা রাখা হয়েছে।
ভারতে যে বিভিন্ন মেট্রো শহর আছে তাতে এরকম বাবস্থা বোধহয় নেই। স্কুল এবং কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের এই বিষয়ে কোনও শিক্ষা দেওয়া হয়না এবং নাগরিকদের সচেতন করা হয় না। চিকিৎসার সুব্যবস্থা বিভিন্ন হাসপাতালে নেই। এই পরিপেক্ষিতে যদি কোনও পারমাণবিক যুদ্ধ অথবা কোনও পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে ভারতের নাগরিকদের একটি অত্যন্ত দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হবে। নাগরিক সুরক্ষা, খাদ্দের অভাব, চিকিৎসার অভাব প্রধান বিষয় হয়ে উঠবে। এর ফলে নাগরিক সুরক্ষা ভীষণ ভাবে বিঘ্নিত হবে এবং দেশ একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সুরক্ষা দপ্তরের উচিত যে একটি বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করা যেটাতে নাকি-
১। নাগরিক সচেতনতা, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা
২। খাদ্য পণ্য সরবরাহর বাবস্থা
৩। ভূগর্ভস্থ আশ্রয় ব্যবস্থা এবং নাগরিক পরিষেবা অর্থাৎ বিদ্যুৎ, জল সরবরাহ এবং শৌচাগারের ব্যবস্থা এই ভয়াভয় পরিস্থতি যাতে থাকে তা সুনির্দিষট করা। নাগরিক প্রতিরক্ষা দপ্ততরকে আরও তৎপর এবং কর্মঠ হতে হবে। তাহলেই সুফল মিলবে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct