আপনজন ডেস্ক: গাজার বাতাসে শুধু লাশের গন্ধ। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গাজার বাতাসে তাইলে বাহিনীর প্রসেযজ্ঞের চিহ্ন। রেহাই পাচ্ছে না কোলের শিশুও। মাঝে যুদ্ধবিরতির কল্যাণে মৃত্যুর মিছিল কিছুটা থামলেও আবার সেখানে নারকীয় তাণ্ডব শুরু হয়েছে। একের পর এক গোলাবর্ষণে ভূখণ্ডটিকে বিরাণভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহ হুঙ্কার দিয়েছেন বাকি জিম্মিদের ছেড়ে না দিলে ভূখণ্ডটির একাংশ দখল করে নেওয়া হবে।
এই অবস্থায় গাজাবাসীর প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে চরম আতঙ্কে। ভাবছেন এই বুঝি বোমার আঘাতে দেহটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছে শিশুরা। চোখের সামনে গগনবিদারী বোমার শব্দে যখন সবকিছু প্রকম্পিত হচ্ছে, তখন তাদের কচি মনে এর তীব্র প্রভাব পড়ছে। রাতে ঘুমানো তো দূরের কথা, দিনের আলোও তাদের ভয় লাগে। খুব কাছে থেকে মৃত্যুর দৃশ্য দেখে তারা এখন ভয়াবহ ট্রমার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে তাদের মানসিক বিকাশ তো দূরের কথা, ধীরে ধীরে তারা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনে এমন একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়, গত বছর সেপ্টেম্বরে সামা তুবাইল নামে একটি শিশুর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তারা। যখন তার সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়, তখন সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মাকে বলেছিল, ‘মা আমি ক্লান্ত, মরে যেতে চাই। সে মাকে প্রশ্ন করে, ‘আমার চুল কেন গজাচ্ছে না? আমি মরে গিয়ে জান্নাতে চুল ফিরে পেতে চাই, ইনশাআল্লাহ।’
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রূশ হাতে চুল আঁচড়ানোর ভঙ্গি করে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে শিশুটি বলে, ‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমার আঁচড়ানোর মতো একটি চুলও নেই।’
গাজার এই চিত্র শুধু সামার বেলায় নয়, হাজার হাজার শিশুর একই অবস্থা। চিকিৎসকরা বলছেন, ভয়ের কারণে তাদের শরীরে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পরিস্থিতি পুরোপুরি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত তাদের এ সমস্যা থেকে যাবে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সিএনএন আবার সামার সাক্ষাৎকার নেয়। এ সময় সে বলে, ‘আমাদের বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, এখন আর আমাদের থাকার কোনো জায়গা নেই। আমরা পথে পথে ঘুরছি।’ এ প্রসঙ্গে গাজার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ফাদেল আবু হিন বলেন, মারাত্মক ট্রমার লক্ষণ তৈরি হচ্ছে শিশুদের মধ্যে। অনেকেই সরাসরি তাদের ভয় ও প্রতিক্রিয়ার কথা জানাচ্ছে। কিন্তু যেসব শিশু তা জানাতে পারছে না তাদের অবস্থা বেশি খারাপ। তিনি বলেন, শিশুদের মধ্যে যে লক্ষ্মণগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো হচ্ছে: খিঁচুনি, বিছানায় প্রস্রাব করা, ভয়, আগ্রাসি আচরণ, নার্ভাসবোধ, এবং মা-বাবার পাশ ছেড়ে না যাওয়া ইত্যাদি। মনোরোগবিদ বলেন, বড়রাই যেখানে ভয় পাচ্ছে, সেখানে শিশুদের অবস্থা কী হবে, তা সহজেই বোঝা যায়। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ কবে শেষ হবে তা আমার জানা নেই, তাই বলে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। তাদের চিকিৎসাও করাতে হবে।’
জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ গত জুনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, গাজার প্রায় ১২ লাখ শিশুই বর্তমানে মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তায় ভুগছে, বিশেষ করে যারা একাধিক বার ভয়াবহ সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছে। গত জানুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, একটি প্রজন্ম ভয়াবহ মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শিশুরা নিহত হয়েছে, অনাহারে থেকেছে, তীব্র ঠান্ডায় কষ্ট পেয়েছে। এমনকি অনেকে জন্মের আগেই মায়ের সঙ্গে প্রসবকালে মারা গেছে।
এছাড়া একই বছর ডিসেম্বরে শিশুদের ওপর চালানো এক গবেষণায় বলা হয়েছে গাজার ৯৬ শতাংশ শিশু মনে করে, তাদের মৃত্যু অতি সন্নিকটে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক শিশু, বিশেষত ছেলেরা (৭২ শতাংশ) তাদের মৃত্যু কামনা করছে। এই পরিসংখ্যানটি গাজার শিশুমনের ভয়াবহ অবস্থা এবং যুদ্ধে তাদের প্রতি চলমান মানসিক আঘাতের দিকটিকে প্রতিফলিত করে।
‘ওয়ার চাইন্ড অ্যালায়েন্সের’ সহায়তায় গাজার একটি স্থানীয় এনজিও গবেষণাটি পরিচালনা করেছে। এনজিওটি নিডস অ্যাসেসমেন্ট’ জরিপের মাধ্যমে গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯২ শতাংশ শিশু জানিয়েছে, তারা ‘বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারছে না’। অর্থাৎ তারা তাদের বর্তমান পরিস্থিতি গ্রহণ করতে অক্ষম। ৭৯ শতাংশ শিশু রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে এবং ৭৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণের লক্ষণ দেখা গেছে। ওয়ার চাইল্ড অ্যালায়েন্স ইউকের প্রধান নির্বাহী হেলেন প্যাটিনসন বলেছেন, ‘এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, শিশুদের থাকার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ানক স্থানগুলোর একটি গাজা। হাসপাতাল, স্কুল এবং বাড়িঘরের মতো মৌলিক অবকাঠামো ধ্বংসের পাশাপাশি, গাজার শিশুদের মানসিক অবস্থা গুরুতর আঘাতের শিকার, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে চরমভাবে প্রভাব ফেলছে।’
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct