দেশজুড়ে বিজেপি সরকারের আমলে সংখ্যালঘু-নামাঙ্কিত নাম পরিবর্তনের প্রবণতার মধ্যেই এবার মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বদলের প্রস্তাব উঠল রাজ্য বিধানসভায়। গত বুধবার নবগ্রামের বিধায়ক কানাই চন্দ্র মণ্ডল প্রাক্তনীদের দাবির ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রাজা কৃষ্ণনাথের নাম যুক্ত করার প্রস্তাব দেন বিধানসভায়। তাঁর মতে, ‘মুর্শিদাবাদ কৃষ্ণনাথ বিশ্ববিদ্যালয়’ হলে কৃষ্ণনাথের অবদান স্বীকৃতি পাবে এবং মানুষের আবেগের প্রতিফলন ঘটবে। যদিও, মুর্শিদাবাদ জেলার বহু মানুষ চান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে ‘মুর্শিদাবাদ’ নাম অপরিবর্তিত থাকুক। এই বিতর্ক নিয়ে নবাবদের জেলা মুর্শিদাবাদের রাজনীতিক, শিল্পপতি, বিশিষ্টজনেরা কী বলছেন তা তুলে ধরেছেন ‘আপনজন’ সাংবাদিক আসিফ রনি।
মুর্শিদাবাদ জেলার নবগ্রামের বিধায়ক কানাই চন্দ্র মণ্ডল বিধানসভায় রাজা কৃষ্ণনাথের নাম যুক্ত করার জন্য শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী তাঁর উত্তর দিয়েছেন। এটা আমাদের বিষয় নয়, যেহেতু চার বছর পূর্বে যখন বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করা হয় তখন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ কি হবে চিন্তা ভাবনা করেই করেছেন। এই বিষয়টা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে, তিনি যেটা চান সেটাই হবে।
হুমায়ুন কবির, বিধায়ক ভরতপুর
আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় করে মর্যাদা দেওয়া হোক। নতুন একটা বিশ্ববিদ্যালয় করলে অসুবিধা কি আছে? মুর্শিদাবাদ যেহেতু মুসলমান অধ্যুষিত জেলা তাই এই কাজের জন্য আলাদা বরাদ্দ হয় সাচার কমিটির রিপোর্টের পর। কংগ্রেসের সরকার মাইনোরিটি ডিস্ট্রিক ডেভেলপমেন্ট একটা ফান্ড দেয়। একটা কেন আমি তো চাই মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হোক, তার জন্য আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিকে নিয়ে এসেছিলাম, সেটাও তো কিছু করলো না এই সরকার। ভোটের আগে নানা রকমের প্রস্তাব হবে, একে খুশি করব না তাকে খুশি করব। কিন্তু মুর্শিদাবাদের শিক্ষার হার কি আছে? মুর্শিদাবাদের কলেজ গুলোতে কি পড়াশোনা হয়?
অধীর চৌধুরী, প্রাক্তন সাংসদ বহরমপুর
এ ব্যাপারে কৃষ্ণনাথ কলেজ তো ছিলই, নামটা যদি থাকে এবং তার সঙ্গে নবাব সিরাজউদ্দৌলার নাম জড়িয়ে দেয় আমার মনে হয় ভালো হয়। কারণ নবাব সিরাজদৌলা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব, তার নামে একটা আলাদা প্রতিষ্ঠান করলে তো ভালই হয়। কিন্তু এটা কেউ অস্বীকার করতে পারছি না কৃষ্ণনাথের নামেই ওই কলেজটা ছিল। কলেজটা যদি উঠে যায় যারা মহৎ উদ্দেশ্যে জমিটা দান করেছিল, সেটার পাশাপাশি কিছু একটা করা উচিত উনার নামটাকে।
আবু তাহের খান, সাংসদ মুর্শিদাবাদ
মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ই থাকতে হবে এর সঙ্গে কোন নাম জড়া যাবে না। দ্বিতীয়ত কৃষ্ণনাথ কলেজ কর্তৃপক্ষ সেই সময় যারা বিশ্ববিদ্যালয়কে জমি হস্তান্তর করে দিয়েছিলেন এই ঘটনার জন্য তারাই মূল দায়ী। কৃষ্ণনাথ কলেজের সম্পত্তি হস্তান্তরিত করার দায়িত্ব কাউকে দেওয়া হয়নি। ১৮৫৩ সালে তৈরি কৃষ্ণনাথ কলেজ কৃষ্ণনাথ কলেজ হিসেবেই থাক এটাই আমরা চাই। নতুন করে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হোক। পৃথক একটা অস্তিত্ব নিয়ে পৃথক আইডেন্টিটি নিয়ে সেটা তৈরি হোক এবং এবং তার সঙ্গে কৃষ্ণনাথ কলেজের বিল্ডিং ব্যবহার এখন হতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজস্ব পরিকাঠামো তৈরি হবে। কিন্তু কৃষ্ণনাথ কলেজ আলাদা, মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা। তাই মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় নামের সঙ্গে কৃষ্ণনাথ হোক বা অন্য কোন কথা সংযোজন করাটা সমর্থন করি না।
মোহাম্মদ আলী বিধায়ক, লালগোলা
জেলার একটি মহল এর আগেও চেষ্টা করেছিল মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা নিয়ে, এই দাবি নিয়ে তারা হাইকোর্টেও গিয়েছিল কিন্তু ডিভিশন বেঞ্চ এটা খারিজ করে দেয়। এরপর হয়তো অন্যভাবে সে মহল চেষ্টা করছে বিধায়ককে দিয়ে। আমার মনে হয় মুর্শিদাবাদ যেহেতু একটি ঐতিহাসিক জেলা সেদিক দিয়ে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় নামটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। কৃষ্ণনাথ কলেজ যেহেতু ছিল এবং বর্তমানে সেটি অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে মুর্শিদাবাদ ইউনিভার্সিটি অ্যাক্টেরর ফলে। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একটি ভবনের নাম বা কোন একটি সেক্টরের নাম কৃষ্ণনাথের নামে করা যেতে পারে। তাহলে উভয় দিকটি আমার মনে হয় রক্ষিত হবে। মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় যেমন আছে তেমনি থাকল। তার সাথে কৃষ্ণনাথ কলেজ ছিল তাদেরও স্মৃতিটা যেন থেকে যায়।
ড. মেহেদী হাসান, আরবি বিভাগের কোঅর্ডিনেটর মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধ্যাপক, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়
যে নামেই হবে হোক কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় হোক। কোনও জিনিস যেন থেমে না যায়। প্রয়োজনে যত ভালো মানুষ মুর্শিদাবাদে জন্মেছে সবার নাম দেওয়া হোক, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় হোক। নামের জন্য যেন বাধা না হয়।
সাজাহান বিশ্বাস, বিশিষ্ট শিল্পপতি
মুর্শিদাবাদ ইউনিভার্সিটি মুর্শিদাবাদের গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিক্ষার প্রতীক। নাম পরিবর্তনের চেষ্টা ঐতিহাসিক মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ণ করবে, যা আমরা মেনে নিতে পারি না।
কৃষ্ণনাথ কলেজ রাজা কৃষ্ণনাথের অবদান ও ঐতিহ্য বহন করে আসছে, সেটি অক্ষুণ্ণ থাকা উচিত। কলেজের সঙ্গে ইউনিভার্সিটির নাম যুক্ত করার কোনও মানে হয় না। যদি পরিবর্তন করতেই হয়, তবে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইউনিভার্সিটি নামে স্বতন্ত্রভাবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হোক, যা মুর্শিদাবাদের আত্মত্যাগ ও গৌরবের যথার্থ স্বীকৃতি হবে।
জানে আলম, রাজ্য পরিষদের সদস্য, অল ইন্ডিয়া আইডিয়াল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন
মুর্শিদাবাদে একটা পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন, সেটা এখনো মুর্শিদাবাদে হল না। মুর্শিদাবাদে একটা দয়া দেখানোর মতো একটা ইউনিভার্সিটি করে দেওয়া হল যার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি যেটা সেটাই নেই, এত বড় একটা জেলা মুর্শিদাবাদ। মুসলিম অধ্যুষিত জেলা বলেই কি মুর্শিদাবাদ এই বঞ্চনার শিকার? যেখানে ছোট ছোট জেলাতেও একটা করে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাচ্ছে। এই বঞ্চনাকে ঢাকবার জন্য কোন রকমে একটা বিশ্ববিদ্যালয় করে দেওয়া হল। মুর্শিদকুলি খাঁকে ভিত্তি করে মুর্শিদাবাদ আজ গোটা বিশ্বে পরিচিত। মুর্শিদাবাদ নামেই মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া দরকার। এটা নিয়ে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা উচিত না। কৃষ্ণনাথ কলেজ একটা আলাদা সেপারেট ইস্যু, সেটাকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে কলেজকে কলেজ হিসাবে রেখে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা জায়গায় আলাদা ক্যাম্পাস করবার প্রয়োজন। সেটাও এ রাজ্য সরকার গুলিয়ে দিচ্ছে।
রাহুল চক্রবর্তী, মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক এপিডিআর
এটা হচ্ছে একটা মীমাংসিত বিষয়, যখন এটা তৈরি হয় তখনই নামকরণ নিয়ে নানা রকমের আলোচনা হয়েছিল। সরকার সহ বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সর্বসম্মতি কর্মে সিদ্ধান্ত হয়েছিল মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়। এরপরেও প্রথম থেকে এই নামটাকে পরিবর্তন করার জন্য একটা ছোট অংশ চক্রান্ত করে আসছে। এই দাবি যারা তুলছে তারা মুর্শিদাবাদের উন্নয়ন চাইছে না। মানুষকে ও সরকারকে বিভ্রান্ত করছে। এখন কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন হবে সেদিকেই লক্ষ্য রাখা উচিত নামকরণ নিয়ে নয়।
তায়েদুল ইসলাম, রাজ্য সভাপতির মন্ডলীর সদস্য, ওবিসি সংরক্ষণ অধিকার রক্ষা মঞ্চ
মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে রাজা কৃষ্ণনাথ বা নবাব সিরাজউদ্দৌলার নাম যুক্ত করার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। আমরা চাই কৃষ্ণনাথ কলেজ যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক, তার ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে বেঁচে থাক। মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে নতুন জমি বরাদ্দ হয়েছে সেখানে “মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়” নামেই বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গরূপে গড়ে উঠুক। পরিকাঠামো দ্রুত নির্মাণ করা হোক।
জয়নাল আবেদিন, জেলা সভাপতি, এসআইও, দক্ষিণ মুর্শিদাবাদ
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct