ভারতবর্ষের ইতিহাসে ধর্মান্তর ও সাংস্কৃতিক মিশ্রণের গল্প অসংখ্য। এখানকার বহু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পরিচয় কালের প্রবাহে বদলেছে, কিন্তু তাদের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক মূল একই রয়ে গেছে। এই প্রবন্ধে আমরা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়ের ইতিহাস তুলে ধরব, যারা ধর্মান্তরিত হয়েও একই জাতিসত্তার অংশ হিসেবে বসবাস করছেন। লিখেছেন পাশারুল আলম।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে ধর্মান্তর ও সাংস্কৃতিক মিশ্রণের গল্প অসংখ্য। এখানকার বহু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পরিচয় কালের প্রবাহে বদলেছে, কিন্তু তাদের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক মূল একই রয়ে গেছে। এই প্রবন্ধে আমরা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়ের ইতিহাস তুলে ধরব, যারা ধর্মান্তরিত হয়েও একই জাতিসত্তার অংশ হিসেবে বসবাস করছেন।
১. বাঙালি মুসলমান ও হিন্দু
ইতিহাস বলে মধ্যকালীন যুগে (১২০৪-১৭৫৭) সুফি-দরবেশ, বণিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে বিকশিত হয়।
প্রথম পর্যায়ে- (১৩শ-১৪শ শতক) আরব ও পারস্যের মুসলিম বণিকরা বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে ব্যবসা ও বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে ইসলামের প্রাথমিক প্রচার করেন।
দ্বিতীয় ধাপে- সুফি সাধকরা (যেমন শাহ জালাল, খান জাহান আলী) স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগ স্থাপন করে ইসলামের মানবতাবাদী দর্শন ছড়িয়ে দেন। তাঁরা স্থানীয় ঐতিহ্য ও ইসলামী শিক্ষার সমন্বয়ে গণ-ধর্মান্তরের পথ সুগম করেন।
তৃতীয় পর্যায়ে- (১৪শ-১৬শ শতক) বাংলার স্বাধীন সুলতানরা (ইলিয়াস শাহী, হুসেন শাহী) ইসলামকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেন এবং মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ, জমি দান ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যমে ধর্মান্তরকে প্রণোদিত করেন। এ সময় নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায় ও আদিবাসী গোষ্ঠী সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তির আশায় ইসলাম গ্রহণ করে।
চতুর্থ ধাপে- মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে ইসলামী আইন ও শিক্ষার প্রসার ধর্মীয় পরিচয়কে সুদৃঢ় করে। ১৯৪৭ সালে বাংলায় একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান হয়, সেখানে বাঙ্গালী মুসলমান বৃহৎ অংশ পরে। বর্তমানে যা বাংলাদেশ। অবশিষ্ট বাঙ্গালী মুসলমান এদেশে থেকে যায়।
২. রাজবংশী মুসলমান ও হিন্দু
বাংলা ও আসামের রাজবংশী সম্প্রদায়ের একাংশ ইসলাম গ্রহণ করেছেন মধ্যযুগে, বিশেষত সুফি সাধকদের প্রভাবে। অন্যদিকে, রাজবংশী হিন্দুরা শৈব বা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। উভয়েই একই ভাষা (রাজবংশী/কামতাপুরী), লোকসংস্কৃতি (ভাওয়াইয়া গান), ও কৃষিভিত্তিক জীবনযাপন করে থাকেন। তাদের মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্য থাকলেও জাতিগত সত্তা অভিন্ন। উত্তর বঙ্গের এই ধর্মান্তরিত মুসলমানরা নস্য শেখ হিসাবে পরিচিত। ইসলামপুর মহকুমায় হিন্দু মুসলমান সবাই নিজেদের সূর্যাপুরী বলে পরিচয় দেন।
৩. জাঠ মুসলমান (পাঞ্জাব ও হরিয়ানা)
জাঠ সম্প্রদায়ের একাংশ ইসলাম গ্রহণ করেছেন মুঘল ও সুফি প্রভাবে, যারা আজ “মুসলমান জাঠ” নামে পরিচিত। অন্যদিকে, হিন্দু ও শিখ জাঠরা কৃষি ও যোদ্ধা ঐতিহ্য ভাগ করে নেন। পাঞ্জাবের “মল্লাহ” ও “চীমা” গোত্রের মুসলমানরাও জাঠ সম্প্রদায়ের অংশ।
৪. মেও মুসলমান (রাজস্থান-হরিয়ানা)
মেও সম্প্রদায়ের মানুষরা নিজেদের রাজপুত বংশোদ্ভূত বলে দাবি করেন। মধ্যযুগে ইসলাম গ্রহণ করলেও তারা হিন্দু সংস্কৃতির বহু প্রথা (যেমন: দীপাবলি, হোলি) পালন করেন। তাদের গল্প-কাব্যে দুল্লা ভাটি ও আলহা-উদলের মতো হিন্দু-মুসলমান নায়কদের যুগলবন্দি দেখা যায়।
৫. ম্যাপিলা মুসলমান (কেরালা)
কেরালার ম্যাপিলা সম্প্রদায়ের উৎস স্থানীয় হিন্দু সমাজ ও আরব বণিকদের মধ্যে বিবাহসূত্রে। চেরামন পেরুমল রাজার ইসলাম গ্রহণের কিংবদন্তি এখানে জনপ্রিয়। ম্যাপিলাদের মাতৃভাষা মালয়ালম, এবং তাদের সংস্কৃতিতে মোপলা পট্টু (লোকগীতি) ও হিন্দু-মুসলমান উৎসবের সমন্বয় লক্ষণীয়।
৬. গাড্ডি মুসলমান (জম্মু-কাশ্মীর)
গাড্ডি সম্প্রদায় মূলত পশুপালক। এদের একাংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও হিন্দু গাড্ডিদের মতোই গুজরি ভাষায় কথা বলেন এবং একই পোশাক-আচার পালন করেন। উভয়েই শেখ নূরউদ্দিন ওয়ালির মাজার ও হিন্দু দেবতা শিবের মন্দিরে সমান শ্রদ্ধা জানান।
৭. দেসি মুসলমান (অসম)
অসমের দেসি মুসলমানরা স্থানীয় কোচ-রাজবংশী, আহোম ও অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠী থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। তাদের ভাষা অসমিয়া, এবং বিহু উৎসব পালন তাদের সংস্কৃতির অংশ। হিন্দু কোচ-রাজবংশীদের সঙ্গে তাদের জাতিগত সাদৃশ্য প্রকট।
৮. কুনবি-মুসলমান (মহারাষ্ট্র)
মহারাষ্ট্রের কুনবি সম্প্রদায়ের একাংশ ইসলাম গ্রহণ করে “মুসলমান কুনবি” নামে পরিচিত হন। তারা হিন্দু কুনবিদের মতোই কৃষিকাজ ও মারাঠি সংস্কৃতির ধারক। ভক্তি আন্দোলনের সন্ত-কবিরা উভয় সম্প্রদায়ের কাছে শ্রদ্ধেয়।
৯. ভিল মুসলমান (রাজস্থান-গুজরাত)
ভিল আদিবাসীদের একাংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের সমাজব্যবস্থা, নৃত্য (গয়র), ও দেবী কালিকা/মাতার উপাসনা হিন্দু ভিলদের সঙ্গে মিলে যায়। রাজস্থানের মেওয়াত অঞ্চলে ভিল-মেও মুসলমানদের মধ্যে এই সমন্বয় দেখা যায়।
১০. ধাঙ্গর (গোয়াল, মহারাষ্ট্র) মুসলমান সম্প্রদায় মহারাষ্ট্রের একটি অনন্য সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের উদাহরণ। তাদের ঐতিহ্যবাহী পশুপালন ও দুগ্ধব্যবসা ইসলামিক অনুশাসনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলে, যেমন ঈদে গরু উৎসর্গের পাশাপাশি স্থানীয় harvest উৎসবে অংশগ্রহণ। মারাঠি ভাষা ও পারিবারিক রীতিনীতির সাথে ইসলামিক শিক্ষা ও পোশাক-আশাকের মিশ্রণ দেখা যায়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে স্থানীয় দেবদেবীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সুফি সাধকদের প্রতি ভক্তির সমন্বয় ঘটে। এই সম্প্রদায় মহারাষ্ট্রের বহুত্ববাদী সমাজে সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে ভূমিকা রাখে।
ভারতবর্ষের মাটি কখনও একক ধর্ম বা সংস্কৃতির মালিকানা দাবি করেনি। এখানকার ইতিহাস হলো বহুত্বের গল্প—যেখানে ধর্মান্তর, ভাষা, উৎসব, এবং সংস্কৃতির আদান-প্রদান শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলেছে। রাজবংশী, জাঠ, মেও, ম্যাপিলা, ভিল, গাড্ডি, কুনবি—এই সব নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে একই জাতিসত্তার নানা রূপ। তাদের ধর্ম পালন হয়তো আলাদা, কিন্তু তাদের গান, নাচ, খাদ্যাভ্যাস, কৃষি-বাণিজ্য, এমনকি পূর্বপুরুষের সাধনা একই সূত্রে গাঁথা।
যে সত্য ইতিহাস চেয়ে যায়:
ধর্মান্তর কোনো “বহিরাগত আক্রমণ” নয়, বরং এটি সামাজিক প্রক্রিয়া। মধ্যযুগে সুফি-সন্তদের প্রভাবে, ব্রিটিশ আমলে খ্রিষ্টান মিশনারীদের সেবায়, বা আধুনিক যুগে সামাজিক ন্যায়ের সন্ধানে মানুষ ধর্ম বদল করেছেন। কিন্তু এই পরিবর্তন তাদের জাতিগত সত্তাকে মুছে দেয়নি। যেমন:
কেরালার ম্যাপিলা মুসলমানরা আজও মাতৃভাষা মালয়ালমে রামায়ণ-মহাভারতের গান গায়।
রাজস্থানের মেও মুসলমানরা হোলিতে গুলাল ছোড়েন এবং দীপাবলিতে মোমবাতি জ্বালান।
অসমের দেসি মুসলমানরা বিহু উৎসবে ধূপধুনার সঙ্গে নামাজ পড়েন।
শোষণের চক্র ভাঙতে হবে:
শাসকগোষ্ঠী ও বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থে ধর্মকে অস্ত্র বানিয়ে এই ঐক্য ভাঙার চেষ্টা চলছে। আদিবাসী ভিলদের জমি দখল, জাঠ কৃষকদের ফসলের দাম ধ্বসানো, বা দেসি মুসলমানদের নাগরিকত্ব সংকট—এসবই অর্থনৈতিক শোষণের নীলনকশা। পাশাপাশি, গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে ইতিহাসের সত্যি ঢেকে “হিন্দু-মুসলমান” নামক কৃত্রিম বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে।
মুক্তির পথ কোনদিকে?
১. ইতিহাসের জ্ঞান: প্রতিটি সম্প্রদায়কে নিজের শেকড় চিনতে হবে। জানতে হবে, আজকের “মুসলমান” পূর্বপুরুষ হয়তো কালীপূজায় অংশ নিতেন, আর আজকের “হিন্দু” পূর্বপুরুষ হয়তো বৌদ্ধ স্তূপে প্রার্থনা করতেন।
২. অর্থনৈতিক ঐক্য: কৃষক-শ্রমিক-আদিবাসীদের সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। ধর্ম নয়, বরং শ্রেণীভিত্তিক সংগ্রামই পারে লড়াইয়ের ময়দান বদলে দিতে।
৩. সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ: লোকউৎসব, মেলা, যাত্রাপালার মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান-আদিবাসীদের যৌথ অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। যেমন:
পশ্চিমবঙ্গের গাজন উৎসব যেখানে শিব-মুসলমান পীরের মিলন ঘটে।
তামিলনাডুর উরুটি-পূর্ণামি যেখানে হিন্দু ও মুসলমান কৃষকরা একসাথে ফসল কাটেন।
চূড়ান্ত বার্তা:
“ধর্ম তোমার প্রান্তর, আমি আসি শুধু প্রেমের ডোরে”—কবি নজরুলের এই বাণী আজও প্রাসঙ্গিক। ভারতবর্ষের মুক্তি তখনই সম্ভব, যখন কৃষক তার জমির অধিকার ফিরে পাবে, শ্রমিক তার শ্রমের ন্যায্য মূল্য পাবে, আর আদিবাসী তার বন-নদীর ওপর কর্তৃত্ব রাখবে। ধর্মীয় পরিচয় নয়, বরং মাটির টান ও অর্থনৈতিক ন্যায়ই হোক আমাদের যুক্তির সূত্র।
যুদ্ধ আমাদের একার নয়:
বাংলার বাউল, পাঞ্জাবের সুফি, কেরালার তারা-মন্দিরের নকশা, অসমের নামঘর—সবাই সাক্ষী দেয় এই ভূখণ্ডের আত্মা কোনো একক ধর্মের নয়। আজকের দিনে আমাদের শপথ নিতে হবে:
*বিদেশি পুঁজির দালালদের প্রতিহত করব।
ধর্মের নামে রক্ত ঝরানো রাজনীতিকে না বলব।
শোষণের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়ব।
কারণ, “যে দেশে মানুষ্যে মানুষ্যে ভেদ নেই, সেই দেশই স্বর্গ।”—বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
** মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct