রাজ্যের ৭৭টি ওবিসি গোষ্ঠীকে কলকাতা হাইকোর্ট বাতিল করার পর সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য সরকার। সম্প্রতি রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে বলেছে আগামী তিন মাসের মধ্যে ওবিসি নিয়ে নতুন করে সমীক্ষা করার রিপোর্ট পেশ করবে তারা। উল্লেখ্য, কলকাতা হাইকোর্ট ওবিসি বাতিল মামলার রায়ে বলেছিল, নতুন করে ওবিসি সমীক্ষা করা নিয়ে বাধা নেই। তা নিয়ে ‘আপনজন’-কে অভিমত জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। তা তুলে ধরেছেন সাংবাদিক এম মেহেদি সানি।
ওবিসি বাতিল নিয়ে হাইকোর্টের রায় আসার পর পরই প্রোগ্রেসিভ ইন্টেলেকচুয়ালস অফ বেঙ্গল (PIB) রাজ্য সরকারের কাছে ওবিসি সমস্যা সমাধান করার জন্য আবেদন রেখেছিল। আইনের যথাবিহিত পদ্ধতি মেনে, দ্রুততার সাথে, উপযুক্ত সার্ভে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজের পশ্চাৎপদ অংশকে ওবিসি তালিকাভুক্ত করা সামাজিক ন্যায়কেই প্রতিষ্ঠা করে। এই মুহূর্তে ওবিসি ইস্যু নিয়ে সংখ্যালঘু সমাজে যথেষ্ট ক্ষোভ রয়েছে। রাজ্য সরকার যদি সদর্থকভাবে বাদ পড়ে যাওয়া এই সকল গোষ্ঠীকে পুনরায় ওবিসি তালিকায় ফিরিয়ে এনে এই সকল অনগ্রসর শ্রেণীর সামনে পুনরায় উচ্চশিক্ষা ও চাকরির সুযোগ উন্মুক্ত করে দেয় তাতে বাংলার সংখ্যালঘু সমাজে রাজ্য সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। পিআইবির তরফ থেকে সমগ্র বিষয়টির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা হচ্ছে।
মানাজাত আলী বিশ্বাস, সভাপতি, প্রগ্রেসিভ ইন্টেলেকচুয়াল অফ বেঙ্গল
ওবিসি যে বাতিল হয়েছে এক দিনে বাতিল হয়নি। কলকাতা হাইকোর্টে প্রায় এক যুগ প্রায় ধরে মামলা চলেছে। সে সময় যদি কলকাতা হাইকোর্টে সেই ধরনের উকিল দিয়ে যে সমস্ত ঘাটতি আছে সেগুলি পূরণ করে নিতেন তাহলে হয়তো এই দিন দেখতে হত না। কলকাতা হাইকোর্ট যখন বাতিল করেছে তখন একটা পয়েন্ট উল্লেখ করেছিল যে ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস-এর যে আইন আছে সেই অনুযায়ী সার্ভে হয়নি বলে বাদ দেওয়া হয়েছে। এতদিনও সময় লাগত না যদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রকৃত সমীক্ষা করে সত্যিই যাদের ওবিসি তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা তাদেরকে তালিকাভুক্ত করে দিত, তাহলে এতদিন সমাধান হয়ে যেত। আমি আশা করছি রাজ্য সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।
নওশাদ সিদ্দিকী, বিধায়ক, ভাঙড়
হাইকোর্ট যেটা বলেছিল যে, এটা নতুন করে হেয়ারিং করে সবারটা শুনতে হবে এবং পূর্ণাঙ্গ লিস্ট তৈরি করে তারপর কোটা ঠিক করতে হবে। এটা কলকাতা হাইকোর্টের অর্ডার ছিল। সুপ্রিম কোর্টে কেস চলছে, এখনো রায় পাওয়া যায়নি। বারবার হেয়ারিং হচ্ছে কখনো পিছিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু রেজাল্ট পাওয়া যাচ্ছে না। ওবিসি কোটা সমস্যার কারণে বহু নিয়োগও আটকে আছে। আমি এ ব্যাপারে বহু চেষ্টা করেছি, আমি রাজ্যের চিপ সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করেছিলাম, পিবি সেলিম সাহেবও ছিলেন, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সেক্রেটারিও ছিলেন, বিকল্প পদ্ধতিতে পুনরায় সমীক্ষা করে ওবিসি সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেনে ভালো লাগছে, মুখ্যমন্ত্রীও যখন বলেছেন তখন নিশ্চয়ই সমাধান হবে। সমীক্ষা হবে, ওপেন হেয়ারিং হবে, তারপর লিস্ট করা হবে।
হুমায়ুন কবির, বিধায়ক, ডেবরা
নতুন করে সমীক্ষা করার অর্থ এটাই মনে হচ্ছে রাজ্য সরকার কি বকলমে কলকাতা হাইকোর্টের অভিযোগকে মেনে নিল? যখন হাইকোর্টের অভিযোগ মেনেই নিল, তখন সুপ্রিম কোর্টে সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করার অর্থ কি রইল। হাইকোর্টের প্রধান দুটি অভিযোগ ছিল। একটি ছিল ধর্মের ভিত্তিতে, অন্যটি সার্ভে ঠিকঠাক হয়নি। যদিও হাইকোর্ট বলেছিল নতুন করে সার্ভে করায় কোনও বাধা নেই। হাইকোর্ট তার রায়ে যেহেতু বলেছিল, সমীক্ষা িঠকঠাক হয়নি, তাহলে বকলমে হাইকোর্টের রায়কে মেনে নিল। এতে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করার গুরুত্বটা কি কমে গেল না?
জিম নওয়াজ, সমাজকর্মী
সারা দেশ জুড়ে আদিবাসী দলিত খৃষ্টান ও ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজনের বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে আরএসএস-বিজেপি। দেশের সভ্যতা- সংস্কৃতি ও সংবিধান বিরোধী অপকর্ম তারা চালাতে পারছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও বিচারবিভাগের একাংশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে। লোকসভা নির্বাচনের সময় কলকাতা হাইকোর্টের ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিলের রায় যথেষ্ট সন্দেহজনক। এই রায় কার্যত মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট বিরোধী। এই রায় একই সঙ্গে অসংখ্য দরিদ্র মানুষ বিরোধীও বটে। মোদি-অমিত শাহ এবং তাদের প্রকাশ্য ও গোপন বন্ধুদের বাংলার মানুষ পরাজিত করবেই।
ছোটন দাস সাধারণ সম্পাদক, বন্দি মুক্তি কমিটি
সংরক্ষণের সুবিধা নিয়ে মুসলমান ছেলেমেয়েরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার,হাকিম মোক্তার হবে - অসম্ভব। শুরু হয় চক্রান্ত। চক্রান্তকারী কে বা কারা তা নিয়েও খুব একটা গবেষণার দরকার নেই। এখন কোর্টের অধীনস্থ একটি বিষযের ওপর আবার নতুন করে সমীক্ষা করা হবে। সামনে ভোট, এটা মন ভোলানো প্রক্রিয়া কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তবে সম্ভাবনা প্রবল এটুকু বলতে পারি। বেশি কিছু আশা না করে দেখা যাক কি হয়!!
মুজিবর রহমান, তথ্যচিত্র পরিচালক
ভারতের প্রায় সব রাজ্যেই ওবিসি মানুষের সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের অনেক বেশি। সেটা নিশ্চয় মুখের কথায় নয়। সবটাই তথ্য ভিত্তিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ওবিসি সংখ্যা যথেষ্ট জটিল। কারণ, রাজ্যে এমন অনেক ওবিসি মানুষ আছেন, হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র নেতারা যাদের জেনারেল ক্যাটাগরিতে ঢুকিয়ে রেখেছে সংবিধান প্রকাশের পরে থেকেই। ফলত, এই ধরনের মানুষ গুলো মনে করেন তাঁরা বুঝি সমাজের উচ্চ জাতির। বলতে দ্বিধা নেই, জাতি গণনা ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তারাই সব চেয়ে বড় বাধা। রাজনৈতিক ও গণ সংগঠনের নেতারা সেই সমস্ত মানুষদের কোনোদিন সচেতন করেনি। ফলে জাতি গণনার ক্ষেত্রে অন্য রাজ্যের পিছিয়ে পড়া বা ওবিসি মানুষের সংখ্যা সঠিক ভাবে নির্ণয় করা গেলেও বাংলায় সেটা হওয়া মুশকিল। অথচ অতি গুরুত্বপুর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয় এটা। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।
রাজ্যে মাহিষ্য জাতির মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। বাস্তবে এরা কৈবর্ত সম্প্রদায়। কৈবর্ত দু ধরনের। হেলে অর্থাৎ চাষী কৈবর্ত আর জেলে কৈবর্ত। জেলেরা সিডুল কাস্ট। আর চাষীরা ওবিসি। সরকারি খাতায় কোটি কোটি চাষি কৈবর্ত এর মধ্যে ওবিসি সার্টিফিকেট হোল্ডারের সংখ্যা এক লাখ ও নয়। ফলত, রাজ্যে নতুন করে ওবিসি সমীক্ষা হলেও সঠিক তথ্য উঠে আসবে না। তাই গণহারে ওবিসি সার্টিফিকেট অর্জন করা বা করিয়ে দেওয়া সব চেয়ে বেশি জরুরি।
মানিক ফকির, লেখক ও গবেষক
সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর উপর সমীক্ষার বিষয়টি মিথ্যা ও প্রতারণামূলক বলে মনে হচ্ছে। যার লক্ষ্য হল অসহায় সংখ্যালঘুদের বোকা বানানো। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সামনে আইনগত বিষয় এবং সাংবিধানিক কাঠামোর উপর যুক্তি উপস্থাপনে ব্যর্থতার পরোক্ষ স্বীকারোক্তির পাশাপাশি সরকারের সদিচ্ছা এবং ইচ্ছাশক্তির অভাবের কারণে সমীক্ষার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে।
মোতাহার হোসেন, আইনজীবী
গত বছর ৫ই আগস্ট সুপ্রিম কোর্টে প্রথম ওবিসি মামলা উঠলো, আর তখন রাজ্য সরকার কেনই বা বলল না যে তিন থেকে পাঁচ মাস সময় দিন তাহলে সমাধান করে দেবো। আসলে ওবিসি সমস্যা সমাধানের নামে রাজ্যের শিক্ষিত যুব সমাজের ধোকা দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। তিন মাস পরে হয়তো বলবে হুজুর আরও তিন মাস সময় দিন, তারপর পুজোর ছুটি আর তারপর ভোটের নোটিফিকেশন, এই ভাবেই শিক্ষিত সমাজকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিতে চান।
কামাল হোসেন, শিক্ষাবিদ
ওবিসি নিয়ে রাজ্য সরকার যে পদক্ষেপ গুলো নিয়েছিল সেটা উন্নতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছিল রাজ্য সরকারের যে সব থেকে বড় ভূমিকায় এখানে যে সকলের জন্য সমান সুযোগ বলতে সকলে তো সমান নয়। ফলে যারা পিছিয়ে আছে তাদের বেশি সুযোগ দিয়ে যাতে সমাজে একটি সমতা আনা যায় সেই চেষ্টা রাজ্য সরকার করেছিল। সেক্ষেত্রে যে পদ্ধতিগত ত্রুটি হয়েছে বলে অভিযোগ গুলো হয়েছে সেইখানে কিন্তু কোট এখনো পর্যন্ত রাজ্য সরকারের যে নিয়োগ বা যে নিয়োগ গুলো হয়েছে তাকে বাতিল করে দেয়নি। রাজ্য সরকারকে রিভিউ করতে বলেছে নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জানতে চেয়েছে এবং রাজ্য সরকার সেটা করতে চেয়েছে। এর ফলে যেটা হচ্ছে যে সরকারি দপ্তরে বড়সড় নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে যাচ্ছে রাজ্য সরকার চেষ্টা করেছিল নিয়োগ করার জন্য। আর সে কারণে কোর্টের ভৎসনা শুতে হয়েছে। ফলে রাজ্য সরকার যে নতুন করে সময় চেয়েছে কোর্টের কাছে সেটা একটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। রাজ্যসরকার যে ওবিসি সংরক্ষণের বিষয়টা সেটা ন্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবে এবং কোটও সেই ন্যায়ের দৃষ্টিতেই দেখবেন। যেহেতু কোর্টই সংবিধানের রক্ষাকর্তা ফলে রাজ্য সরকার ন্যায়ের জন্যেই যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে আশা করা যায় কোর্টও তা আর বাতিল করবে না।
প্রদীপ্ত মুখার্জি, অধ্যাপক
দেশে-বিদেশে ইসলাম বিদ্বেষের শিল্পায়ন হয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের রায় তার প্রমান। এই রায় বাতিল করা উচিত। ওবিসি শব্দের পুরোটা হলো আদার ব্যাকওয়ার্ড কমিউনিটি, আদার ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট নয়। হিটলারের শাসন ১৫ বছরও স্থায়ী হয়নি, মনুবাদী আরএসএস-বিজেপির ঘৃণা বিদ্বেষের (যা আসলে গরিব বিদ্বেষ) শাসনও দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
ভানু সরকার, মানবাধিকার কর্মী
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওবিসি সংক্রান্ত নতুন সমীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে। তবে, এই সমীক্ষাটি আরও যথাযথ ও স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন যাতে কোনও গোষ্ঠী বিশেষ করে সংখ্যালঘু মুসলিমরা অবহেলিত না হয়। অতীতের ভুল এড়িয়ে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দ্রুত তথ্য সংগ্রহ করাই সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
মহম্মদ মফিজুল ইসলাম, কবি ও প্রাবন্ধিক
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct