মোঃ সাহিদুল ইসলাম ও নাজমুন নাহার: চলুন, এই প্রতিবেদনটি একটু ব্যক্তিগত কথপোকথন দিয়ে শুরু করা যাক। আমি আর আমার স্ত্রী নাজ, দুজনেই প্রতি দিনের ন্যায় আজও সারাদিনের কাজ কর্ম সেরে ঠিক বিকাল ৪.৫০ মিনিটে মাটির ভাড়ে দু কাপ চা নিয়ে বহরমপুর KN কলেজের (বর্তমান মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়) সামনে গঙ্গা নদীর ঘাটের তিন নম্বর সিঁড়িতে বসলাম। আমাদের সাথে দেখি ডুবন্ত সূর্য্যটাও তার ক্ষীণ কীরণ দিয়ে আমাদের চায়ের কাপে এসে চুমুক দিয়ে আজকের মতো অস্ত যাবে।
চা খেতে খেতে নাজ বললো ‘আজকে সূর্য্যটা দেখো কি সুন্দর লাগছে”। সত্যি তো, “তবে তুমি আজকে সূর্য্যের বিকিরণে বর্ণালী হয়ে গেছো” আমি একটু মুচকি হেসে বললাম। চায়ে দ্বিতীয় চুমুক দিতেই দেখি ওপারের যাত্রী বোঝাই নৌকাটি টলতে টলতে এসে ঘাটে পোঁছালো। আমাদের আশপাশে দেখি আরো কত মানুষজন, কত প্রেমিক-প্রেমিকা, গঙ্গা নদীর ধারে বসে সবাই বেশ খুব সুন্দর সময়টা উপভোগ করছে। চারপাশ জুড়ে কতই না ছোট ছোট সান্ধ্য ভোজ নের দোকান গুলি ফুচকা , মোমস , ইত্যাদি পাল্লা দিয়ে বিক্রি করছে। আমাদের হাতের চা শেষ হতে না হতেই, নাজ ভাবুকসুরে বললো “সত্যি, গঙ্গা নদীটা বহরমপুরের সোন্দর্য্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে, দেখো , কত সুন্দর কত মানুষ একসঙ্গে এখানে বসে খুব সুন্দর উপভোগ করছে, সেই সাথে কত মানুষের জীবন জীবিকার কেন্দ্রস্থল হয়েছে”।
চা খাওয়ার পরে ভাড় টি ফেলতেই যেন হাত কিরকম খালি খালি লাগছে। বুঝলাম, আমাদের নিত্য সঙ্গী সময়-খাদক মোবাইল হাতে নেই। পকেট থেকে বের করতেই নাজ বলে উঠলো “ আবার সেই মোবাইল হাতে” ! আমি কিছু না বলে, মোবাইলটা চালাতে শুরু করলাম। ফেসবুক খুলতেই দেখি “ গঙ্গা নদীর তীরে একটা বাড়ি তলিয়ে গেলো “ একটা রীল । ভিডিওটা দেখে আমরা দুজনেই ২ মিনিটের জন্যে একটু স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হঠাৎ নাজ বলে উঠলো, “ সূর্য্যাস্তের আলাপে গঙ্গা নদীটি বহরমপুরে হাজারো মানুষের চোখের সামনে দিয়ে আনন্দে বয়ে চলেছে কিন্তু সেই সঙ্গে কত পরিবার কে বেঘর করছে “ । আর এখান থেকেই জন্ম নিল আমাদের এই প্রতিবেদনটি।
আমি একটু ইতস্ততঃ হয়ে বললাম, ভাঙা গড়ার দুনিয়া, এক দিকে ভাঙবে আরেক দিকে গড়বে। এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। নাজ আমার দিকে একটু তাকিয়ে বললো “আচ্ছা, কিন্তু একবার ভেবে দেখেছো, যাদের ঘর-বাড়ি তলিয়ে গেছে, তাদের কি অবস্থা, তারা কারা ? কোথায় তাদের ঠাঁই হবে।”
মাথা নাড়িয়ে আমি বললাম, সে তুমি ঠিক বলেছো। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে, নাজ কিছু যেন একটা সার্চ করতে লাগলো। হঠাৎ একটু উচ্চস্বরে বলে উঠলো, দেখো, স্পেফার ইন্ডিয়া সংস্থার কিছু তথ্য (২৯ অক্টোবর, ২০২৪) : আমাদের জেলা মুর্শিদাবাদের দুটি ব্লক সামসেরগঞ্জ ও লালগোলা র মোট ১৩ টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্থ, যেখানে সামসেরগঞ্জের ৬০ টি বাড়ি ও ২৫ টি লালগোলার খুব মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। ওই দুটি ব্লক থেকে প্রায় ৯০০ মানুষের জীবন অনিশ্চিত ভাবে কাটছে। তারপরিবর্তে কি পেয়েছে তারা ? কিছু ত্রিপল, তৎকালীন কিছু খাদ্যদ্রব ? এটাই কি যথেষ্ট ? নাজ বললো এটা যে হঠাৎ করে ঘটছে তা নয়। আমাদের জেলার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা দপ্তর কিন্তু 2020-21 সালেই ,সমসেরগঞ্জ ব্লকের গ্রামে 65 হাজারের বেশি পরিবার বন্যা, জলাবদ্ধতা এবং ভাঙনের ঝুঁকিতে চিহ্নিত করেছিল। ‘তুমিই বলো তাহলে,’ এর কোনো সুদূরপ্রসারী সরকারি ভাবে পদক্ষেপ -পরিকল্পনা গ্রহণ হয়েছে?
আমি নম্রসুরে বললাম, জানো ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ‘নামামী-গাঙ্গে’ নামে একটা প্রকল্প শুরু করেছিল যেখানে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। গঙ্গা নদী ও পারিপার্শ্বিক এলাকা উন্নয়ন এর স্বার্থে। নাজু জিজ্ঞেস করলো, কতটা উন্নতি হয়েছে তার কোনো বার্ষিক রিপোর্ট আছে ? আমি কিছু না বলে চুপ থাকলাম। তারপরে সে বললো , দেখো, নামামী গাঙ্গে প্রকল্পের যে উদ্দেশ্য সেগুলো তো দারুন, কিন্তু গঙ্গা নদীর ধারে যেসব মানুষ বসবাস করে তাদের জন্যে কি কোনো স্পেশাল প্রকল্প বা অর্থ-বরাদ্দ আছে ? ঠিক এখানেই আমার প্রশ্ন। যেখানে মানুষ বেঘর হচ্ছে, কতই না কচি-কাঁচা শিশুরা ঘর ছাড়া মায়ের কোলে থাকছে, তাদের কেমন শৈশব ? ভবিষৎ কোন দিকে ? এ কেমন উন্নয়ন ?
আমাদের এই গঙ্গা শুধু একটা নদী নয়, বরং কোটি কোটি মানুষের দেবী মাতা , পবিত্র গঙ্গা,। ভারত বর্ষের ঐতিহ্য, সবথেকে দীর্ঘতম নদী (২৫২৫ km), উত্তরাখণ্ডের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে চারটি রাজ্যের বুকের ভিতর দিয়ে ক্রমাগত নিজ গতিতে চলে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হচ্ছে। নাজ জিজ্ঞাসু স্বরে বললো , গঙ্গা নদীর গতিপথ সম্পর্কে খুব সুন্দর করে যেকোনো ক্লাসের পাঠ্য-বই গুলিতে আলোচনা করা হয়, কিন্তু আমার মনে হয়, সেই সাথে সাথে বর্তমান পরিস্থিতিকে ভিত্তি করে মানুষের ক্রিয়াকর্মের দ্বারা গঙ্গা নদীকে যে ধ্বংসাত্নক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে তার ওপর বেশি জোর দেয়া উচিত। ব্যাপারটা আমার মাথার ওপর দিয়ে গেলো “মানুষের ক্রিয়াকর্ম”! নাজ বললো দেখো, শিল্পায়ন ও বিশ্বায়নের যুগে যে জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে, তাতে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেড়েছে, আর এই ভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরো বাড়বে তাপমাত্রা । কতই না হিমবাহ গলে যাবে , জলপৃষ্ট বেড়ে যাবে। এর ফলে কতই না ঘর বাড়ি তলিয়ে যাবে। কৃষিজমি জলমগ্ন হয়ে যাবে। ভাবতে পারছো ? শুধু অজয় নদীতেই বন্যা আসবে না, আসবে সমস্ত নদী থেকে।
আমি একটু চুপ থেকে বললাম , একটু ভেবে দেখো, আমাদের গঙ্গা নদী , জলপথ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, মৎস্য শিল্প গড়ে উঠছে, নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করে জল শুদ্ধ করে আমাদের পানীয় জলের চাহিদা মেটাচ্ছে। নাজ বললো , সে তো ঠিক, কিন্তু একটু চিন্তা করে দেখো, এরকম চলতে থাকলে একদিন পুরা জনজীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। আচ্ছা, তুমি যদি গঙ্গা নদীর এই দিক গুলি যদি বলো , তাহলে আমায় উত্তর দাও আমাদের পশ্চিমবঙ্গের “হুগলি নদীর তীরে গড়ে ওঠা পাটশিল্প-কলকারখানা” সেগুলো আজকে কোথায় ? এর ফলস্বরূপ কিন্তু আমাদের মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ার কৃষকগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্থ।
আমি উচ্চস্বরে বললাম, তুমি কি জানো, আমাদের দিদি এবছর বাজেটে (FY 2025-26) “নদী বন্ধন” নামে একটা নতুন প্রকল্প শুরু করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়িত করবে এবং সেই সঙ্গে মুর্শিদাবাদ ও মালদা জেলার নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ করতে অনেক পদক্ষেপ নেবে। শুনে নাজ বললো “খুব খুশি হলাম”, দিদি নিশ্চই ভালো কিছু করবেন । আমাদের রাজ্যে প্রকল্পের তো অভাব নেই , কিন্তু সেগুলোর কার্যকারিতা ও ফলপ্রসূতা খুব কমই দেখা যাই। আমি একটু হতাশ সুরে বললাম, “ মনে হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার তুলনায় সরকারি প্রকল্পের সংখ্যা বেশি, এবং সেগুলো বেশ ঘটা করে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে” । যেমন, আজ প্রায় দুবছর ধরে আমাদের জেলা প্রশাসনকে আমাদের অঞ্চলের পানীয় জলের সমস্যা নিয়ে কতবার চিঠি দিয়েছি, তার কোনো সুরাহা নেই।
নাজ বললো, দিদি যখন আছে, নিশ্চয় কিছু করবেন, এত হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া আমাদের গণতান্ত্রিক দেশ। আমাদের সকল নাগরিক সমাজকে আরো বেশি করে সজাগ হতে হবে। সরকারি-প্রশাসন ব্যবস্থাকে আরো সক্রিয় হতে হবে ও সকল নাগরিককে এক হয়ে সরকার ও প্রশাসন বাবস্থাকে দায়বদ্ধ করতে হবে। আমি একটু মুচকি হেসে বললাম “মোদীজিও বলেছিলেন “আচ্ছে দিন আয়েগা” কিন্তু কবে আসবে সেটা তিনি বলেন নি।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct