সারিউল ইসলাম , মুর্শিদাবাদ, আপনজন: মূল ভূখণ্ডের মধ্যে অবস্থান করেও এ যেন এক বিচ্ছিন্ন গ্রাম। অ্যাম্বুলেন্স হোক বা যাত্রীবাহী গাড়ি, গ্রামে ঢুকতে পারেনা কোনোটাই। না, এই গ্রামটি কোনো চর এলাকারও নয়। মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলা এক ব্লকের মহিষাস্থলী গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনস্থ মাইলবাসা গ্রাম। মূল ভূখণ্ডের মধ্যে অবস্থান করলেও তা মূল ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন বলা যায়। একদিকে রেললাইন, অপরদিকে গোবরানালা বিল। বিলের উপর নেই কোনো স্থায়ী সেতু, এমনকি ঝুঁকি নিয়ে রেললাইন পারাপার করে এখানকার বাসিন্দারা। এর সাথে আরও প্রায় ১০ টি গ্রামের মানুষ রেললাইন পারাপার করে রাজ্য সড়কে পৌঁছায়। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও সেখানে প্রথমবারের মতো উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছেছে মাস দু’য়েক আগে। মহিষাস্থলি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সাব্বির আহমেদ বলেন, “এলাকাটি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকলেও সেখানে বহু চেষ্টার পর একটি ঢালাই রাস্তা করতে সক্ষম হয়েছি। এই প্রথম ওই পাড়ায় কোন উন্নয়ন পৌঁছাতে পেরেছি। আগামী দিনে সেখানকার জন্য আরও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।”
উল্লেখ্য, বিংশ শতকের শেষের দুই দশকে ভগবানগোলা ও আখরীগঞ্জ এলাকায় ভয়াবহ ভাঙন দেখা দেয়। সেই ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়েছিল বেশ কয়েকটি গ্রামের হাজার হাজার পরিবার। তাদের কেউ ভগবানগোলা রেল স্টেশন সংলগ্ন রেল কলোনি, কেউ মুর্শিদাবাদ শহরের এস্টেটের জায়গায়, আবার কেউ বিচ্ছিন্ন কোনো এলাকায় নিজেদের ঠিকানা তৈরী করেন। আখরীগঞ্জের ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে মাইলের পর মাইল পথ অতিক্রম করে এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ প্রকৃতির অঞ্চলটি তে বাসা বেঁধেছিলো অসংখ্য পরিবার। তাই লোকমুখে এই গ্রামটির নাম হয় মাইলবাসা। এই গ্রামটি বা পাড়াটি মহিষাস্থলী গ্রাম পঞ্চায়েতের বলরামপুর-টুলটুলিপাড়া বুথের একটি অংশ। এই বুথে কয়েকশো পরিবারের বসবাস। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার ঘাটতি এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থাকে পিছিয়ে রেখেছে। স্থানীয় বাসিন্দা আমিরুল রহমান বলেন, “গত তিরিশ বছর থেকে বসবাস করছি আমরা, কিন্তু এখানে আজ অব্দি উন্নয়ন দেখতে পাইনি। এই প্রথমবার গত ডিসেম্বর মাসে একটা ঢালাই রাস্তা তৈরি করেছে পঞ্চায়েত।” অপর বাসিন্দা আইনাল হক বলেন, “আমাদের পাড়ায় কোন পানীয় জলের সংযোগ নেই, না আছে কোনো আলোর ব্যবস্থা। রাস্তা না থাকায় এম্বুলেন্স পর্যন্ত ঢুকতে পারে না এলাকায়। আধা কিলোমিটার হেঁটে রেললাইন পার করে তারপর রেললাইনের অন্য প্রান্তে এম্বুলেন্সে উঠতে হয়। স্থানীয় বিধায়ক এবং পঞ্চায়েত প্রধানকে সবটা জানিয়েছি।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ওই রেললাইন পার করে খুব সহজেই ১১ নম্বর লালগোলা-বহরমপুর রাজ্য সড়কে পৌঁছানো যায়। রেললাইন থেকে রাজ্য সড়কের দূরত্ব মাত্র ২০০ মিটার। ঝুঁকি নিয়ে রেললাইন পারাপার করা থেকে মুক্তি পেতে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, রেললাইনে একটি আন্ডারপাস করা হোক। তাহলে ওই গ্রামে এম্বুলেন্স সহ অন্যান্য গাড়ি ঢুকতে পারবে। অন্যদিকে গ্রামের পূর্ব দিকে রয়েছে গোবরানালা। রেল আন্ডারপাস এবং গোবরানালার উপর একটি সেতু নির্মাণ করা হলে প্রায় ১৫ টি গ্রামের মানুষ উপকৃত হবেন। এবিষয়ে প্রধান সাব্বির আহমেদ বলেন, “রেল দপ্তরকে বিষয়টি জানাতে বিধায়ক সাহেব উদ্যোগী হয়েছেন। এখানে একটি রেল আন্ডারপাস করার জন্য রেল কে চিঠি করবেন তিনি। পাশাপাশি সেতু নির্মাণের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।” ভগবানগোলার বিধায়ক রেয়াত হোসেন সরকার বলেন, “এলাকাটি মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরা সেখানে যথাসাধ্য উন্নয়ন পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। মানুষের অভাব-অভিযোগ যা এসেছে বা বাসিন্দারা কি চাইছেন সবটা নির্দিষ্ট দপ্তরে সেই বিষয়ে কথা বলবো।”
রেল আন্ডারপাস এবং গোবরানালার উপর সেতু নির্মাণ হলে কেবলমাত্র মাইলবাসার মানুষ উপকৃত হবেন তাই নয়, বরং মহিষাস্থলী গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনস্থ ১৫ টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ উপকৃত হবেন। তাদের যাত্রাপথ প্রায় ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার কমে যাবে।
আদৌও কি সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে, নাকি এভাবেই সারাজীবন মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি দ্বীপে বসবাস করবে মাইলবাসার বাসিন্দারা, এখন সেটিই দেখার।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct