প্রাচ্যের মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যায় পাশ্চাত্যের উন্নতি দেখে। কিন্তু, তার তুলনা সেই মেধাবী ও দুরন্ত শিশুটির মতো, যে তরতর করে এগিয়ে তো যায় ঠিকই, তবে সেই যাত্রাপথে প্রচুর ভাঙচুরের চিহ্নও ছড়িয়ে থাকে। যুদ্ধ, উপনিবেশ, রক্তপিচ্ছিল ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন উন্নত পাশ্চাত্য যে রিক্ততায় সবসময় আর্তনাদ করেছে তা আত্মিক শুদ্ধতার আলো। রবীন্দ্রনাথের ‘পূর্ব ও পশ্চিম’, প্রমথ চৌধুরীর ‘আমরা ও তোমরা’ যদি পড়ি তাহলে আমরা প্রবল অন্তর্বিরোধপূর্ণ দুই মহাদেশীয় সভ্যতাকে স্বচ্ছভাবে বুঝতে পারব। লিখেছেন পাভেল আখতার।
আপনজন: প্রাচ্যের মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যায় পাশ্চাত্যের উন্নতি দেখে। কিন্তু, তার তুলনা সেই মেধাবী ও দুরন্ত শিশুটির মতো, যে তরতর করে এগিয়ে তো যায় ঠিকই, তবে সেই যাত্রাপথে প্রচুর ভাঙচুরের চিহ্নও ছড়িয়ে থাকে। যুদ্ধ, উপনিবেশ, রক্তপিচ্ছিল ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন উন্নত পাশ্চাত্য যে রিক্ততায় সবসময় আর্তনাদ করেছে তা আত্মিক শুদ্ধতার আলো। রবীন্দ্রনাথের ‘পূর্ব ও পশ্চিম’, প্রমথ চৌধুরীর ‘আমরা ও তোমরা’ যদি পড়ি তাহলে আমরা প্রবল অন্তর্বিরোধপূর্ণ দুই মহাদেশীয় সভ্যতাকে স্বচ্ছভাবে বুঝতে পারব। বিবেকানন্দের ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ও পাঠ্য। আত্মার অন্বেষায় মগ্নপথিক রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যকে অভিভূত করলেন ‘গীতাঞ্জলি’র কোন্ মোহন মূর্ছনায়? আর, শাশ্বত বুদ্ধ; সত্য, ত্যাগ, অহিংসা, ভালবাসা যার ধমনীতে প্রবাহিত রক্তধারাকে ‘পবিত্র’ করেছিল। তিনিও তো সেই প্রাচ্যেরই ‘নরম মাটিতে’ জন্ম নিয়েছিলেন ও বিকশিত হয়েছিলেন। বোধিপ্রাপ্ত বুদ্ধ, যিনি সিদ্ধার্থ, তাঁকে সুদূর জার্মানিতে বসে ‘আবিষ্কার’ করছেন হেরমান হেসে; যে জার্মানি যুদ্ধের বীভৎসতাকে চিনিয়েছে! সমাজ ও সভ্যতার কাছে কথাশিল্পীর ‘দায়’ থাকে। জীবনকে তার ঈপ্সিত আদি, স্বচ্ছ আলোর কাছে নিয়ে যাওয়া, ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ার পরশ দেওয়া। আত্মার অমল শুভ্রতা চেনানো। মূলত আত্ম-অবলোকনের আলোয় আর সেইসব দাবির প্রণোদনাতেই হয়তো হেসে রচনা করলেন তাঁর অমর সৃষ্টি--’সিদ্ধার্থ : আইনে ইন্ডিশে ডিশটুঙ্গ’!
সত্য, অহিংসা, ত্যাগ, ক্ষমা, ভালবাসার সঙ্গে গ্রথিত আরেকটি শাশ্বত নাম যীশু খ্রিস্ট। বড়দিন উদযাপনের বাহ্যিক আনন্দধারায় ভেসে যেতে দেখা যায় তাঁর মহার্ঘ জীবন ও অমিয় বচনের স্মরণ ও শীলনের গুরুত্ব! কবে আমরা আত্মস্থ করব যীশুর জীবনবোধ? আমাদের দৈনন্দিন জীবনচর্যায় তাঁর শিক্ষার নির্যাসকে কবে প্রতিফলিত করব? যুদ্ধদগ্ধ, হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে জাতি-ধর্ম-বর্ণের প্রশ্নে যে অর্থহীন ক্রমবর্ধমান ঘৃণা ও ক্রোধের পরিমণ্ডলে আমরা ক্রমাগত আবর্তিত হচ্ছি, তার নিরিখে সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্যে নিজেদেরকে এই আত্মসমীক্ষার সামনে যদি দাঁড় না করাতে পারি তাহলে ধরে নিতে হবে যে, রবীন্দ্রনাথের কথাই সত্য---’’তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি...!’’ মুশকিল হচ্ছে, হিংসা মানুষের প্রবৃত্তির অন্তর্গত আর অহিংসা একটি অনুশীলননির্ভর চর্যা। এবং, সেই অভিপ্রেত চর্যায় আমাদের অনাস্থা প্রবল বলেই গাজার শিশুদের শিয়রে মৃত্যু বসে থাকে, যীশু নয়!
জনৈক রাজপুরুষ বনে শিকারে বেরিয়েছেন। তার বন্দুক থেকে নির্গত গুলির শব্দে প্রাণভয়ে ভীত একটা বাঘ ছুটছে, আর রাজপুরুষটিও তার পেছনে ছুটছেন। একসময় বাঘটা বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। ক্লান্ত রাজপুরুষটি শিথিল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূর থেকে হঠাৎ একটি বিরল দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়লেন! তিনি দেখলেন, ভীতচকিত বাঘটা গাছের তলায় এক সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে বসে আছে, আর সন্ন্যাসী তার গায়ে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন! কিছুক্ষণ পর বাঘটা চলে যেতে রাজপুরুষটি কাছে এসে সন্ন্যাসীকে এই ‘অসম্ভব’ কেমন করে সম্ভব হ’ল তার কারণ জানতে চাইলেন। মৃদু হেসে মিতবাক সন্ন্যাসী বললেন, ‘মন থেকে হিংসা দূর করো, তাহলে তোমার কাছেও হিংস্র প্রাণী বশ মানবে।’ সন্ন্যাসীটি হলেন তৈলঙ্গ স্বামী।
একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে, আমাদের স্বরচিত লৌকিক ও অলৌকিকের ‘ভূত’ লুকিয়ে আছে আমাদেরই মনের অভ্যন্তরে। রাজপুরুষের মনে হিংসা ছিল বলেই তিনি পূর্বে অহিংসার মহিমা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু, বুঝলেন প্রত্যক্ষতায়। এটা গুরুত্বপূর্ণ। মুশকিল হচ্ছে, প্রত্যক্ষতার বাইরে যতক্ষণ কেউ থাকে ততক্ষণ ‘অহিংসা’ তার কাছে অলীক মনে হয়। কিন্তু, আসলেই কি তা অলীক? বিষয়টা হচ্ছে, একটি রিপুর কাছে যখন আমরা ধরাশায়ী হই তখনই আবার তার স্বাভাবিকতার তত্ত্ব-ও অবলীলায় খাড়া করি। স্বভাব থেকেই স্বাভাবিকতা। কিন্তু, ‘স্বভাব’ অপরিবর্তনীয় বস্তু নয়। নইলে হিংসার বিপরীতে অহিংসার জয়ধ্বজা ওড়ানো কি সম্ভব হ’ত? পৃথিবী শান্ত, স্নিগ্ধ হতে পারে ‘অহিংসা’র দ্বারা। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গান্ধীজির ‘অহিংসা’র বিশেষ তাৎপর্য ছিল। ‘অহিংসা’ দীপ্তিময়।
হিংসার লালন সবসময়ই দুর্বলের উপর পীড়ন হয়ে নেমে আসে। আর, সেটা যাদের কাছে একধরনের আনন্দের উপাদান তারা ‘অহিংসার সৌন্দর্য’ বুঝতে বা মানতে অক্ষম। হিংসাকে হিংসা দিয়ে জয় করা যায় না। ঘৃণাকে ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না। কথাগুলো ঠিকই। কিন্তু, যে হিংসা ও ঘৃণার পূজারী, সে যেমন, তেমনই পাল্টা হিংসা ও ঘৃণার পথযাত্রী, কেউই ‘অহিংসার মহিমা’ সম্পর্কে সচেতন নয়; ‘অনুশীলন’ তো অনেক পরের বিষয়! গান্ধীজি বর্ণিত ‘অহিংসা’র সঙ্গে অহিংস আন্দোলনকে মিশিয়ে ফেলা অযৌক্তিক। অহিংসা একটি জীবনবোধ, যার ব্যাপ্তি অপরিসীম।অহিংসার মানেই বোঝে না অধিকাংশ মানুষ। গান্ধীজি অহিংসার সঙ্গে সঙ্গে সত্য, ন্যায় ও প্রেম-এর কথাও বলেছিলেন। আসলে তিনি তো নতুন কিছু বলেননিও! তিনি উচ্চারণ করেছিলেন যুগ-যুগান্তরের আরাধ্য শাশ্বত সত্য!
সামাজিক শ্রেণিদ্বন্দ্বের অবসানকল্পে যে-ধরনের বৌদ্ধিক চর্চা হয়ে থাকে, খেয়াল করলে দেখা যাবে, সেগুলির মধ্যে প্রতিস্পর্ধিতার একটা চোরা স্রোত বহমান। প্রান্তিক শ্রেণির যে দুরবস্থা সেটা সবসময় উচ্চশ্রেণির শোষণ, অবহেলা ও বঞ্চনার পরিণাম নয়। আরও বহু কারণ আছে। গভীর, অন্তহীন আলস্য, জড়ত্ব তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু, এই আত্মদর্শনের দিকে সচরাচর দৃষ্টিনিক্ষেপ করা হয় না। একটা সরলরৈখিক আখ্যানই নিশিদিন ধ্বনিত হতে থাকে। সেটা পরিকল্পিত ঘৃণার পাঁক দিয়ে ঘিরে রাখার বা ঘিরে ফেলার একমাত্রিক ও কিছুটা অনৈতিহাসিক আখ্যান। এর অনিবার্য ফল হচ্ছে, শেষপর্যন্ত দ্বন্দ্বের চিরস্থায়ী অবসান অধরা হতে বাধ্য। কারণ, এই প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক গোষ্ঠীর উত্থান কল্পিত হয় ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যেও সুপ্ত থাকে শ্রেণিঘৃণা। ফলে, সামাজিক শ্রেণিদ্বন্দ্বের কাঠামোগত সম্ভাব্য বদল হলেও তার হাত থেকে নিষ্কৃতি আর মেলে না! এখানেই গান্ধীজির ‘অহিংসা’ আদর্শটির কালজয়ী প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব। ‘অহিংসা’ ব্যক্তিমানস বা সমাজমানসকে সংশোধনের একটি প্রকল্প বা প্রক্রিয়া। এখানে ব্যক্তি বা সমষ্টি ঘৃণার আধার নয়, বরং তার পঙ্কিল কর্মটিই কেবল ঘৃণ্য। এবং, সেটা সংশোধিত হতে পারে অহিংসার মাধ্যমে। কিন্তু, প্রতিশোধস্পৃহা বা প্রতিস্পর্ধিতার ভিতরে অহিংসার উপাদান অনুপস্থিত থাকে; তা পাল্টা ঘৃণার বর্ম দিয়ে আচ্ছাদিত। এভাবে কাম্য দ্বন্দ্বের অবসান আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র!
১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারিতে গান্ধীজির জীবন-প্রদীপ নিভে যাওয়ার ঘটনাটি আজকের ভারতের সাপেক্ষে যেন বড্ড প্রতীকী! ক্রমাগত দুর্বলের উপর সবলের পীড়ন এবং জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন বিপন্ন করে তোলার মূলে যে একরৈখিক জাতিগত আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় তাকে মূর্ত করে তুলছে প্রেমহীন অনিয়ন্ত্রিত হিংসার পথ অবলম্বন করা; হয়তো গভীর ব্যঞ্জনায় একথা বলা যায় যে, মহাত্মার জীবনাবসানের মাধ্যমে সেদিনই অহিংসার মৃত্যু ও হিংসার বীজ বপন শুরু হয়েছিল! নানক, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির ভারতে ‘নবতর ভারত’ নির্মাণের যে ক্রীড়া শুরু হয়েছে তা আমাদেরকে সারা বিশ্বের কাছে কীভাবে পরিচিত করাবে সেই ভাবনারও ক্রমবিলুপ্তি খুবই মর্মান্তিক !
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct