শংকর সাহা: দেখতে দেখতে প্রায় তিনবছর হয়ে গেল দেশ ও পরিবার ছেড়ে আসা। সেই অপরিচিত কলকাতা শহরটি আজ যেন ওসমানের কাছে ধীরে ধীরে চেনাশহর হয়ে উঠেছে। শুধু শহর কলকাতা না আজ সে যেন গাঙ্গুলী বাড়ির এক সদস্যও হয়ে উঠেছে। সে রাতের কথা ওসমান আজও ভোলেনি। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গাঙ্গুলী বাড়ির সামনে পড়েছিল সে।তখন গাঙ্গুলী বাড়ির সদস্যরাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে শুশ্রূষা করায় আর তখন থেকেই গাঙ্গুলী বাড়ির নীচ তলার ঘরটা যেন ওসমানের অচেনা শহরে মাথা গোঁজার একটি আশ্রয় হয়ে উঠে।
প্রতিবার ঈদের সময় নিজের দেশের বাড়িতে যায় সে। কিন্তু এবারে লকডাউনের জেরে সে বাড়িতেও যেতে পারেনি। প্রতিদিন সকাল হলে স্নান করে কিছু মুখে দিয়ে ফেরি করতে বেরিয়ে যায় বিভিন্ন অলিগলিতে। এবাড়ির প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে প্রায় মিশে গছে ওসমান। গাঙ্গুলী বাড়ির ছোটো সদস্য তন্নির খেলার সাথী হয়ে উঠেছে ওসমান । তন্নিকে সে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করে । সেদিন ছিল সোমবার ঈদের দিন। ওসমানের জন্যে সবরকম ব্যবস্থা করে গাঙ্গুলী বাড়ির লোকরা। তারজন্যে নতুন পোষাক,মিস্টি,সেমাইয়ের পায়েস বানিয়ে রাখে ।ওসমান মসজিদে যায় নামাজ পড়তে।
ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় সকাল পেরিয়ে গেছে। হঠাৎই পাড়ার এক ছেলে এসে খবর দেয় রাস্তায় দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে মোহিত। মোহিত গাঙ্গুলী বাড়ির ছেলে,তন্নির বাবা। সবাই মিলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। খবর শোনামাত্র সবাই ছুটে যায় হাসপাতালে। মসজিদে খবর যায় ওসমানের কাছে। সেও ছুটে যায় হাসপাতালে। ডাক্তারবাবুরা জানান প্রচুর রক্ত লাগবে।কিন্তু রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ যা সচরাচর পাওয়া যায়না। এদিকে ওসমানের রক্তের গ্রুপও ও নেগেটিভ। সে রক্ত দিতে চায় বলে ডাক্তারদের সাথে কথা বলে।
ওসমানের রক্ত পাবার পর মোহিতের অপারেশন করেন ডাক্তারবাবুরা। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে আসে মোহিতের। মাথার ছোট লাগলেও সবাইকে চিনতে পারে মোহিত। দূরে তখন দাঁড়িয়ে ওসমান। তন্নি বাবার কাছে গিয়ে বলে,” জানতো বাবা,ওসমান কাকু তোমায় রক্ত দিয়েছে?“
ওসমানের দিকে চেয়ে মোহিত ক্ষীণস্বরে তাকে ডাকে,” কি রে ওসমান দূরেই দাঁড়িয়ে থাকবি,কাছে আয় ওসমান?”
ওসমান ধীরে ধীরে মোহিতের কাছে যায়। ওসমানের হাতটি শক্ত করে ধরে মোহিত বলে,” জানিস ওসমান, ছোটবেলায় আমার ভাই ছিলনা বলে খুব কাঁদতাম। কিন্তু আজ জানলাম তুইই আমার ভাই। আজকে ঈদের দিনে তুই যেভাবে রক্ত দিয়ে আমায় বাঁচালি কোনোদিনই ভুলবো নারে !”
ওসমান নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে থাকে মোহিতের দিকে। চোখে যে তার জল বেয়ে পড়ছে। হঠাতই পশ্চিম পাড়ার মসজিদ থেকে নামাজের সুর ভেসে আসে..
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct