তন্ময় সিংহ: আমেরিকার নির্বাচনে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার বিজয়ী হলেন, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রণাঙ্গনে নিহত ও আহত মানুষদের আর্তনাদ আরো ভয়ংকর রূপ নেয় কারণ সকলেরই মনে হয়েছিল যুদ্ধাকাঙ্ক্ষী ট্রাম্প হয়তো আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি কে আরো বেশি করে বিশ্বে শাসন কায়েমের লক্ষ্যে এই রণাঙ্গন গুলিতে সহায়তা বাড়িয়ে দেবে। তারপর দুইমাসের এই নির্বাচন পরবর্তী মধ্যকালীন সময়ে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং রণাঙ্গন গুলিতে আপাত স্থিতিশীলতা মানুষের মনে সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণার উদ্রেক ঘটিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথের পূর্ববর্তী ভাবনা তাকে নতুন চোখে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।
আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পের একক সাফল্যের পর বিশ্বজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ইউরোপের সংস্থা “ঈসিএফআর” এর সার্ভে অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের আসার পরে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এই আশাবাদ বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে দেখা গেছে। ভারত ,চীন, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব,রাশিয়ার মতো দেশের মানুষেরা ট্রাম্পকে স্বাগত জানিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া, ইংল্যান্ডের মানুষ যেখানে ট্রাম্প ফিরে আসা হতাশ হয়েছেন, সেখানে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউক্রেনের মানুষ ট্রাম্পের মাধ্যমেই শান্তি দেখছেন। ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ইউক্রেনে শান্তি এনে দেবো নির্বাচন চলাকালীন ট্রাম্পের দেওয়া এই প্রতিশ্রুতি , শপথ নেওয়ার আগেই যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজাতে সাময়িক শান্তি এনে দেওয়ার মতো সাফল্য লাভ করে কিনা তার দিকে তাকিয়ে বিশ্ব। যদিও এই যুদ্ধের জন্য বিশ্বের মানুষ রাশিয়া ও ইউক্রেন কে সমান দায়ী করেছে ওই সার্ভেতে। এখন দেখার সবার স্বার্থ রক্ষা করে কিভাবে ট্রাম্প রক্ষা করেন তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ইউক্রেন কে নিয়ে।
৪৭ তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার আগেই, আমেরিকার মধ্যস্থতায় প্যালেস্টাইন ও ইজরায়েলের সাময়িক যুদ্ধ বিরতি নতুন বিদেশ নীতির ইঙ্গিত দেয়। পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন নির্বাচনে পরাজয়ের পরও প্রতিরক্ষা খাতে ঢালাও সাহায্য করে চলেছিলেন আমেরিকার সহযোদ্ধা হিসেবে রাশিয়ার সাথে লড়াই করা ইউক্রেন ও ইজরাইল কে। কিন্তু শপথ গ্রহণের ঠিক ৪৮ ঘন্টা আগে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে মানুষের প্রাণের উচ্ছ্বাস এবং নতুন করে ফিরে আসার জন্য প্যালেস্টাইন জুড়ে মানুষের আনন্দ অতি দক্ষিণপন্থী শাসক হিসেবে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও মানুষের চোখে সাময়িক নায়কের মর্যাদা দিয়েছে। দ্বিতীয় দফার রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিদেশ নীতিতে তিনি নতুন পথ নেবেন তা পরিষ্কার হয়ে গেছে পূর্ববর্তী কূটনৈতিক দের অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে বলায়। বাংলাদেশে আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে যেভাবে শেখ হাসিনাকে দেশচ্যুত করে এবং মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে এক অতি ধর্মীয় শাসক দলকে মসনদে বসিয়ে দেশের আভ্যন্তরীণ টালমাটাল অবস্থা তৈরি করেছে হয়তো তার বদল আমরা দেখতে পাব আগামী দিনে।
বিগত নির্বাচনে আমেরিকার সমস্ত স্তরেই নিরঙ্কুশ সাফল্য ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দ্বিতীয় দফা তে ওভাল হাউসে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা দেবে। জন্মসূত্রে আমেরিকান হলেই নাগরিকত্ব এই নীতি বাতিলের সিদ্ধান্ত সহ আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় এবং অভিবাসন নীতিতে কড়াকড়ি আনা হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রাথমিক পর্যায়ের আভ্যন্তরীণ সংস্কার গুলির মধ্যে অন্যতম হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আমেরিকার বিদেশ নীতির সাথে সাথে বাণিজ্য নীতিতে ও পরিবর্তন এবং আত্মকেন্দ্রিকতা র দিকে নিয়ে যাবে। চীনের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি বিশেষ ট্যাক্স এর জন্য বাড়বে আবার কানাডা, মেক্সিকো কে বানিজ্যে পঁচিশ শতাংশ লেভি এবং নিজের দেশের কৃষি ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয়তো ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার অন্যতম পরিবর্তন গুলির মধ্যে থাকবে। ট্রাম্পের অন্যতম পরামর্শদাতা এবং ধনকুবের ইলন মাস্কের বিদেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শ্রমিকের প্রতি বিশেষ নজর হয়তো চাকরি ক্ষেত্রে অভিবাসন নীতিতে কড়াকড়ির হাত থেকে রক্ষা করবে বলে আশাবাদী শিল্প মহল।
যদিও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থাগুলি যেমন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অথবা রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অসূয়া এই সংস্থাগুলির বর্তমান অসহায় অবস্থা আরো আগামীদিনে বাড়িয়ে ফেলবে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে রাষ্ট্রসংঘ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারছে না, সে সম্পর্কে সারা বিশ্বের ধনতান্ত্রিক শক্তিগুলি একমত, এবং বিশ্ব দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানটি তার গুরুত্ব দিনকে দিন হারিয়ে চলেছে। ট্রাম্পের বিদেশ নীতি রাশিয়া এবং চীনের সাথে কি হতে চলেছে তার ওপর নির্ভর করবে আগামী দিনের আন্তর্জাতিক রাজনীতি। বন্ধু পুতিনের সাথে মিত্রতার সুবিধা নিয়ে “ব্যাক চ্যানেল ডিপ্লোমেসি” আগামী দিনে বন্ধু রাষ্ট্র ইউক্রেনের সাথে দীর্ঘদিন ধরে লড়তে থাকা রাশিয়ার সমঝোতা করাতে পারলে, তা হবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় সাফল্য। আপাতত ইজরাইলের নেতানিয়াহু কে শান্তি প্রস্তাবে রাজি করাতে পারলেও প্যালেস্টাইনের মানুষের স্বার্থ রক্ষায় ট্রাম্প প্রশাসন কতটা সদয় হবে তা তার প্রথম দফার রাজত্ব থেকে খুব একটা আশার আলো পাওয়া যায় না ঠিক যেমনটা ইরানের ক্ষেত্রেও। নেতানিয়াহু, জিং পিঙ, পুতিন, নরেন্দ্র মোদীর মত শক্তিশালী নেতাদের প্রতি ট্রাম্পের বিশেষ আনুগত্য ও সম্পর্ক হয়তো নতুন সাম্রাজ্যবাদ নীতির পক্ষে সহায়ক হবে অন্যথায় চীনকে কেন্দ্র করে যে বিশ্বজুড়ে শক্তি কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে সেই লড়াইয়ে আমেরিকাকে একলা করবে। ইতিমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের একাংশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে “আমেরিকান ড্রিমস” দুর্বল হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথমবারের চার বছরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও উষ্ণতা এতটাই ছিল যে নিয়ম ভেঙ্গে ট্রাম্পের পক্ষে অনাবাসী ভারতীয়দের মধ্যে ঝড় তুলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। জো বাইডেনের সময়ে খেসারত দিতে হয়েছিল ভারতকে। ভারতের স্বার্থকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রতিবেশী বাংলাদেশে অস্থিরতা ও ক্ষমতার পরিবর্তনে সহায়তা করেছিল আমেরিকা। বর্তমানে একটি অতি সক্রিয় ধর্মীয় গোষ্ঠী বাংলাদেশের ক্ষমতা করায়ত্ত করে ভারতের সীমানাতে অস্থিরতা সৃষ্টির প্রয়াস করছে। ট্রাম্পের তৃতীয় দফার শাসনে আশা করা যায় এই অতি ধর্মীয় সরকারের বদলে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচন আরো তাড়াতাড়ি সম্ভব হবে দেশের পূর্ব চরিত্র বজায় থাকবে এবং ভারতের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটবে। ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ভারতের নাম নথিভুক্ত করা ট্রাম্পের দেশটির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন । মার্কিন পণ্য ও পরিষেবা বাণিজ্যের জন্য ভারত ই হল বৃহত্তম বাজার। গত বছর, সাতটি অমীমাংসিত ডব্লিউটিও বিরোধের সমাধান করেছে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায়। ২০২২ সালে ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলারের উপরে। এই দুই দেশ ই কৃষি, ব্লকচেইন, গ্রীন এনার্জি, সাইবার বিজ্ঞান, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টেলিযোগাযোগ, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং মহাকাশ সহ প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে ভারতে আমেরিকান বিনিয়োগ বাড়িয়ে এই দুই দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে চলেছে জোর কদমে। যদিও “আমেরিকা ফার্স্ট” ডাক ক্ষমতায় আসা ট্রাম্পের দ্বিতীয় আমলে ও এইচ-ওয়ান বি ভিসার ক্ষেত্রেও সহযোগিতা চলতে থাকবে বলে আশা আমেরিকায় বসবাসকারী অনাবাসী ভারতীয় শিল্পমহলের।
সবে মিলিয়ে দ্বিতীয় দফায় শপথ গ্রহণের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধুমাত্র সংখ্যার দিকে নয় গাজাতে শান্তি চুক্তি শুরু করে গুরুত্বের দিক থেকেও প্রথম দফার থেকে শক্তিশালী হিসেবে শুরু করবেন দ্বিতীয়বার। রাষ্ট্রপতি বাইডেন তার শেষ ভাষণে যদিও দেশ বাসীকে সতর্ক করেছেন বিপদজনক কিছু ঘটছে বলে এবং ক্রমবর্ধমান “টেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স” কে। এরপরেও ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা আমেরিকান ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে, বর্তমান সময়ে চীনের দাপটে ও ঠান্ডা যুদ্ধ পরবর্তী রাশিয়ার উত্থানে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দ্বারা তৈরি বিশ্ব ব্যবস্থার বাইরে একটি নতুন বিশ্ব নিঃশ্বাস নিতে তৈরি। আবার আমেরিকার নিজের মানুষদের অধিকারের জন্য “ আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি আসলে রক্ষণশীল সামাজিক মূল্যবোধে ফিরিয়ে এনে আমেরিকান নাগরিকদের অর্থনৈতিক মঙ্গলকে অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন ভবিষ্যতের আশা জাগাতে পারে কিনা সেই দিকে নজর থাকবে ট্রাম্প ২.০ তে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct