সাহিত্যে নারী প্রসঙ্গ এলেই আমাদের প্রিয়া, প্রেয়সী, প্রেমিকার কথা মনে হয়। অবশ্য মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। যুগে যুগে কবিদের কলমে নারীদের সেইভাবেই বেশীরভাগ সময় উপস্থাপন করা হয়েছে। এমনকি নারীর যৌবনের সঙ্গে নদীর জোয়ারের কথাও উঠেছে। নারীদেহের বিভিন্ন অঙ্গের সঙ্গে বাছা বাছা উপমা প্রয়োগ করতেও কবিরা পিছপা হননি। লিখেছেন ড. শেখ কামাল উদ্দীন।
সাহিত্যে নারী প্রসঙ্গ এলেই আমাদের প্রিয়া, প্রেয়সী, প্রেমিকার কথা মনে হয়। অবশ্য মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। যুগে যুগে কবিদের কলমে নারীদের সেইভাবেই বেশীরভাগ সময় উপস্থাপন করা হয়েছে। এমনকি নারীর যৌবনের সঙ্গে নদীর জোয়ারের কথাও উঠেছে। নারীদেহের বিভিন্ন অঙ্গের সঙ্গে বাছা বাছা উপমা প্রয়োগ করতেও কবিরা পিছপা হননি।
নজরুল পূর্ববর্তী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “চিত্রা” কাব্যগ্রন্থের ‘বিজয়িনী’ কবিতায় লিখেছেন–
‘লুটায় মেখলাখানি ত্যাজি কটিদেশ
মৌন অপমানে; নূপুর রয়েছে পড়ি;
বৃক্ষের নইচওলবআস যায় গড়াগড়ি’।
“কড়ি ও কোমল” কাব্যগ্রন্থের ‘চুম্বন’ কবিতা শেষ করেছেন এইভাবে–
‘দুখানি অধর হতে কুসুমচয়ন—
মালিকা গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে!
দুটি অধরের এই মধুর মিলন
দুইটি হাসির রাঙা বাসরশয়ন’।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর “বনলতা সেন” কাব্যগ্ৰন্থের নাম কবিতা ‘বনলতা সেন’-এ নারীর চুল, মুখকে দেখলেন এইভাবে—
‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;’
তারপর চোখের উপমা দিতে গিয়ে লিখলেন–
‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’
ঠিক এই সময় কাজী নজরুল ইসলাম নারীকে দেখেছেন অন্যভাবে, অন্য রূপে। “সাম্যবাদী” কাব্যগ্রন্থের ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় বারবণিতাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে লিখেছেন–
“কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে? / হয় ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে!’’
নারীকে, সেই নারী আবার বারাঙ্গনা, তাকে মা বলে সম্বোধন করা নজরুলের সমকালে সহজ
নয় কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেলন।
নারী পুরুষে নজরুল কোন ভেদ দেখেন নি। ভালো কাজ করলে তাতে যেমন আছে পুরুষের অধিকার তেমনি নারীরও আছে সমানাধিকার। কোন খারাপ কাজ করলে, অন্যায় করলে তাতে শুধু নারীরই দোষ তিনি দেখেননি, সেখানে পুরুষকেও তিনি সমানভাবে দায়ী করেছেন এবং সঠিকভাবেই করেছেন। তাই ‘নারী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন–
‘সাম্যের গান গাই–
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’
শুধু তাই নয়, পাপ ও মন্দ কাজে যখন অন্যরা শুধুই নারীকে দায়ী করেন তখন কবি মনে করেন সেই কাজের জন্য নারীর পাশাপাশি পুরুষও সমানভাবে দায়ী। তাই তিনি লেখেন–
‘বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি অর্ধেক তারা আনিয়েছে নর, অর্ধেক তার নারী।’ নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই পৃথিবী সুন্দর হয়–
‘নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে।’ কিন্তু সেই নারীদের তো আমরা সমানাধিকারের চোখে দেখিনা বরং প্রাপ্য সম্মানটুকুও দিই না এবং পারলে অপমানে অপমানে অপদস্ত করি। তাই তিনি আক্ষেপ করে লিখেছেন–
‘জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর লেখা নাই তার পাশে।’
শুধু সৃষ্টিতে নয়, স্রষ্টা ব্যক্তিগত জীবনেও বারবার নারীকে দেখেছেন মা হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে মাত্র ন’বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা গেলে মা জাহেদা খাতুন দ্বিতীয় বিয়ে করলে কাজী নজরুল ইসলাম হয়তো তা মেনে নিতে পারেননি! তাই পরবর্তীকালে যখনই তিনি মাতৃসমা নারীদের সংস্পর্শে এসেছেন তখনই তাঁদের মধ্যে মাকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন। যাঁদের মধ্যে তিনি এই মাতৃত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন তাঁর শাশুড়ি গিরিবালা দেবী, বিরজাসুন্দরী দেবী, মিসেস এম. রহমান প্রমুখ। বিভিন্ন সময় এই নারীদের নিয়ে কবি শুধু কবিতাই লিখেছিলেন তাই নয়, কাব্য গ্রন্থও উৎসর্গ করেছিলেন। যেমন তিনি তাঁর “বিষের বাঁশি” কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন মিসেস এম. রহমানকে। উৎসর্গপত্রে তিনি লেখেন– ‘বাংলার অগ্নিনাগিনী মেয়ে মুসলিম মহিলা-কুল-গৌরব আমার জগজ্জননী-স্বরূপা মা মিসেস এম. রহমান সাহেবার পবিত্র চরণারবিন্দে’। হুগলি জেলে আমরণ অনশন রত নজরুল বিরজাসুন্দরী দেবীর কথাতেই অনশন ভঙ্গ করেন। নজরুল তাঁর ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্ৰন্থটি এই মহীয়সী নারীকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন –
‘সর্বহারা কন্যা মোর! সর্বহারা মাতা!
শূন্য নাহি রবে কভু মাতা ও বিধাতা।
হারা-বুকে আজ তবে ফিরিয়াছে যারা –
হয়ত তাদেরি স্মৃতি এই ‘সর্বহারা’।
ব্যক্তিগত জীবনে অন্তত তিনজন বিদূষী নারীর সংস্পর্শে তিনি এসেছিলেন। একজন ফজিলাতুন্নেসা, যিনি আই.এ ও বি.এ উভয় পরীক্ষাতেই ডিস্টিংশন এবং অঙ্ক নিয়ে এম.এ-তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, যাঁকে তিনি ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। অন্য দু’জনের একজন অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের রূপবতী কন্যা উমা মৈত্র, অন্যজন বনগাঁপাড়ার সুকণ্ঠের অধিকারিনী প্রতিভা সোম, পরবর্তীকালে যিনি প্রতিভা বসু নামে পরিচিত হন, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিবাহ সূত্রে। একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে প্রথমে আসেন নার্গিস খানম, কিন্তু তাঁর সঙ্গে বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আর একজন অবশ্যই তাঁর স্ত্রী প্রমীলা সেনগুপ্ত। তাঁদের প্রীতিপূর্ণ দাম্পত্যের ছবি আমাদের মনে করিয়ে দেয় তাঁদের মধ্যে কি নিবিড়, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, যেখানে একজন কোমরের নিম্নাঙ্গ থেকে অসাড় নারী তাঁর মুক-বধির পতিকে খাইয়ে দিচ্ছেন। অসুস্থ নজরুল শেষ বয়সে অস্থির ছিলেন, এক জায়গায় বসে থাকলেও কাগজপত্র ছিঁড়তেন, তিনিই প্রমীলার হাতে শান্ত, স্থির হয়ে বসে খাবার খাচ্ছেন। এমন চিত্র কিভাবে পাওয়া যায় যদি না অসুস্থ অবস্থাতেও নারীর প্রতি কবির শ্রদ্ধা না থাকতো! প্রসঙ্গত উমা কাজীর কথাও বলতে হবে।
শুধু তো নজরুলের সময়েই নয়, তাঁর পূর্ববর্তী সময়েও নারীর প্রতি যে অন্যায়, অবিচার বিশেষ করে পণপ্রথা, বহুবিবাহ প্রথা, সতীদাহ প্রথা ইত্যাদির মাধ্যমে নারীকে অসম্মানিত হতে হয়েছিল এবং স্বাধীন ভারতবর্ষে, একবিংশ শতকে এই উন্নত প্রযুক্তির যুগের ভারতবর্ষেও বা শুধু ভারতবর্ষ কেন সারা পৃথিবীতেই নারীর প্রতি যে অবিচার, এমনকি কোমলমতী ছাত্রীরা তাদের শিক্ষকদের লালসার হাত থেকে রক্ষা পায় না তখন কাজী নজরুল ইসলামের নারীর প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের কবির প্রতিই শ্রদ্ধান্বিত করে তোলে। আজকের ভারতবর্ষে এখনো নারীর সুরক্ষায় গার্হস্থ হিংসার বিরুদ্ধে আইন, বধূ নির্যাতনের আইন আনতে হয় তখন কোনো আইন নয়, শুধুমাত্র নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে নিদর্শন রেখেছিলেন তা একালেও স্মরণযোগ্য।
একালে, যখন চন্দ্রযান-৩ চাঁদে যাচ্ছে তখনও দিনে-রাতে নারীর সম্মান ভূলুন্ঠিত হচ্ছে। দেশে -বিদেশে সর্বত্র। মণিপুরের নারীদের উপর অত্যাচারে সারা দেশ শিউরে ওঠে। এমনকি খবর পাওয়া যাচ্ছে বিদেশের পার্লামেন্টেও এমন ঘটনা ঘটছে। অথচ কাজী নজরুল ইসলামের মতো করে আজকে যদি নারীকে সম্মান জানাতে পারতাম তাহলে নারীকে এই অপমান থেকে হয়তো রক্ষা করা যেত। আর তা যদি পারি তা’হলেই কবির প্রতি তাঁর প্রয়াণ দিবসে যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct