শুভায়ুর রহমান , কলকাতা, আপনজন: ‘স্বপ্ন’ তো সবাই দেখে। কারণ স্বপ্নই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু সবার তো আর স্বপ্ন পূরণ হয় না। কারও কারও হয়। আজ যাঁদের হয়, তাঁদের স্বপ্ন পূরণের গল্পই সমাজের কাছে উদাহরণ, বড়দের কাছে শিক্ষা এবং ছোটদের কাছেও অনুপ্রেরণা হ’য়ে দাঁড়ায়। আমাদের আজকের গল্প, মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলার এক প্রত্যন্তগ্রাম নদাইপুরের। সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা, এক অতি সাধারণ মেয়ে ড. ওয়াহিদা রহমান-এর স্বপ্ন পূরণ নিয়ে।
অতি সম্প্রতি, ২০২৫ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ফরেন্সিক দপ্তরে সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার হিসাবে যোগদান করেছেন। ‘কেমন লাগছে’ জিজ্ঞেস করতে কেমন যেন আনমনা হয়ে স্মৃতির রাজ্যে হারিয়ে গেলেন। সেই যে কবে কল্পনা হাতছানি দিয়েছিল, তা কতকটা স্বচ্ছ আর কতকটা অসহ্য হয়ে ঘুরে ফিরে আসছিল। ‘বড় হয়ে কি হতে চাও?’ কেউ জিজ্ঞেস করলে এক লহমায় সাতপাঁচ না ভেবে দাঁতে আঙ্গুলের নখ কাটতে কাটতে বলে দিতেন, ‘ভালো মানুষ হতে চাই।’ চিকচিক করতে করতে স্মৃতির রোমন্থন করেছিলেন গর্বিত বাবা-মা। তবে বেড়ে ওঠায় বাধার অভাব ছিল না। তার ওপর মাধ্যমিক পড়াকালীন বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ছেদ পড়েনি পড়াশুনায়। কোনও প্রতিবন্ধকতার কাছে নতি স্বীকার না করে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করলেন ড. ওয়াহিদা রহমান। মোহাম্মদ আসাদুল হক ও নুগেনা বিবির ছোট মেয়ের এই সাফল্য সহজ ছিল না। সামনে ছিল পাহাড় প্রমাণ বাধা। কিরকম সেটা? স্কুল ছিল গ্রাম থেকে দূরে। তখন আবার সবুজ সাথী সাইকেল ছিল না। কলেজ তো বহরমপুরে আর বিশ্ববিদ্যালয় কলকাতার যাদবপুরে। পিছিয়ে থাকা গ্রামের গৃহবধূ হিসেবে ওইসব দূরবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা চালানো সহজ কথা নয়। কিন্তু স্বামী মোঃ গোলাম রসূল কিংবা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সহযোগিতায় স্বপ্ন পূরণের জেদ বহাল রাখা সম্ভব হয়েছে। তারা বাড়ির বউমাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বহরমপুর হয়ে কলকাতায় পড়তে পাঠিয়েছে।লালগোলার বালুটুঙ্গী হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক আর এমএন একাডেমী থেকে উচ্চ মাধ্যমিক। তারপর ২০১০সালে বহরমপুর গার্লস কলেজ থেকে ফিজিক্স অনার্স সহ বিএসসি পাশ। ২০১৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার ডিগ্রী। এরপর শুরু হয় গবেষণা। ২০২০ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করে ওয়াহিদা হন ড. ওয়াহিদা রহমান। এরই মধ্যে ২০১৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে এক সেমিনারে যোগদান করলে তার উপস্থাপনা বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। গবেষণামূলক কাজকর্ম যেমন পেপার পাবলিকেশন রিভিউ ইত্যাদির পাশাপাশি বেশ কিছুদিন থেকে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় অতিথি অধ্যাপক হিসাবে পড়ান। সম্প্রতি, জানুয়ারি মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিচালিত রিজিওনাল সায়েন্স কংগ্রেসে তিনি তার গবেষণামূলক কাজ উপস্থাপন করে আউটস্ট্যান্ডিং পেপার প্রেজেন্টেশান অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন।
২০২৩ সালের পি.এস.সির বিজ্ঞাপনের ভিত্তিতে তিনি ২০২৫-এ এসে সিনিয়র সাইন্টিস্টের গেজেটেড অফিসার পদের চাকরিটা পেলেন।
অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় কোন সমস্যা হয়েছিল? উত্তরে ওয়াহিদা বলেন, পরিবার থেকে খুব বেশি সমস্যা তেমন হয়তো হয়নি কিন্তু অভাব ছিল। শুধুমাত্র স্বপ্ন ছিল কিছু করার। তাই শুধুমাত্র এই সাফল্যের মুখ দেখবো আর কিছু করে দেখাবো বলে এখন পর্যন্তও সন্তান নিতে পারিনি। তবে হ্যাঁ স্বীকৃতি পেয়েছি। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। সব মিলিয়ে তাঁর এই সাফল্যে এলাকায় প্রশংসার বন্যা বইছে। একদিকে আর্থিক অনটন অন্য দিকে সংসারের চাপ সবকিছুকে বানিয়ে নিয়ে স্বপ্নের মাটি ছুঁয়ে বাস্তবের সর্বোচ্চ শিখরে লালগোলার গর্ব - ড. ওয়াহিদা রহমান।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct