সারিউল ইসলাম, মুর্শিদাবাদ, আপনজন: ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে জেলার তিনটি আসনেই বিপুল ভোটে জয়ের পর প্রথম প্রশাসনিক সভা করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার মুর্শিদাবাদ শহরে তথা লালবাগ শহরের নবাব বাহাদুর’স ইনস্টিটিউশন ময়দানে প্রশাসনিক সভা ও সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠান করা হয়। এদিন জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ৩৮৪.১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১১১ টি উন্নয়নমূলক প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ১৫০.৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৬ টি প্রকল্পের শিলান্যাস করেন তিনি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৫০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৈরি হওয়া মুর্শিদাবাদ পুরসভার জল প্রকল্পের উদ্বোধন একটি। পুরপ্রধান ইন্দ্রজিৎ ধর বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর হাতে জল প্রকল্পের উদ্বোধন করা হলো। প্রতিটি বাড়িতে পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহের কাজ মঙ্গলবার থেকেই শুরু করা হবে।’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “একসময় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী এই মুর্শিদাবাদ শহর, তাই এই শহরে প্রশাসনিক সভা করতে চেয়েছিলাম আমি।” জেলার একমাত্র সরকারি বিদ্যালয় নবাব বাহাদুর’স ইনস্টিটিউশনের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ বার্তা দেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি ২৫ লক্ষ টাকা বিদ্যালয়ের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য শিক্ষা দপ্তরের মাধ্যমে অনুদান দেওয়ার ঘোষণা করেন তিনি।
অন্যদিকে গঙ্গা-পদ্মা ভাঙন ইস্যুতে কেন্দ্রকে তোপ দাগেন মমতা। তিনি বলেন, “আমি জানি গঙ্গা ভাঙন একটি বড় সমস্যা। ঘরবাড়ি, মন্দির, মসজিদ, রাস্তা সবই তলিয়ে যায়। আগে কেন্দ্রীয় সরকারের ভাঙন রোধে একটা প্রকল্প ছিল কিন্তু এখন তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গঙ্গা-পদ্মা ভাঙন রোধে ৬২ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে। এর আগেও রাজ্য সরকার ৪০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারকে আমি একাধিকবার চিঠি লিখেছি কিন্তু তারা কোন পাত্তাই দিচ্ছে না। নির্বাচনের সময় হিন্দু-মুসলিম রাজনীতি করতে আসে, হিংসা-বৈষম্য করতে আসে কিন্তু যখন ভাঙনে ঘরবাড়ি, মন্দির, মসজিদ ভেঙে যায় তখন তাকিয়েও দেখেন না।” ওবিসি নিয়ে তিনি বলেন, “ওবিসি দের জন্য মেধাশ্রী প্রকল্প করেছি, কিন্তু আদালতের রায়ে তা বন্ধ হয়ে আছে কিছুদিনের জন্য। আমরা সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছি। এর জন্য নিয়োগপ্রক্রিয়াও বন্ধ আছে, পড়াশোনা থমকে গিয়েছে। ভরসা রাখবেন, ওবিসি সমস্যা নিরসনে আমরা আমাদের সাধ্যমত করছি, করব।”
“মুর্শিদাবাদ জেলায় পানীয় জলের জন্য ৭৩৮ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৬ লক্ষ ৮৬ হাজার বাড়িতে জলের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আরো ১৬ লক্ষ ৭৮ হাজার বাড়িতে পানীয় জলের সংযোগ দেওয়া হবে” বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বিড়ি শ্রমিকদের নিয়ে মমতা বলেন, “বিড়ি শ্রমিকদের জন্য জায়গা দেখে ভালো হাসপাতাল করতে চাই।” মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “যেমন ২৬ হাজার শিক্ষককে একতরফা বাতিল করা হয়েছে। তেমনি ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করতে হবে, ওবিসি সংরক্ষণ কেড়ে নিতে হবে, এনআরসি চালু করতে হবে, এনপিআর চালু করতে হবে এগুলো বিজেপির কথা। আমি থাকতে এগুলো করতে দেব না। কোনোদিনই দেব না।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পুরোহিত-ইমামদের কাছে অনুরোধ, দাঙ্গা যেন না হয়। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ নিয়ে সারাদেশে দাঙ্গা হয়, কিন্তু মুর্শিদাবাদে হয়নি। কাটরা মসজিদের দাঙ্গার কথা মনে আছে, আমি নিজে এসেছিলাম। কয়েকদিন আগে বেলডাঙ্গায় একটি দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। উভয় সম্প্রদায়কে আমার ধন্যবাদ। বিশেষ করে প্রশাসনকে। ইমামরাও ভালো ভূমিকা নিয়েছিলেন।”
বিজেপিকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, “যারা বিশ্ব নেতা তাদের মানবো? নাকি যারা চুনোপুটি, কি বলছে তাদের মানবো! হিন্দু মুসলিমকে রক্ষা করবে, মুসলিম হিন্দুকে রক্ষা করবে এটাই সম্প্রীতি। কোন একজনের কথা শুনে মানুষ জমায়েত হয়েছিল, তখন ইমাম সাহেব মাইকে বারবার ঘোষণা করেছিলেন, আমি সে কথা শুনেছি।” সীমান্ত ইস্যুতেও কেন্দ্রকে নিশানা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “মুর্শিদাবাদে ওপার বাংলার সীমান্ত আছে। সীমান্ত বিএসএফ দেখুক, কারো প্ররোচনায় পা দিয়ে কেউ ওদিকে যাবেন না। বিএসএফ দায়িত্ব নিক নিরাপত্তার। পুলিশকে বলবো প্রয়োজনে মাইকে ঘোষণা করতে হবে। মানুষকে সজাগ করতে হবে।”
সভার শেষ মুহূর্তের বক্তব্যে আবাসের কাটমানি নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “সরকারি প্রকল্পে এক টাকাও কাউকে দেবেন না। এটি সরকারের টাকা। তাই সেই টাকা নেওয়ার অধিকার কোন গ্রামসভা, পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ কারও নেই। যদি কেউ টাকা চাই থানায় গিয়ে অভিযোগ করবেন। আর পুলিশ যদি অভিযোগ না নেয়, তবে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীতে জানাবেন।”
তবে মুর্শিদাবাদ শহরে প্রশাসনিক সভা হওয়া সত্ত্বেও শহরের তথা জেলার পর্যটন মানচিত্রের কোন কথা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে আসেনি। মুর্শিদাবাদ ডিসট্রিক্ট চেম্বার অব কমার্সের সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, “নবাবের শহরে প্রশাসনিক সভা হল অথচ পর্যটন সম্পর্কে একটা ‘টু’ শব্দ করলেন না মুখ্যমন্ত্রী। এতে আমরা এক প্রকার হতাশা প্রকাশ করছি। পর্যটন বাড়লে তবেই জেলার অর্থনৈতিক অবস্থা চাঙ্গা হবে। কিন্ত পর্যটন নিয়ে কোন কথাই মুখ্যমন্ত্রী সভা থেকে বলেননি।”
এদিনের প্রশাসনিক সভা ও সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠানকে তৃণমূলের দলীয় সভা বলে একযোগে কটাক্ষ করে কংগ্রেস-সিপিএম ও বিজেপি।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct