এম মেহেদী সানি, কলকাতা, আপনজন: ধানের জমিতে কীটনাশক ব্যবহার রুখতে বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে প্রজেক্ট উপস্থাপন করে নজর কেড়েছিল যে ছেলেটি আজ তিনি উড়িষ্যার কটকে অবস্থিত ধান গবেষণা কেন্দ্রে সিনিয়র বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মরত। সম্প্রতি তাঁর অভিনব উদ্ভাবন সাড়া ফেলেছে কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে। আর এই সামগ্রিক সাফল্যের জন্য বৈজ্ঞানিকের মুকুটে যুক্ত হয়েছে নতুন পালক। গত ডিসেম্বর মাসে লখনউ-এ ন্যাশনাল বোটানিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ‘ফ্লোরা অ্যান্ড ফানা সায়েন্স ফাউন্ডেশনে’র পক্ষ থেকে মিলেছে ‘প্রফেসর সুশীল কুমার ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড ২০২৪।’ যদিও এর আগে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ইয়ং সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড ২০১৩-১৪’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন কুতুবউদ্দিন। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটের জয়গ্রামের কৃষক ইলিয়াস মোল্লার পুত্র কুতুবউদ্দিন। কুতুবের দাদু নাসিম মোল্লা ছিলেন মাওলনা ও সমাজসেবী। সেই কৃষক পরিবারের সন্তানের এই উত্তরণ কার্যত বাংলার মর্যাদা বৃদ্ধি করল।
জানা গিয়েছে, বিশ্বব্যাপী কৃষি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ড. কুতুবুদ্দিন এ মোল্লার আবিষ্কৃত জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিষয়টি ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক জার্নাল “প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজি জার্নাল”-এ প্রকাশিত হয়েছে। ড. কুতুবুদ্দিন বলেন, ‘জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি’ রোগ প্রতিরোধ, জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা ও কৃষিতে ফসলের উন্নতি সাধনে সহায়ক হবে।’
বৈজ্ঞানিক কুতুবুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, তাঁর হার না মানা জীবনের সাফল্যের কাহিনীটা একেবারেই সহজ ছিল না। প্রত্যন্ত গ্রামের প্রান্তিক পরিবারে জন্ম কুতুবুদ্দিন ছিলেন বাড়ির বড় ছেলে। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে কুতুবুদ্দিন বড় হওয়ায় দায়িত্ব একেবারে কম ছিল না । পিতা ইলিয়াস মোল্লা গ্রামীণ চিকিৎসক এবং মাতা সুফিয়া বেগম গৃহকর্ত্রী।
স্থানীয় বিদ্যালয় থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন কুতুবুদ্দিন মোল্লা, স্নাতকে বোটানি অনার্স নিয়ে পড়ার জন্য পাড়ি দেন কলকাতায়। পরে বোটানি নিয়ে স্নাতকোত্তর এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন কুতুবুদ্দিন। স্নাতক স্নাতকোত্তরে মেধাতালিকায়ও জায়গা করে নেন তিনি। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৪ সালে জুনিয়র বৈজ্ঞানিক হিসেবে যোগ দেন দিল্লির ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অফ প্ল্যান্ট জেনেটিক রিসোর্স’-এ। ২০১৫ সালে কটকের ধান গবেষণা কেন্দ্রে কৃষি বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করেন। কর্মরত অবস্থায় ২০১৭ সালে ফেলোশিপ নিয়ে গবেষণার জন্য পাড়ি দেন ইউনাইটেড স্টেটে। ফিরে এসে আবার যোগদান কটকের ধান গবেষণা কেন্দ্রে।
কথা বলে জানা যায়, কুতুবুদ্দিনের বৈজ্ঞানিক হওয়ার স্বপ্ন ছিল ছোট থেকেই। বাবার কৃষি জমিতে ধান চাষের সময় কীটনাশকের ব্যবহার করতে দেখতেন কুতুবুদ্দিন, তারপর ভেবে ভেবে কীটনাশক ব্যবহার রুখতে বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে প্রজেক্ট উপস্থাপন করে শিক্ষক মন্ডলীর অনুপ্রেরণা পান। স্বপ্ন দেখেন একদিন বড় কৃষি বৈজ্ঞানিক হওয়ার। সেই স্বপ্ন বেশ কয়েক বছর আগেই সার্থক হয়েছে কুতুবউদ্দিনের। তবে এবার জিনোম এডিটিং প্রযুক্তির আবিষ্কার অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে বৈজ্ঞানিক কুতুবুদ্দিন কে। ‘জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি কি ?’ প্রশ্ন করা হলে উত্তরে ড. কুতুবুদ্দিন বলেন, আধুনিক বিজ্ঞানের এক যুগান্তকরী আবিষ্কার হল জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির সাহায্যে জীবদেহের DNA তে থাকা অক্ষর গুলি পরিবর্তন করা সম্ভব। DNA এর এই অক্ষরগুলির সজ্জাবিন্যাস ই হলো জেনেটিক কোড । একটি জীব কেমন দেখতে হবে, তার ব্যবহার কেমন হবে, তার বৈশিষ্ট্য কেমন হবে- এই সব কিছুই নির্ধারণ করে জেনেটিক কোড। বর্তমানে এই জিনোম এডিটিং পদ্ধতি প্রাণীর বংশগত রোগ নিরাময় থেকে শুরু করে কৃষিতে ফসলের উন্নতি সাধনে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য ২০২০ সালে বিজ্ঞানী এমানুয়েল চার্পেন্তিয়ের এবং জেনিফার ডডনা কে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় । প্রায় ১৩৫০ টি অ্যামিনো অ্যাসিড এর একক দিয়ে তৈরী একটি প্রোটিন হলো Cas9, যেটি জিনোম এডিটিং করতে সবথেকে বেশি ব্যবহৃত হয়। এটি খুব সুক্ষ ভাবে নির্দিষ্ট জিন এর অক্ষর পরিবর্তন করতে পারে।’
জানা গিয়েছে, ওড়িশার কটকে অবস্থিত জাতীয় ধান গবেষণা কেন্দ্রের একদল গবেষক এই Cas9 এর পরিবর্তে অপর একটি প্রোটিন দ্বারা জিনোম এডিটিং করার প্রচেষ্টা শুরু করেন এবং তারা সফল হন । এই প্রোটিন টি TnpB নামে পরিচিত এবং যা আয়তনে ক্ষুদ্র । এই অভিনব গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে নাম করা আন্তর্জাতিক প্লান্ট বায়োটেকনোলজি জার্নালে। সংশ্লিষ্ট এই গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী ডক্টর কুতুবুদ্দিন মোল্লা । তিনি বলেন, ‘একটি ক্ষুদ্র RNA TnpB কে তার নির্ধারিত লক্ষে পৌঁছাতে এবং নিখুঁত ভাবে ডিএনএ কে কাটতে সাহায্য করে । ভিন্ন ভিন্ন RNA এর উপস্থিতিতে TnpB দ্বারা ধান এবং সরিষা জাতীয় উদ্ভিদের ভিন্ন ভিন্ন জিনকে এডিট করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। Tnpb যখন কোনো একটি নির্ধারিত জিনকে কেটে দেয়, কোষ সেই কাটা অংশ মেরামত করতে গিয়ে বেশির ভাগ সময় ভুল করে বেশ খানিকটা DNA এর কিছু অংশ মুছে ফেলে বা ডিলিট করে দেয় । তার ফলে ঐ জিনটি অকেজো হয়ে যায়।এই ভাবে TnpB ব্যবহার করে কোনো অবাঞ্ছিত জিনকে অকেজো করে দিয়ে তার ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে জীবকে রক্ষা করা সম্ভব । যেমন, ফসল থেকে কোনো অপুষ্টিকর উপাদানের পরিমান কমানো থেকে শুরু করে, গাছের উচ্চতা কমানো, উৎপাদন ক্ষমতা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোও সম্ভব হবে। “TnpB ব্যবহার করে আমরা এখন পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে এমন ধান উদ্ভাবনার গবেষণায় মগ্ন। এবং এর পাশাপাশি TnpB কে আরও শক্তিশালী করার জন্য আমরা প্রোটিন ইঞ্জিনিয়ারিং -এ ও প্রচেষ্টারত।’ সারা বিশ্বে এই প্রথম ভারতীয় এই গবেষক দল প্রথম সফলতার সাথে TnpB ব্যবহার করে উদ্ভিদের জিনোম এডিটিং -এ সক্ষম হয়েছে । এই পুরো গবেষণাটি তত্ত্বাবধান করেছেন বসিরহাটের ভূমিপুত্র বাঙালি বৈজ্ঞানিক কুতুবুদ্দিন মোল্লা । এই গবেষণার কাজে অন্যান্যদের মধ্যে যুক্ত ছিলেন এম জে বেগ, শুভাশিস কর্মকার, দেবস্মিতা পান্ডা, সোনালী পান্ডা, মনস্বিনী দাস , রোমিও সাহা , প্রিয়া দাস, অবিনাশ, জাস্টিন শি, ইনং ইয়াং, এবং এ কে নায়ক ।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct