পাশারুল আলম: ইতিহাস হল এক জাতির স্মৃতি। এই স্মৃতি আমাদের অতীতের শিক্ষা ও ভবিষ্যতের দিশা দেখায়। কিন্তু যখন ইতিহাসকে রাজনৈতিক স্বার্থে বিকৃত করা হয়, তখন সেটি জাতির কল্যাণের পরিবর্তে বিভেদের বীজ বপন করে। সাম্প্রতিক কালে ভারতে ইতিহাস বিকৃতির প্রবণতা রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত, ধর্মীয় মেরুকরণের লক্ষ্যে ইতিহাসের বিশিষ্ট চরিত্রদের ব্যবহার করা হচ্ছে, যা আমাদের সমাজে নতুন বিভাজন তৈরি করছে। একইভাবে দেশের ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ধারাবাহিকভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করে সামাজিক অস্থিরতা নিয়ে এসে নিজেদের রাজনৈতিক ফয়দা তোলার এক প্রয়াস লক্ষ্যণীয়।
ভারতের রাজনীতিতে ইতিহাসের বিকৃতির ধারা সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যেমন অওরঙ্গজেব, টিপু সুলতান, শিবাজী, ও রানা প্রতাপকে নিয়ে বিতর্কিত প্রচার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিজেপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ইতিহাসের চরিত্রদের সাম্প্রদায়িক রঙে রাঙিয়ে তাদের নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ, অওরঙ্গজেব সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি মন্দির ভেঙেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র বলেন, অওরঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংসের ঘটনাগুলো ছিল কেবল বিদ্রোহ দমনের অংশ, কোনো সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে নয়। বরং তিনি বেশ কিছু মন্দির পুনর্নির্মাণেও অবদান রেখেছিলেন। বরং তিনি রানী দুর্গাবতীর অপমান করার পর ভেঙ্গে দেওয়া বিশ্ব নাথের মন্দির পুন:নির্মাণ করেছিলেন । দ্বিতীয় অভিযোগ তিনি হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর আরোপ করেছিলেন । হ্যাঁ তিনি তীর্থ যাত্রী হিন্দুদের উপর কর চাপিয়ে ছিলেন । কিন্তু পূর্ব নির্ধারিত চুয়াত্তর রকমের কর মাফ করে জিজিয়া কর চাপিয়ে ছিলেন । পাশাপশি মুসলমানদের উপর চৌদ্দ রকমের কর বহাল রেখেছিলেন । কিন্তু তিনি যে অখণ্ড ভারতবর্ষ নির্মাণ করে এক অনন্য ভূমিকা নিয়েছিলেন সে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনা ।
একইভাবে শিবাজীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাকে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক প্রচারকের রূপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাসবিদ জদুনাথ সরকার শিবাজীর অসাম্প্রদায়িকতার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার সৈন্যবাহিনীতে শত শত মুসলিম সৈনিক ছিলেন, এবং তিনি সব ধর্মের মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন। একইভাবে শিবাজী সম্পর্কে বিজেপি যে ভাবে প্রচার দিচ্ছে তাতে মনে হয় একজন ধর্ম নিরপেক্ষ রাজা যেন হিন্দুত্ববাদের প্রচারক ও প্রসারক ছিলেন ! কিন্ত ইতিহাস একেবারে অন্য কথা বলে । মারাঠা সেনা যখন হলদিঘাটের যুদ্ধ করে তখন সম্রাট আকবর নিজে যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন না। মোগল বাহিনীর হয়ে সেনাপতি ছিলেন রাজা মান সিংহ আর রানা প্রতাপের সেনাপতি ছিলেন হাকিম খান শুর । এর পরেও বলা হয় রানা প্রতাপ ও মোগল এর লড়াই ছিল হিন্দু মুসলমান এর লড়াই । আসলে এই লড়াই ছিলো দুই রাজার মধ্যে লড়াই । দুই জনের সাম্রাজ্য বিস্তার করার জন্য যুদ্ধ। অথচ রাজনৈতিক কারণে আজ রানা প্রতাপকে হিন্দুত্ববাদী হিসাবে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে ।
একইভাবে টিপু সুলতানের সাম্রাজ্যে হিন্দু মন্দির পুনর্নির্মাণের ঘটনাগুলোকে অগ্রাহ্য করে তাকে ধর্মীয় বিদ্বেষী বলে চিত্রিত করা হয়। মারাঠা বাহিনী যখন দক্ষিণ ভারত টিপু সুলতান এর সাম্রাজ্য আক্রমণ করে তখন টিপু সুলতানের সমর বলকে পরাজিত করতে না পেরে যুদ্ধ অসমাপ্ত রেখে মারাঠা বাহিনীকে ফিরে আসতে হয় । ফিরতি পথে অভিমানে মারাঠা বাহিনী শ্রীরঙ্গপত্তনম এর মন্দির ভেঙ্গে দেয় । মারাঠা বাহিনী দ্বারা ভেঙ্গে দেওয়া মন্দির টিপু সুলতান পুনরায় তৈরী করে হিন্দুদের হাতে তুলে দেন । মারাঠাদের উদ্দেশ্য ছিল টিপু সুলতাকে অপমান করার কিন্তু টিপু শ্রী রঙ্গপত্তনম মন্দির পুন:স্থাপন করে অসম্প্রদায়িকতার পরিচয় দিয়ে ছিলেন । তাই আজও টিপু দক্ষিণ ভারতে হিরো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য টিপু সুলতানের অর্থ সচিব ছিলেন কৃষ্ণ রাও । পুলিস বাহিনীর প্রধান ছিলেন শহিমালইয়েন জার। এছাড়া সেনা বাহিনীর মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন মূলচন্দ ও সুজন রায় । যেমনটা দেখি নবাব সিরাজ উদ্দ্দৌউলার ক্ষেত্রে । মোহল লাল ও মীর মদন । অন্যদিকে সাহিত্য ও কাব্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন ফকির প্রমুখের লেখায় মানবতাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা ফুটে উঠেছে। নজরুলের রচনায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির সরল ও বলিষ্ঠ বার্তা রয়েছে। মুসলিম শাসকদের সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে সহাবস্থান দেখা যায়। মুসলিম শাসকরা স্থানীয় জনগণের সংস্কৃতি এবং ভাষার প্রতি সহনশীল ছিলেন। যা ঐতিহাসিকভাবে সত্য।
আসলে ইতিহাসের বিকৃতি ও তার ফলাফল সমাজে বিভাজন ও হিংসার জন্ম দেয়। অধ্যাপক রোমিলা থাপার বলেন, “ইতিহাসকে ভুলভাবে ব্যবহার করলে তা জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর মাধ্যম হয়ে ওঠে।” ইতিহাস থেকে আমাদের শেখা উচিত কীভাবে অতীতের ভুলগুলো শুধরে একটি উদার এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যত তৈরি করা যায়। কিন্তু যখন অতীতের ভুলগুলোকেই চিহ্নিত করে বদলার মানসিকতা তৈরি করা হয়, তখন সমাজ আরও পিছিয়ে যায়। তিনি সাম্প্রতিক এক গ্রন্থে বলেছেন, রাস্তা ঘাট আর শহরের নাম পরিবর্তন করাই এখনকার দিনের নতুন ইতিহাস।
উদাহরণস্বরূপ, যদি অওরঙ্গজেব বা টিপুকে বিদ্বেষের প্রতীক করে দেখানো হয়, কিংবা শিবাজীকে হিন্দুত্বের প্রতীক বানানো হয়, তাহলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়বে। ইতিহাসবিদ বিপিন চন্দ্র এই প্রসঙ্গে বলেন, “ইতিহাসের ভুলগুলোকে পুনরায় নিয়ে এসে সমাজে বিদ্বেষ সৃষ্টি করা কোনোভাবেই জাতীয়তাবাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে না।” তাই যারা এই কাজ করতে চায়, তাদের উদ্যেশ্য ও লক্ষ্য কি? তা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা আবশ্যক।
সঠিক ইতিহাস আমাদের সঠিক পথ দেখায় আর বিকৃত ইতিহাস আমাদের বিপথে পরিচালিত করে। তাই ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন সঠিক ইতিহাস জ্ঞান এবং তার বাস্তবায়ন। জাতি হিসেবে আমাদের উচিত, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি উদার এবং মানবিক সমাজ গঠন করা। রামচন্দ্র গুহ এই বিষয়ে বলেন, “ইতিহাস আমাদের শেখায় কেবল কী ঘটেছিল, তা নয়, কেন ঘটেছিল এবং কীভাবে তা এড়ানো যেত।” অথচ এড়ানোর ফর্মুলা না নিয়ে ইতিহাসের ভুল গুলির পুনরাবৃত্তি করে আর একবার ভুলের রাস্তায় হাটছি। ইতিহাস আমাদের অতীতের ভুলগুলি যাতে না হয় তার শিক্ষা দেয়, কেউ যদি ইতিহাসের ভুল সংশোধন করতে চায়, তাহলে সেই সংশোধনকারী আর একটা ভুল করে।
অতীতে মানুষ ভুল করেছে। কিন্তু সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ গঠন করতে হবে। ধর্ম, জাতি বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বিভাজন তৈরির পরিবর্তে আমাদের উচিত একজাতীয় মানসিকতা তৈরি করা। আজকে আমরা যা করছি, তা হয়তো সঠিক মনে হবে কিন্তু আজকের দিনগুলি যখন ইতিহাস হিসাবে ব্যবহার করা হবে, আমাদের কার্যকলাপ নিয়ে মূল্যায়ন করা হবে, তখন আমাদেরও শত শত ভুল ইতিহাসের পৃষ্ঠা ভরে যাবে। শাসকের ইতিহাস, শাসকের জয় পরাজয়ের ইতিহাস, জনগণের ইতিহাস, সমাজ বাস্তবতার ইতিহাস আর সমাজ গঠনের ইতিহাস সব কিছু একই বাক্সে ভরে দিয়ে বিচার করলে বিচারের ভুল হবে। এই ভুলই নিয়ে আসবে সামাজিক ট্র্যাজেডি। যা আমাদের কাম্য হওয়া উচিত নয়।
তাই পরিশেষে বলা যায়, ইতিহাস কখনোই বদলা নেওয়ার হাতিয়ার নয়। এটি আমাদের উন্নতির পথ দেখায়। তাই আমাদের উচিত ধর্মীয় মেরুকরণ ও সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি পরিহার করে একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবিক সমাজ গঠন করা। ইতিহাসের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে, সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ ও সমৃদ্ধশালী ভারত গড়ে তুলতে পারি। মানুষ যদি ঘৃণা ও হিংসার বদলে ভালোবাসা ও সহিষ্ণুতার পথে চলতে শিখে, তবেই আসল ইতিহাসের উদ্দেশ্য পূরণ হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct