ডা. শামসুল হক, অত্যাচারীর শাসন এবং শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ যে চিরকালই নিপীড়িত হয়ে এসেছেন ইতিহাসেই তার প্রমাণ আছে অনেক। সেইসব অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে কখনও বা গর্জে উঠেছেন কোন কোন মানুষ , আবার কখনও বা অতি নীরবেই সকলকে সবকিছুই সয়ে নিতে হয়েছে কেবলমাত্র অশান্তির ভয়ে।
আমাদের দেশের মানুষজনকেও বহুবারই এহেন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। হুল বিদ্রোহ হল তেমনই এক মর্মান্তিক ঘটনা , যা ঘটেছিল পরাধীন ভারতবর্ষের বুকে। ইতিহাসের পাতায় সেই ঘটনা আবার সাঁওতাল বিদ্রোহ নামেও পরিচিত।
ইংরেজদের অসহনীয় অত্যাচারের ঠেলায় তখন জেরবার হয়ে উঠেছিলেন আমাদের দেশের সব শ্রেণীর মানুষ। শুধু ইংরেজদের দোষটাই বা দিই কেন , আমাদের দেশের জোতদার , জমিদার , নীলচাষি থেকে শুরু করে ইংরেজদের ধামাধরা অনেক সুদখোর মহাজনদের যোগসূত্র ছিল সেই ঘটনার সঙ্গে।
সেটা ১৮৫৫ সালের কথা। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তখন সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের সাঁওতাল সহ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অনেকেই। অনেক দিনের অনেক অন্যায় সহ্য করতে করতেই একটা সময় তাঁরা এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন যে বৃহত্তর আন্দোলনের পথেই পা বাড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা।
বিহারের ভাগলপুর এবং বঙ্গের মুর্শিদাবাদ, মালদহ ইত্যাদি জেলার বেশ কয়েকটি অঞ্চলে শুরু হয় সেই বিদ্রোহের সূচনা। সেই বিপ্লবের আগুন মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই আবার ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য অংশেও। সাঁওতালদের এই মহা বিদ্রোহ মূলত হুল বিদ্রোহ নামেই পরিচিত। ১৮৫৫ সালের ৩০ শে জুন এর সূত্রপাত হলেও তার জন্ম কিন্তু আরও অনেক আগেই। ১৭৮০ সালে সাঁওতাল নেতা তিলকা মুর্মুর নেতৃত্বেই শুরু হয় এই বিদ্রোহের। ইংরেজ এবং দেশীয় জোতদার- জমিদারদের অন্যায় অবিচারের শিকার হয়েই সাঁওতাল মুক্তিবাহিনী গঠনের মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। তাঁদের হাতে তখন অস্ত্র বলতে ছিল কেবলমাত্র তীর ধনুক , বল্লম এবং বাঁশের লাঠি। শুধু মাত্র তার উপর ভরসা করেই তিনি এবং তাঁর বাহিনী আপোসহীন সংগ্ৰাম শুরু করেছিলেন আধুনিক অস্ত্র এবং রণসজ্জায় সজ্জিত ইংরেজ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
অসম সেই লড়াই কিন্তু খূব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ধরা পড়েন তিলকা মুর্মু। ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মহা উল্লাসে নৃত্য করেছিল ইংরেজ বাহিনী। সেই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিলকার লোকজন। তাই তাঁরা সাময়িকভাবে চুপচাপ থাকলেও প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নতুনভাবে প্রস্তুতি নিতেও শুরু করলেন। ফলে সাঁওতাল বিদ্রোহের ঢেউ সাময়িকভাবে স্তব্ধ হলেও তার পথ কিন্তু অবরুদ্ধ হয়ে পড়েনি।
তুষের আগুনের মতো ধিক ধিক করে জ্বলতে থাকে বিদ্রোহীদের মন। নিজেদের সঠিকভাবে প্রস্তত করতে পার হয়ে যায় বেশ কয়েকটি বছর। অবশেষে ১৮৫০ সালে তাঁরা আবার কাজ শুরু করেন। নিজেদের আরও একটু প্রশিক্ষিত করে তাঁরা সমরক্ষেত্রে নামেন১৮৫৫সালের জুন মাসের ৩০ তারিখে। সিধু এবং কানু মুর্মুর নেতৃত্বেই তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন ইংরেজ বাহিনীর উপর। তিলকার মতোই আবার সেই তীর ধনুক ইত্যাদি নিয়েই ইংরেজদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে শুরু হয় মুর্মু ভাইদের সেই লড়াই।
সেই সময় ইংরেজ সরকারের শোষণ এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে সাধারণ মানুষের সমস্ত সম্পত্তিই তারা গ্ৰাস করে নিচ্ছিল। শুধু তাই নয় তারপর তাদের আবার নজর পড়ছিল বাড়ীর মেয়েদের দিকেও। সিধু- কানুরা লক্ষ্য করছিলেন সবকিছুই , আর সময় এবং সুযোগ বুঝেই তাঁরা আক্রমণ করলেন ইংরেজদের।
১৮৫৫ সালের ৩০ শে জুন সিধু এবং কানু তাঁদের বিশাল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে চললেন কলকাতার উদ্দেশ্যে। টনক নড়ল ইংরেজ সরকারের। পথিমধ্যেই তারা আটকাবার চেষ্টা করল সাঁওতাল বাহিনীকে। ফলে শুরু হলো যুদ্ধ। ইংরেজ সরকার সিধু বাহিনীর উপর অন্যায়ভাবেই জারি করার চেষ্টা করল অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা। সেটা অগ্ৰাহ্য করেই কিন্তু এগিয়ে চললেন সিধু- কানুর বাহিনী। ফলে বাড়ল যুদ্ধের উত্তাপটাও।
যুদ্ধ চলেছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। সিধুদের যুদ্ধের রসদ ছিল খুবই কম। তাই একটা সময় তাঁরা একটু চিন্তিত হয়েও পড়েছিলেন। আর তাছাড়া শুধুমাত্র তীর ধনুক বা লাঠি, বল্লম নিয়ে ক্ষমতাধর ইংরেজ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশিদিন লড়াই করাও যে সম্ভব নয় সেটা বুঝতেও পেরেছিলেন সকলেই। কিন্তু সব জেনেশুনেও ভেঙ্গে পড়েননি কেউই। জীবন যায় যাক , হার মানবেন না তাঁরা কিছুতেই।
যুদ্ধ চলছিল ঠিক ঠিকভাবেই। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক কয়েকজন অনুচরের অসহযোগিতা সেই প্রচেষ্টাকে একেবারেই শেষ করে দেয়। তারাই।ষড়যন্ত্র করে প্রমথে ধরিয়ে দেয় সিধুকে। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্ৰেপ্তার করা হয় তাঁকে। তারপর গুলি করেই নৃসংভাবে হত্যাও করা হয়। এরপর কানুর পালা। বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন তিনিও। গ্ৰেপ্তার করার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই ফাঁসির হুকুম হয় তাঁর।
সিধু- কানু শহীদ হবার পর সাঁওতাল বিদ্রোহের ঝাঁঝ যে অনেকটাই কমে গিয়েছিল তা বলা যেতেই পারে। কিন্তু তা যে একেবারেই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল তার নিশ্চয়ই বলা যাবে না। আর সংগ্ৰামের সেই তেজ যে ব্রিটিশ সরকারের মসনদকে একেবারেই টালমাটাল করে তুলেছিল তা স্বীকার করে নিয়েছেন সকলেই। আর সবচেয়ে বড় কথা , সেই বিদ্রোহের রেশ কাটতে না কাটতেই স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল আরও একটি সংগঠন। ১৮৫৭ সালের ১০ ই মে শুরু হয়েছিল যে সিপাহী বিদ্রোহ , সেটাই তো তখন অশনি সংকেত হিসেবে হাজির হয়েছিল ব্রিটিশদের কাছে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct