পাভেল আখতার: আরেকটি বছর শেষ হতে চলল। আর মাত্র দুটি দিন। তারপর সূচনা হবে নতুন একটি বছরের। নানা শপথ, সংকল্প ইত্যাদি নেওয়া হবে। এই ঐতিহ্য বহমান। সেইসব শপথ বা সংকল্প কতটা বাস্তবায়িত হয় তা নিয়ে অবশ্য সংশয় আছে। সময়ের হিসেবে একটি বছর দীর্ঘ সময়। হয়তো সংকল্প সাধনের পথে সেটাও একটা বাধা। তার চেয়ে যদি দিনের হিসেবটাই মাথায় থাকে--আজকের রাতটির অবসানে আগামীকাল যে নতুন একটি দিনের উদয় হবে তার জন্য আজ রাতেই কিছু শপথ, সংকল্প কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়া ; ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ যাওয়ার মুহূর্তে, তাহলে সেটাই বোধহয় সবচেয়ে ভাল হয়। এজন্য কি কি করণীয়? রাত্রির নিস্তব্ধতায় শান্ত মনে গোটা দিনটিকে একবার ভাল করে ‘দেখে নেওয়া’। কোথায় কি কি ‘ভুলত্রুটি’ হয়েছে, কতটা ‘নীচে’ নামা গেছে, যেখানে সহানুভূতি দেখানো দরকার ছিল সেখানে নীরবতা কিংবা সন্তর্পণে পলায়নপ্রিয়তা অবলম্বিত হয়েছে কি না, সততার পরিবর্তে অসততা, কিংবা ছলনা বা মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে কি না, আর্ত-অসহায় মানুষের হাহাকার কতটা বিচলিত করেছে ইত্যাদি। ঘটা করে যে শপথ বা সংকল্পগুলো নেওয়া হয় সেগুলো দৃশ্যত যান্ত্রিক। তার চেয়ে জরুরি নয় কি সব ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করে নিজেকে ‘ভাল মানুষ’ হিসেবে জগৎ-সভায় উপস্থাপিত করার শপথ বা সংকল্প নেওয়া?
প্রত্যেকবার যারা সোৎসাহে ইংরেজি নতুন বছর উদযাপনের ‘প্রস্তুতি’ নেন তাদের উদ্দেশে শিবরাম চক্রবর্তীর একখানি ‘মূল্যবান বাণী’ উপহার দেওয়া যায় : ‘’এত যে নতুন বছর নতুন বছর করে সবাই পাগল হয়ে ওঠে তার কারণ আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি! কারণ, বহু বছর ধরে অক্লান্ত গবেষণার পর আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, কোনও নতুন বছরই ৩৬৫ দিনের বেশি টেকেনি!”
এই শিবরামীয় শ্লেষ কি একেবারেই অহেতুক? অনেক শপথ বা সংকল্প নিয়ে নতুন বছর শুরু হয়। অপরিমিত উল্লাস ও উন্মাদনায় নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। পারস্পরিক শুভেচ্ছা-বিনিময় হয়। আরও অনেক কিছুই হয়। কিন্তু বিনীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়--বলুন তো, ডিসেম্বরের শেষ দিন আর পয়লা জানুয়ারির মধ্যে পার্থক্যটি ঠিক কী এবং কোথায়? দুটি দিনের সূর্যোদয়ের রঙ কি আলাদা? কিংবা সূর্যাস্তের রঙ? বাতাসের বয়ে যাওয়া, নদীর স্রোতের ছন্দে কি কোনও পরিবর্তন দেখা যায়? জানি, সব প্রশ্নের উত্তরই না-বাচক। তাহলে? গাছ থেকে একটি পাতা ঝরে গেলে, তার সজীব শাখায় আরেকটি পাতার জন্ম হবে--এর মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই, উল্লাসেরও কিছু নেই, স্বভাবতই। তবে হ্যাঁ, আমগাছে যদি জামপাতার জন্ম/আগমন হ’ত, তাহলে দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে নৃত্য করা প্রশ্নবিদ্ধ হ’ত না। কিন্তু তা কি কখনও হয়? বস্তুত, বিদায় ও আগমন, প্রবেশ ও প্রস্থান তো প্রতিটি মুহূর্তেই জড়িয়ে রেখেছে আমাদের। আজ যে সূর্য ডুবে গেল, তার সাথেই তো নতুন একটি দিনের পূর্বাভাসও সে রেখে গেল। এ তো নিত্যদিনের যাওয়া-আসা। ‘বছর’ তো অনেকগুলো দিনেরই সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়। তাহলে কিসের টানে, কোন্ নতুনের আকর্ষণে নতুন বর্ষবরণের আমোদ ও উন্মাদনা? নতুন বছর শুরুর লগ্নে যান্ত্রিক শপথ বা সংকল্প বছর শেষেই আবার হারিয়ে যায়! সেটাই স্বাভাবিক। ‘কৃত্রিমতা’ কোনও শুভ দিগন্তে আমাদের উন্নীত করতে সক্ষম নয়। আর, অযৌক্তিক আনন্দ বা উল্লাস সম্পর্কে তো আগেই বলেছি---বিশেষত, আজও যখন বহু মানুষের জীবনে অষ্টপ্রহর মিশে আছে দারিদ্র, ক্ষুধা, অপুষ্টি ইত্যাদি বহুবিধ হাহাকার ; নানা অসহায়তা, বিপন্নতার গ্লানিতে কণ্টকিত, ধূসর ও ম্লান যাদের জীবন, তাদের কথা ভাবলে এই নতুন বছরের আনন্দ-উল্লাস উদযাপন কেবল অর্থহীনই মনে হয় না, নিতান্ত স্বার্থপরের মতো কাজ মনে হয়! তাদের উদ্দেশে ‘শুভেচ্ছা’ জ্ঞাপনকেও মনে হয় নিষ্ঠুর রসিকতা---পঙ্গুকে পাহাড়ে ওঠার শুভেচ্ছা জানানোর মতো! মুশকিল এটাই যে, আমরা যা করার তা করি না বা করতে চাই না, আর যা করার নয় সেটাই করার জন্য মেতে উঠি!
“যার দুটি দিন সমান গেল সে ক্ষতিগ্রস্ত!” বলেছিলেন হযরত মহম্মদ (সা.। আমাদের দিনের পর দিন যায়, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর! একই ছন্দে, একই লয়ে, একই ইতিহাসের ধারা পরিক্রমায়! সেই এক ইগো, এক অহং, এক ক্রোধ, এক স্বার্থপরতা, এক অসহিষ্ণুতা, এক সম্পর্ক ভাঙনের ঘাটে ঘাটে নোঙর ফেলায়! তারপরও আমরা কোন্ নতুনের উদযাপন করতে চাই তা বিস্ময়কর!
পুনশ্চ : পরিশেষে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাবু’ অবলম্বনে লেখা যাক :
জনমেজয় কহিলেন, ‘’আপনি বলিলেন যে, বাঙালি জাতি ইংরেজি নতুন বছর সাড়ম্বরে উদযাপন করিতে থাকিবে। এবং, তাহার একটি অঙ্গ হইবে নতুন বছরের কতিপয় ‘শপথ গ্রহণ’। ইহা আমার নিকট কিঞ্চিৎ দুর্বোধ্য। আপনি কি আমাকে এই বিষয়ে সহায়তা করিতে পারেন?’’
বৈশম্পায়ন উত্তর দিলেন : ‘’মহাশয়, বিলক্ষণ পারি। উত্তর-আধুনিক যুগে ‘শপথ’ বস্তুটি গৃহীত হইবে বিপরীত কর্মটি করিবার নিমিত্তে। ‘মহাজনরা’ আপন মনের নিভৃতে একটি ইচ্ছাকে গোপন রাখিয়া অপর একটি ইচ্ছা যখন প্রকাশ্যে ব্যক্ত করিবেন তখন তাহাকে বলা হইবে ‘শপথ’।’’
জনমেজয় বলিলেন : ‘’হে ঋষিবর, আপনি বিষয়টি আমার নিকট ক্রমে আরও দুর্বোধ্য করিয়া তুলিতেছেন!’’
বৈশম্পায়ন আবার বলিলেন : ‘’হে রাজন, আপনার অবস্থা বুঝিতেছি। আপনি শ্রবণ করুন। ক্রমে ‘আলো’ আসিবে। সরলার্থ করিবার নিমিত্তে উদাহরণ উপস্থিত করিতে হয়। ধরুন, কেহ শপথ লইবে যে, সে নতুন বছরে বৃক্ষরোপণ করিবে। কিন্তু, আসলে সে বৃক্ষচ্ছেদ করিবে। তাহার পর..।’’
যৎপরোনাস্তি বিচলিত হইয়া জনমেজয় জিজ্ঞাসা করিলেন : ‘’কিন্তু এই প্রকার বৈপরীত্যের হেতু কী, হে পণ্ডিতপ্রবর?’’
স্বভাবগাম্ভীর্য আর ধরিয়া রাখিতে পারিলেন না। বৈশম্পায়ন মৃদু হাস্য করিয়া বলিলেন : ‘’উত্তর-আধুনিক যুগের একটি লক্ষণ হইবে--’প্রদর্শনী’। যে যত অধিক ‘আত্মপ্রদর্শন’ করিতে পারিবে সে তত অধিক ‘আদর’ ও ‘কদর’ পাইবে। ‘আত্মদর্শন’ নয়, ‘আত্মপ্রদর্শন’ হইবে উত্তর-আধুনিক যুগের ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের পূজ্য বস্তু।’’
জনমেজয় ভাবিতে লাগিলেন ।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct