দেশভাগের পর দেশ ছাড়া মনমোহন সিংহয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক উপদেষ্টা থেকে দেশের দুবারের প্রধানমন্ত্রী, প্রত্যেকটা পদক্ষেপ তার নিজের কৃতিত্বে এবং ব্যক্তিগত দক্ষতায় শিক্ষা জগৎ থেকে এসে হাসিল করা রাজনীতির রণাঙ্গনে বিজয়ীর শিরোপা। লিখেছেন তন্ময় সিংহ।
“আমি প্যারাস্যুটে নামিনি। লিফটে উঠিনি। সিঁড়ি ভেঙে উঠেছি।”
অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বারবার ব্যবহার করা এই জনপ্রিয় শব্দবন্ধ যদি কারো ক্ষেত্রে সর্বাধিক উপযুক্ত হয়ে থাকে তিনি ভারতীয় রাজনীতির সর্দারজী ডঃ মনমোহন সিংহ। শুভেন্দু অধিকারীর ক্ষেত্রে তবুও পিতা শিশির অধিকারীর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, তাকে সাপ লুডোর খেলাতে সব সময় রক্ষা করে সিঁড়ি ভেঙ্গে এগিয়ে দিয়েছে অন্তত রাজ্য স্তরে সফলতার দিকে। কিন্তু দেশভাগের পর দেশ ছাড়া মনমোহন সিংহয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক উপদেষ্টা থেকে দেশের দুবারের প্রধানমন্ত্রী, প্রত্যেকটা পদক্ষেপ তার নিজের কৃতিত্বে এবং ব্যক্তিগত দক্ষতায় শিক্ষা জগৎ থেকে এসে হাসিল করা রাজনীতির রণাঙ্গনে বিজয়ীর শিরোপা। তার মৌন থাকা নিয়ে যত “মিম” ই তৈরি হোক না কেন, এই অজাত শত্রুর কৃতিত্ব নিয়ে যে কোনো পক্ষই সন্দিহান ছিল না, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তাকে মৌন বলে বিরোধীদের কোপে পড়া এই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে মাঝে মাঝে ফোন করতেন, তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জানানো শ্রদ্ধার্ঘ্য।
আসলে আমরা যাকে মৌন হিসেবে দেখেছি, বা মোবাইল পরবর্তী ভারতে আইটি সেল যার দক্ষতা নিয়ে মিম তৈরি করে এই চরিত্রটিকে উপহাসের পাত্র করার চেষ্টা করেছে, হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি গবেষকরা এক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার আখ্যা দিয়েছেন, তিনি কিন্তু রাজনীতির প্রত্যেকটি ধাপ অতিক্রম করে এই জায়গায় পৌঁছেছিলেন। হয়তো জননেতা এবং বক্তা হিসেবে তিনি তাঁর পূর্বসূরী এবং উত্তরসূরীর তুলনায় মিয়ম্রান। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং সফলভাবে দক্ষতার সাথে ভারতকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বনির্ভর করার জন্য স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে তিনি একক কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন, তার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গুলির জন্য। তাঁর আমলেই ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার সর্বাধিক নয় শতাংশে পৌঁছায় এবং ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নশীল দেশের শিরোপা পায়। প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে দ্বিতীয় ইউপি সরকারের আমলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনেক বেশি ছিল এবং তিনি ২০১৪ এর লোকসভা নির্বাচনের পূর্বেই ঘোষণা করেছিলেন, যে এবার তিনি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নন। আসলে ওই সময় আইটি সেল, ফেক নিউজ ও হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে ধারণা ও অভিজ্ঞতা কম থাকায় এবং বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়াই তাঁর আমলের সমস্ত ভালো কাজ নির্বাচনের ময়দানে আলোচিত হয়নি। হাসির খোরাক হতে হয়েছিল সর্দার জী কে। প্রণব মুখোপাধ্যায় কে রাজনীতি ত্যাগ করিয়ে রাষ্ট্রপতি করে দেওয়া ও রাহুল গান্ধীর কিছু ব্যক্তিগত ভুল ও আবেগী সিদ্ধান্তের মূল্য দিতে হয়েছিল ইউপিএ টু কে।
ভারতের প্রথম অহিন্দু প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি মনমোহন সিংহ পরাধীন ভারতে অধুনা পাকিস্তানের অন্তর্গত পাঞ্জাবের গাহ তে জন্ম নেন। সর্দারকে দেশভাগের সময় অমৃতসরে চলে আসতে হয়। শৈশবের মাকে হারানোর ক্ষত, কৈশোরে জন্মভূমি হারানোর ক্ষত নিয়ে বড় হতে থাকা মনমোহন সিংহ শোনা যায় কোনদিন পরীক্ষাতে দ্বিতীয় হননি। ১৯৫২ ও ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পান মনমোহন। এরপর ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জোনস কলেজে পড়াশোনা করতে গিয়ে ১৯৫৫ ও ১৯৫৬ তে রাইটস পুরস্কার পান এবং ১৯৬২ তে অক্সফোর্ড থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী পান মনমোহন। আজও তার নামে ছাত্র বৃত্তি চালু আছে সেন্ট জোনস কলেজে। প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রপুঞ্জের কাজে যুক্ত হয়ে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে চলে আসেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ করার জন্য। গুরুশরন কাউরকে বিবাহ করেন তিন সন্তানের জনক মনমোহন।
ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ইতিহাসে পরিবর্তন এবং যুগান্তকারী অধ্যায় সূচনা করেছিলেন মনমোহন সিংহ। শুধুমাত্র অর্থমন্ত্রী হিসেবেই তার স্থান ভারতবর্ষের স্বাধীনতাত্তোর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর বর্ণময় ক্যারিয়ারের সূচনা করেছিলেন ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে ১৯৭২ এরপর অর্থ ও বাণিজ্য দপ্তরের সচিব হন ১৯৭৬ এ। পরবর্তীকালে ১৯৮২ তে রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর হয়ে। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত তিনি ভারতের যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সাউথ কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি ছিলেন জেনেভা তে। ১৯৯০ দেশে ফিরে অ কংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ এর আর্থিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৯১ এ ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনের চেয়ারম্যান থাকতে থাকতেই মোড় ঘুরে যায় মনমোহন সিংয়ের ক্যারিয়ারের। শিক্ষাবিদ থেকে রাজনীতিবিদ হিসেবে নতুন ইনিংস সূচনা করেন নরসিমা রাওয়ের এক রাতের টেলিফোনে, ওই সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ওই বছরের জুন মাস থেকে।
ভারতের অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা অর্থাৎ মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রচলন করেন মনমোহন সিংহ। লাইসেন্স রাজ ব্যবস্থার অবলুপ্তি দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসে, সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে বেসরকারিকরণ করা শুরু হয়। এই সময় থেকে রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে তিনি কার্যক্রম শুরু করেন। বাজপেয়ী সরকারের আমলে তিনি রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা ছিলেন। ২০০৪ এর নির্বাচনে “সাইনিং ইন্ডিয়া” স্লোগান নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতার দখল নিতে চাওয়া বিজেপির আকস্মিক পরাজয়ের ফলে কংগ্রেস লোকসভার সর্বাধিক সাংসদের দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বিদেশিনী ইস্যু নিয়ে জর্জরিত সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেস কে নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতায় আনলেও দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে চাননি। সেই সময়কার দুজন বাগ্মী নেতা প্রনব মুখোপাধ্যায় ও মনমোহন সিংহের মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দে প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিংহ। রাজনীতির অঙ্গনে শুরু হয় বিরোধীদের নতুন প্রচার সুপার প্রাইম মিনিস্টার। ব্যক্তিগত জীবনে মিতভাষী মনমোহন সিংহের দশ বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ভারতবর্ষের আর্থিক সংস্কার এবং পারমাণবিক চুক্তি। ২০০৮ এর বিশ্বব্যাপী মন্দার গ্রাস ভারতকে ছুঁতে দেননি, বরং ৯ এর কাছাকাছি বৃদ্ধির হার নিয়ে ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের দ্বিতীয় দ্রুত বৃদ্ধি প্রাপ্ত উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি হিসেবে এগিয়ে গেছেন।
অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকারের চাঙ্গা অর্থনীতির সুফল তুলে প্রথমেই “MGNREGA” চালু করে ফায়দা তুলে সিপিএম। প্রথম ইউপিএ সরকারের শেষ আমলে মুলায়ম সিংহ যাদবকে সাথে নিয়ে প্রকাশ কারাট আমেরিকার সাথে পারমাণবিক চুক্তি আটকাতে ছিলেন বদ্ধপরিকর। প্রণব মুখার্জি সরকারে পদাধিকারী হিসেবে জুনিয়র হলেও, তিনি কংগ্রেসের চিরাচরিত ক্রাইসিস ম্যান ও মনমোহন সিংয়ের স্যার। নিজের বাসভবনে প্রকাশ কারাত ও সীতারাম ইয়েচুরিকে তিনি অনুরোধ ও নিষেধ করেন পরমাণু চুক্তি নিয়ে জেদ করে সমর্থন তুলে না নেওয়ার জন্য। সর্দার জী বদ্ধপরিকর দেখে, প্রণব জানান যে এর ফলে আগামী বিধানসভায় সমস্যায় পড়বে সিপিএম। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ হিসেবে ছিলেন একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সাংসদ সংখ্যা বেড়ে হয় ১ থেকে ১৮ এবং ২০১১ তে পশ্চিমবঙ্গে ৩৫ বছরের পুরনো বাম সরকারের পতন ঘটে। যার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল জুলাই মাসের ৯ তারিখে ইউপিএ টু থেকে সমর্থন তুলে নেওয়া প্রকাশ কারাটের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। সর্দারজীর দৃঢ় সিদ্ধান্তে বাধা হয়ে বামফ্রন্টের অন্তর্জলী যাত্রাতে সীলমোহর দিয়েছিলেন প্রকাশ কারাট। যা পরবর্তীতে আরেকবার ঐতিহাসিক ভুল হিসেবে গণ্য হবে। মনমোহন সিংহ এপিজে আবদুল কালামের মাধ্যমে মুলায়ম সিংহ যাদব কে বোঝাতে সমর্থন হবেন, দরকারের সময় মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল পাশে আসবে এবং বিজেপির থেকেও ১০ জনের মতো সাংসদ ক্রস ভোটিং করে লোকসভায় সর্দারের উঁচু মাথা অক্ষুন্ন রাখবে বিশ্বের দরবারে। আমেরিকার সাথে ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তিতে সই করবে ভারত।
সোনিয়া গান্ধী সুপার প্রাইম মিনিস্টার, ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার নির্দেশ ছাড়া ঘাড় হেলাতে পারতেন না মনমোহন, এইসব একগুচ্ছ অভিযোগ নিয়ে ২০১৪এর ২৬ শে মে শেষ বারের মতন দিল্লির প্রধানমন্ত্রী দপ্তর থেকে বেরিয়ে যান এই সাইলেন্ট সিংহ। তারপর থেকে কয়েকবার মুখ খুলেছেন তিনি। শুধু সমালোচনা নয়, আর্থিক নীতি নিয়ে তার পরামর্শ দিয়েছেন পরবর্তী সরকারকে। দৃপ্ত ভাষায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন “নোট বন্দী” ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ভারতীয় অর্থনীতিতে বিপর্যস্ত করবে। তাই কাগজে-কলমে যাই হোক না কেন ভারতীয় অর্থনীতি সেই সময় থেকে আর অগ্রগতির রাস্তায় চলতে পারেনি, কোভিড এসে বিশ্বব্যাপী মন্দার আঁচে সমস্ত ভারতবর্ষকে গ্রাস করেছে। একদা পেট্রো পণ্য ও গ্যাসের দাম তার আমলে বাড়ার জন্য দিল্লির বুকে ধর্নায় বসা নেত্রীরা পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যেই গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বাড়িয়ে এক হাজারে পেট্রোলের দাম ১০০ পার করে দিয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর বিশ্ব জুড়ে আসা শোকবার্তায় তাই বারবার ছুঁয়ে গেছে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মনমোহন সিংয়ের প্রাজ্ঞতার কথা। আইটি সেলের আজ অন্তত একবার স্মরণ করা উচিত এই সাইলেন্ট সিংহ ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার গ্রাস থেকে ভারতকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সাইলেন্ট সর্দারজী তাঁর মস্তিষ্কের গর্জন দিয়ে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct