তন্ময় সিংহ: “গিরতে হুয়ে শের সওয়ারি ময়দানি জঙ্গ মে,
ও জিসম কেয়া গিরে যো ঘুটনোকি বল চলে”
শাহরুখ খানের প্রিয় শায়েরির মতো অশ্বিন জানিয়ে দিলেন ভারতের হয়ে বুটজোড়া তুলে রাখছেন তিনি ঠিকই, কিন্তু ক্রিকেট এখনও তার মধ্যে রয়ে গেলো, যা তিনি ক্লাব ক্রিকেটে দেখাবেন। আসলে এই দেড় মিনিটের সাংবাদিক সম্মেলনে যে গোটা ভারতবর্ষ বজ্রাহত হতে চলেছে তার আভাস বৃষ্টি ভেজা গাব্বার টিভির পর্দায় দেখা গেল যখন কোলাকুলি করছেন বিরাট ও অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে থাকা রবিচন্দ্রন অশ্বিন। বৃষ্টির জন্য খেলা সম্পূর্ণ না হওয়ায় সাংবাদিক সম্মেলন করতে রোহিত শর্মার সাথে এলেন তিনি এবং উপস্থিত সাংবাদিক কূলের সাথে টিভির পর্দায় চোখ রাখা ও পরবর্তীতে আপামর দেশ কালের সীমারেখা ছাড়িয়ে ক্রিকেটপ্রেমী চমকে উঠবে ওই দেড় মিনিটের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে -আজকেই আমার শেষ দিন, ভারতের ক্রিকেটার হিসেবে, আগামীকাল আমি দেশে ফিরছি। ভারতীয় ক্রিকেটে অশ্বিনের অবদান মাত্র একটি পরিসংখ্যানেই পরিষ্কার করে দেওয়া যায়, তাঁর সমসাময়িক ক্রিকেটার বিরাট কোহলি, টেস্ট ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত তিনটি ম্যান অব দ্য সিরিজ হয়েছেন সেখানে রবিচন্দ্রন অশ্বিন এগারোটা ম্যান অব দ্যা সিরিজ হয়েছেন। আর ক্রিকেটের ইতিহাসে টেস্ট ক্রিকেটের গুরুত্ব বুঝতে এবারের গাব্বার ওই ফ্রেমটিই যথেষ্ট যখন গাব্বায় হুক করে চার মারলেন আকাশ দীপ সিংহ, টিভি ক্যামেরা তাক করলো গৌতম গম্ভীর, বিরাট কোহলি এবং রোহিত শর্মার উচ্ছ্বাস কে, যুদ্ধ জয়য়ের আনন্দ ফুটে উঠলো ভারতের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদদের মুখে চোখে সামান্য একটা ফলো অন বাঁচিয়ে। সেই টেস্ট ক্রিকেটে বিগত পনের বছরে ভারতের সর্বকালের সেরা ম্যাচ উইনার কিন্তু রবিচন্দ্রন অশ্বিনই।
বক্সিং ডে টেস্টের জন্য বিমানের টিকিট কাটা ছিলো বাবার। হাঁটুর সমস্যা এবং সামনে ভারতের ঘরের মাঠে কোন সিরিজ না থাকায় এবং বহুদিন ধরে ভারতের ম্যানেজমেন্ট দ্বারা অবহেলিত হতে হতে হয়তো রবিচন্দ্রন অশ্বিন দেশের হয়ে ক্রিকেট বুট তুলে রাখতেন অভিশপ্ত নিউজিল্যান্ড সিরিজের পর। কিন্তু তিনি জানতেন হওয়া আর ঘোড়ার পিঠে যারা সওয়ার হয়, তাদের পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, আর যারা হামাগুড়ি দিচ্ছে তাদের পড়ার আর ভয় কি। শেষ পর্যন্ত তিনি চেপে বসেছিলেন পার্থের বিমানে। পার্থে বাদ পড়তেই ক্যাপ্টেন রোহিতের কাছে জানতে চান ম্যানেজমেন্টের তাকে নিয়ে ভাবনার কথা। রোহিত জানান অ্যাডিলেডে দিন রাতে টেস্টে তিনি তাঁকে চান। অ্যাডিলেডের দিনরাত্রির টেস্ট ম্যাচের পর, গাব্বায় বাদ পড়তেই বুদ্ধিমান অশ্বিন বুঝে যান বর্তমান টিম ম্যানেজমেন্ট প্রধান দুই স্পিনারের মধ্যেও ধরছে না তাঁকে। অথচ উল্টো দিকে অস্ট্রেলিয়া টিমে নিয়মিত লায়ন টেস্ট ম্যাচে এক ওভার বল করেও, এবং শুধুমাত্র বোলার হিসেবে। সেখানে ছটি সেঞ্চুরি থাকা ও অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ বাঁচানোর ইনিংসের অন্যতম কারিগর অশ্বিন কে বলি হতে হয় ভারতের টপ অর্ডারে অফ ফর্মে থাকা রাজপুত্র দের জায়গা করে দিতে দশ নম্বর পর্যন্ত ব্যাটসম্যান খেলানোর ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তের। তাই বাবা অস্ট্রেলিয়া আসার আগেই, অনেক প্রশ্ন তুলে ছেলে ফিরলেন চেন্নাই তে।
রবিচন্দ্রন অশ্বিন, সম্ভবত সেই বিরল পর্যায়ের ক্রিকেটার যার বাগ্মীতা মাঠ ও মাঠের বাইরেও প্রশ্নাতীত। গাব্বার ওই দেড় মিনিটের প্রেস কনফারেন্সেই লুকিয়ে রেখেছেন তার মনের মর্ম বেদনা যেখানে তিনি নিজেকে পারফর্ম করতে দেখতে চান ক্লাব ক্রিকেটে। কোন প্রশ্ন না নিলেও তার কথার মাঝেই খুলে গেছে অবসরের অনেক কারণ। ঘটনার আকস্মিকতায় সামনে এসেছে বিসিসিআইয়ের দুর্বলতা তার সেরা লগ্নির সফল পোস্টারবয় দের সাথে ব্যবহারে। আসলে শ্রীনিবাসনের জমানার পর, ক্রিকেট প্রশাসনে যে রাজনীতি করন হয়েছে তাতে খেলোয়াড়দের সাথে সঠিক ট্রিটমেন্ট দেওয়ার কথাই ভুলে গেছে বিসিসিআই। সকলেরই মূল ইচ্ছা শুধু আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়া ও বিগবসকে খুশি করতে পারা। ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে সৌরভ গাঙ্গুলীকে সরে যেতে হয়েছে অর্ধেক রাস্তাতেই। আর সমকালীন ক্রিকেট প্রশাসনে ও সমর্থকদের মধ্যে ব্যাটসম্যানদের জন্য বিশেষ সোনার চামচের ব্যবস্থা থাকলেও চ্যাম্পিয়ন বোলারদের জন্য সেই অনুরাগ চোখে পড়ে না। ভারতীয় ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানরা যেন আসল রাজপুত্র এবং বোলাররা অতীব সাধারন কেউ যাদের জন্য বোর্ডে, টিভি, মিডিয়া, বিজ্ঞাপনে কোথাও থাকেনা আওয়াজ। অন্যদিকে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন জগতের জন্যই বিসিসিআই বয়ে নিয়ে যেতে পারে ব্যাটিং সুপারস্টারদের। আবার বিজ্ঞাপন জগতে কদর না থাকায় রাহানে ও পূজারা দের পারফর্ম করেও ব্রাত্য থাকতে হয় টেস্ট দল থেকে। তবুও একশোর বেশি টেস্ট খেলা ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার রবিচন্দ্রন অশ্বিনের হঠাৎ অবসরে গতকাল থেকে দেশজুড়ে জনমানসে যে পরিমাণ আবেগের সৃষ্টি হয়েছে তা প্রশ্নাতীত। আসলে আপাদমস্তক ভদ্রলোক অশ্বিন তার ব্যক্তিগত প্রতিভা ছাড়াও ক্রিকেটের বাইরে পডকাস্ট, ইউটিউব ও ক্রিকেট সম্পর্কিত বিভিন্ন ইভেন্টের মাধ্যমে জনমানসে বিশেষ জায়গা দখল করে রেখেছিলেন। ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ড সিরিজ বাদ দিলে তার আগের সমস্ত খেলাতেই তার পারফরমেন্স ছিল সেরাদের মতই। তাই অশ্বিনের হঠাৎ অবসরে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে বিসিসিআই ও বর্তমান ম্যানেজমেন্টের প্রতি তীব্র ক্ষোভ। চোদ্দো বছর ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তার সাথে অবিচার হয়েছে টি-টোয়েন্টি এবং ওয়ানডেতে। কখনো অতিরিক্ত ব্যাটসম্যান খেলানোর আছিলায় কখনো অলরাউন্ডারের খোঁজে সহজ বলি দেওয়া হয়েছে রবিচন্দ্রন অশ্বিন কে। তার সময়কালের শ্রেষ্ঠ ব্যাটার বিরাট কোহলি প্রায় ৩০০ টি একদিনের ম্যাচ ও ১২৫টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা সৌভাগ্য পেলেও অশ্বিনের ক্ষেত্রে মাত্র ১১৬ টি একদিনের ম্যাচ খেলার ও ৬৫ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার সৌভাগ্য হয়। তিনি মনঃক্ষুন্ন হলেও এরপরে লাল বলের ক্রিকেটে অর্থাৎ টেস্ট ক্রিকেটে তার প্রতিভার অনন্য নজির রাখেন, ১০৬ টি টেস্ট ম্যাচ ক্রিকেটে ৫৩৭ টি উইকেট, ৬ টি সেঞ্চুরি সহ ৩৫০০ রান থাকা সত্ত্বেও কখনো রবীন্দ্র জাদেজাকে ভালো ব্যাটসম্যান অলরাউন্ডার হিসেবে জায়গা ছাড়তে এবং পরবর্তীতে ওয়াশিংটন সুন্দরকে জায়গা ছাড়তে টিম ম্যানেজমেন্ট এর সবচেয়ে সফট টার্গেট হয়ে যান উনি। শ্রীনিবাসনের পরে চেন্নাই লবিতে কোন গডফাদার না থাকাও কাল হয় অশ্বিনের। অশ্বিনের বাবা জানিয়েছেন বারবার অসম্মানিত হতে হতেই শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন রবি। ক্রিকেট জীবনে ব্যাটসম্যান হিসেবে শুরু করা ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্পিনার কে কিন্তু তার ক্যারাম বলের মতো রহস্যময় বলেই মনে করা হয় ক্রিকেট সার্কিটে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহল আন্দাজ করতে পেরেছিল এরকম কিছু ঘটনা ঘটবে, কিন্তু শেষ দুই টেস্ট স্পিন সহায়ক উইকেটে খেলা এরকম অবস্থায় হঠাৎ করে অশ্বিন অবসর ঘোষণা করে দেশে ফিরে আসবেন ভাবতে পারেননি কেউই। বাংলাদেশের সাথে ম্যান অব দ্য সিরিজ হওয়ার পর নিউজিল্যান্ডের সাথে বিপর্যয় ভারতীয় ক্রিকেটে দেশে অপরাজেয় এই তকমাতে ধাক্কা দেয়। অশ্বিন তাঁর নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে বলেছেন সে কথা। সাদা বল থেকে যখন তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল তখনও তাঁর উত্তর খুঁজে বেরিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম এই সেরা মস্তিষ্ক। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে নিয়ে গিয়ে প্রথম টেস্ট বসানোর পরে, দ্বিতীয় টেস্ট সুযোগ দিয়ে আবার তৃতীয় টেস্টে বসিয়ে দেওয়া ও ম্যানেজমেন্টের তৃতীয় স্পিনার হিসেবে তাকে ভাবা মানতে পারেননি তিনি। গাব্বার যে এই ঘোষণা হতে চলেছে তা জানতে পারেনি রোহিত শর্মা ও গৌতম গম্ভীর ছাড়া কেউই।
রবিচন্দ্রন অশ্বিনের হঠাৎ অবসর, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ভারতীয় ক্রিকেটে সিস্টেমে নায়ককে মর্যাদা দেওয়ার পদ্ধতিতে যে ঘাটতি আছে তা চোখে আঙুল দিয়ে আরেকবার দেখিয়ে দিয়েছে। অশ্বিনকে ক্রিকেট মাঠে অধিনায়ক হিসেবে কম দেখা গেলেও ,ক্রিকেটার হিসেবে বুদ্ধিদীপ্ত এবং আপাদমস্তক ভদ্রতার জন্যই তিনি সকলের আন্না। রবিচন্দ্রনের ক্ষুরধার মস্তিষ্ককে ভারতীয় ক্রিকেটের অধিনায়ক হিসেবে দেখতে না পাওয়া সম্ভবত ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য এক অপূরনীয় ক্ষতি, সাথে ভারতের ক্রিকেটের সিস্টেমে ব্যাটসম্যানদের আধিপত্যের দিকে আঙ্গুল তোল। যেখানে ফর্ম না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন জগতের জন্যই রাজপুত্রের খাতিরে দীর্ঘদিন ধরে দলে রাখা হয় ব্যাটসম্যানদের, বর্তমান ভারতীয় দলের সিনিয়র ব্যাটসম্যানরা এই সিস্টেমের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তবে ভারতীয় ক্রিকেট ম্যানেজমেন্টের তরফে শেষ দিন মাঠে অতিরিক্ত ফিল্ডার হিসেবেও সুযোগ না দেওয়া বা শেষ সম্মান না দেওয়া অশ্বিনের মতো তারকার জন্য কোন ভাবেই প্রাপ্য ছিল না। ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা ম্যাচ উইনারের প্রাপ্য মর্যাদা হয়তো আগামী দিনে আইপিএলের মাঠে চেন্নাইয়ের হয়ে আমরা দেখতে পাব। তবে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থার কার্য পদ্ধতি কে মিডিয়া ও দেশবাসীর প্রশ্নের সামনে আনলো অশ্বিনের এই রহস্যজনক অবসর।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct