আপনজন ডেস্ক: ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলতে দিচ্ছে না জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম। এই প্ল্যাটফর্ম দুটির মালিক প্রতিষ্ঠান মেটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষের কণ্ঠস্বরকে থামিয়ে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এমন অভিযোগ বহুদিনের। এবার আরো ফেসবুকের বিরুদ্ধে আরো বড় অভিযোগ উঠল। গাজায় ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের মধ্যে ফেসবুকে ফিলিস্তিনি সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন দর্শক-শ্রোতা ও পাঠকদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাতে দেয়া হচ্ছে না। ফিলিস্তিনি বিষয়ক খবর কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ফেসবুকের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি নির্যাতন-নিপীড়নের খবর প্রচার করা অ্যাকাউন্ট ও পোস্ট সরিয়ে ফেলার অভিযোগ বহু পুরনো। এর প্রতিবাদও হয়ে আসছে অনেক দিন ধরে। এরপর গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন শুরুর পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে জানায়, গাজায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হলেও কাউকে তাদের পক্ষে কথা বলতে দিচ্ছে না ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম। মালিক প্রতিষ্ঠান মেটা সিস্টেমেটিক্যালি ফিলিস্তিনের পক্ষের কণ্ঠস্বরকে ‘থামিয়ে বা নীরব’ করে দিচ্ছে। তবে মেটা বলেছে, ইচ্ছাকৃতভাবে নির্দিষ্ট কণ্ঠস্বর দমনের অভিযোগ ‘দ্ব্যর্থহীনভাবে মিথ্যা’। ফেসবুকের তথ্য-উপাত্তগুলো ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি। এতে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিম তীরের বার্তাকক্ষগুলোর সঙ্গে দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকদের মিথস্ক্রিয়া কমে গেছে। কিছু ফাঁস হওয়া নথিতে বিবিসি দেখতে পেয়েছে, মেটার মালিকানাধীন আরেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রাম কর্তৃপক্ষ ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে ফিলিস্তিন–সংক্রান্ত মন্তব্যগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হাতে গোনা কয়েকজন বহিরাগত সাংবাদিককে গাজা উপত্যকায় ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পাহারায় তারা ঢুকতে পেরেছেন। যারা গাজার অধিবাসীদের কথা শুনতে চান, তাদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কাছে প্যালেস্টাইন টিভি, ওয়াফা নিউজ এজেন্সি ও আল-ওয়াতান নিউজের মতো সংবাদমাধ্যমগুলোর ফেসবুক পেজ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদসূত্র হয়ে উঠেছে। এসব সংবাদমাধ্যম পশ্চিম তীরের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়।
ফিলিস্তিনভিত্তিক ২০টি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজে দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকদের সম্পৃক্ততা যাচাই করেছে বিবিসি নিউজ অ্যারাবিক। গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরুর আগে-পরের সম্পৃক্ততা যাচাই ও তুলনা করা হয়েছে। একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্ট কতটা প্রভাব ফেলছে ও কতজন লোক এর বিষয়বস্তু দেখছেন, তার একটি মূল পরিমাপক এনগেজমেন্ট বা সম্পৃক্ততা। মন্তব্য, প্রতিক্রিয়া জানানো ও পোস্ট শেয়ার করার মধ্য দিয়ে দর্শক, শ্রোতা ও পাঠক এসব মাধ্যমে সম্পৃক্ত হন।
যুদ্ধকালে অডিয়েন্স এনগেজমেন্ট বা শ্রোতা-পাঠক সম্পৃক্ততা বাড়বে বলে ধারণা করা হয়। অথচ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর ফিলিস্তিনি সংবাদমাধ্যমের পাঠক সম্পৃক্ততা ৭৭ শতাংশ কমেছে।
ফেসবুকে প্যালেস্টাইন টিভির ফলোয়ার (অনুসারী) সংখ্যা ৫৮ লাখ। টেলিভিশন চ্যানেলটির বার্তাকক্ষে নিযুক্ত সাংবাদিকেরা বলেছেন, আগে ফেসবুকে তাদের পোস্টগুলো যত মানুষের কাছে পৌঁছাত, সেই সংখ্যা এখন ৬০ শতাংশ কমে গেছে। এ সংবাদমাধ্যমের তারিক জিয়াদ নামের এক সাংবাদিক বলেন, ‘মিথস্ক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আছে এবং মানুষের কাছে আমাদের পোস্টগুলো পৌঁছানো বন্ধ হয়ে গেছে।’ ফিলিস্তিনি সাংবাদিকেরা অভিযোগ করে আসছেন, তাদের অনলাইন কনটেন্টগুলোর (আধেয়) ওপর ‘ছায়া নিষেধাজ্ঞা’ দিয়ে রেখেছে মেটা। আরো পরিষ্কার করে বললে, ফেসবুকে কতজন মানুষ কনটেন্টগুলো দেখতে পাবেন, তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে মেটা।
এ অভিযোগ যাচাই করতে ফেসবুকে ২০টি ইসরায়েলি সংবাদ সংস্থার পেজে একই ধরনের তধ্য বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি। এসব সংবাদমাধ্যমের মধ্যে আছে ইয়েদিওত আহরোনোত, ইসরায়েল হেয়োম ও চ্যানেল থার্টিন। দেখা গেছে, এগুলোর পেজে বিপুলসংখ্যক যুদ্ধ–সংক্রান্ত কনটেন্ট প্রকাশ করার পরও তাদের দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকের সংখ্যা প্রায় ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। ফিলিস্তিনি নাগরিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এর আগেও মেটার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল। বলেছিল, প্রতিষ্ঠানটি বস্তুনিষ্ঠভাবে অনলাইন তৎপরতা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২১ সালে কোম্পানিটির তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত এক স্বাধীন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইচ্ছাকৃতভাবে নয়; বরং মডারেটরদের মধ্যে আরবি ভাষাসংক্রান্ত দক্ষতার অভাব থাকায় এমনটা হচ্ছে। ভাষাদক্ষতা না থাকায় তারা নিরীহ শব্দ ও বাক্যাংশগুলোও আক্রমণাত্মক বা হিংসাত্মক হিসেবে ব্যাখ্যা করে ফেলেন। মেটা ভাষাসংক্রান্ত যে ব্যাখ্যাটি দিয়েছে, তা আসলে কতটুকু সত্য, তা জানতে অন্য জায়গার ৩০টি আরবি ভাষার সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজ নিয়ে একই বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct