সনাতন পাল: স্বপ্ন নিয়েই মানুষ বাঁচে। স্বপ্ন নিয়েই সে ঘর বাঁধে। স্বপ্নের কারণেই ঘরছাড়া হয়। মানুষই একে অপরের স্বপ্ন কে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। আবার সেই মানুষই মানুষকে স্বপ্ন পূরণে চলার পথ দেখায়। নিজের বলতে থাকে শুধু কর্ম। কর্মের ব্যপ্তি নির্ভর করে সামর্থ্যের উপরে। এই কর্ম এবং সামর্থ্যই মানুষকে শেষ পর্যন্ত স্বপ্নের রাজপ্রাসাদে পৌঁছে দেয়। সামর্থ্য কর্মকে যখন পিছুটানে তখন চলার পথে পা মচকে ব্যক্তি পড়ে যায়। সেখান থেকে উঠে আবার পূর্বের গতিতে চলা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে চলতে যদি কখনও সাফল্য এসে হাজির হয়, তখন মানসিক শক্তির বৃদ্ধি ঘটে, যা শারীরিক শক্তিকে বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এরূপ অবস্থাতে সেই সাফল্য সকলের সামনে আসবেই এমনটাও নয়। অর্থাৎ ব্যক্তির সামনে সময়ের ব্যবধানে নানা রকমের পরিস্থিতি আসবে। সব রকম পরিস্থিতিতে নিজেকে প্রস্তুত রাখাটা জরুরি হলেও সকলে সেটা করতে পারি না।
মন থেকে স্বপ্ন দেখা যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন বাঁচার আকাঙ্খাও আর থাকে না। সেই স্বপ্ন যখন ভেঙে যায় তখন হৃদয় বিদারক যে যন্ত্রণা সৃষ্টি হয়, সেই কষ্ট অনেক সময় এমন ভাবে মানুষের ইচ্ছের উপরে প্রভাব ফেলে যে ইচ্ছে তখন বাঁচার দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। স্বপ্ন ভাঙার শব্দের কম্পন হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন আমাদের মনের ভেতরে অনেক সময় দূরন্ত সমুদ্রের মত অসংখ্য ঢেউ সৃষ্টি হয়। সেই ঢেউয়ে দক্ষ নাবিকের মত আমরা কজনই বা জীবন তরী বইতে পারি!
আমেরিকান লেখিকা এ্যাশলি স্মিথ বলেছেন,” জীবন সৌন্দর্যে পূর্ণ। মৌমাছির দিকে তাকাও, শিশুরদের হাসি মুখের দিকে তাকাও। বৃষ্টির ঘ্রাণ নাও, বাতাসের স্পর্শ নাও। জীবন কে পূর্ণ ভাবে উপভোগ করো আর নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রয়োজনে লড়াই করো।” একথা যেমন অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, তেমনি বিশ্বখ্যাত মনোবিজ্ঞানী আলবার্ট ইলেসের এই কথাও মিথ্যে নয়, “তোমার জীবনের সেরা মূহুর্ত সেটাই যখন তুমি বুঝবে যে, তোমার সমস্যার দায় তোমার একার। যখন তুমি বুঝবে তোমার সমস্যার জন্য তোমার অভিভাবক, সমাজ বা সরকার দায়ী নয়। যখন তুমি বুঝবে, তোমার স্বপ্ন তোমাকেই পূরণ করতে হবে।” কিন্তু বাস্তবে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণাও কম নয়। অনেক সময় স্বপ্ন ভেঙে গেলে ভেঙে যাওয়া পাখির বাসার মত জীবনটাও ছন্নছাড়া হয়ে যায়।
আমারা নদীর পাড় ভাঙার শব্দ হয়তো অনেকেই শুনেছি। ভাষার আধুনিক ভাবধারায় নানা কায়দায় বাক্যে বিভিন্ন শব্দের প্রয়োগ ঘটিয়ে নিজের মতো করে সে দৃশ্যের বর্ণনাও হয়তো অনেকে করতে পারবেন। সেই বর্ণনা থেকে দূরের অনেকে সেই দৃশ্য সম্পর্কে অনেকটা ধারণাও করতে পারবেন। কিন্তু প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের হাজার হাজার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, সেই শব্দ কি কেউ কখনও শুনেছি? উত্তর টা ‘না ‘হবে। কারণ স্বপ্ন ভাঙার শব্দ কখনও কানে শোনা যায় না, সেটা কেবল হৃদয় দিয়েই অনুভব করতে হয়। আর এই অনুভূতি যার যত বেশি তাঁর মনের যন্ত্রণাও তত বেশি। স্বপ্ন ভাঙে তখনই যখন দেখা স্বপ্ন কে বাস্তবায়িত করার জন্য ব্যক্তির ভেতর সামর্থ্য থাকে না। কিন্তু স্বপ্ন এমন একটা বিষয় যা কার্যকরী করার সামর্থ্য না থাকলেও সেই ব্যক্তির স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয় না। মন তো কারো কথা শোনে না, সে তো আপন খেয়ালেই চলে। আশা-প্রত্যাশাকে বাস্তব রূপ দেবার সামর্থ্যের দূরত্ব যত বাড়বে স্বপ্ন তত ভেঙে গুড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরী হবে, এমনটা ঘটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বপ্ন যখন ভেঙে যায়, তখন তার প্রভাব বিভিন্ন ব্যক্তির উপর বিভিন্ন রূপ হয়ে থাকে। যে ব্যক্তির স্বপ্ন ভেঙে যায় তাঁর হৃদয় দুঃখে পরিপূর্ণ অবশ্যই হয়। কারো চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে, আবার কারো ছল ছল করে চোখেই রয়ে যায়, গড়িয়ে পড়ার সুযোগ হয় না।
ব্যক্তির উপর স্বয়ং-য়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। কেউ কেউ ভাঙা স্বপ্ন কে আঁকড়ে ধরে বাঁচে আবার কেউ কেউ ভাঙা স্বপ্নের সাথে খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। স্বপ্নের নগরীতে রাজপ্রাসাদ সকলেই নির্মাণ করতে সক্ষম হতে পারবেই এমনটা নাও ঘটতে পারে। কিন্তু যদি সে পারবে না বলে স্বপ্নটাই না দ্যাখে তাহলে জীবনে বড় হবার প্রয়াস করার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। এই নির্মাণ যাঁরা করতে পারেন না ব্যর্থতা তাঁদের অবশ্যই ঘিরে ধরে। বহু ব্যক্তি আছেন, যাঁরা জীবন ভর চেষ্টা করলেও সেই ব্যর্থতা থেকে সফলতায় পৌঁছাতে পারেন না। এক্ষেত্রে শুধু ব্যক্তির সামর্থ্য কে দায়ী করলেই চলবে না। কারণ কিছু স্বপ্নের ধরনটাই এমন যা, ভেঙে গেলে আর কখনও জোড়া লাগে না। বেকার ছেলেটির প্রণয়ের ফুল মিলনের মালা হতে তখনই পারে না,যখনই মিলনে শর্ত হিসেবে চাপানো সরকারি চাকুরি টা না পায়। বাস্তবিক অর্থে সত্যি তো এটিই যে, সম্পর্কের মধ্যে যখনই শর্ত চাপানো হয় তখন তার মধ্যে যান্ত্রিকতা অবশ্যই দেখা দেবে। আর যান্ত্রিকতা দেখা দিলে সেটি ভঙ্গুর হবেই। এক্ষেত্রে বুদ্ধির অধিক প্রয়োগ ঘটলে সম্পর্কের মধ্যে সরলতা বলে বিশ্বাসের যে সুতো থাকে, সেটি উভয় দিক হতে টানাটানি করতে করতে একটা সময় আসবে, যখন তার স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে ছিঁড়ে যাবে। সম্পর্কের বস্তার মুখ বাঁধা থাকে বিশ্বাসের সুতো দিয়েই। এই সুতোর শক্তি কতটা শক্ত হবে সেটা সব সময়েই নির্ভর করে ব্যক্তির মানসিক স্থিতির উপরে। এই স্থিতি অনেকাংশেই নির্ভর করে সম্পর্কের প্রতি সম্মান বোধ এবং মানসিক চাহিদার উপরে। এই বোধ পৃথিবীর সমস্ত মানুষেরই সমান হবে, এমনটা নয়। আবার কেউ কেউ হয়তো ভেবেছেন যে ডাক্তার হবেন, কিন্তু অর্থের অভাবে বা পরিস্থিতির চাপে সেটা হতে পারলেন না। এক্ষেত্রে যেমন স্বপ্ন ভেঙে যায় তেমনি সমাজে নানা বিধ বিষয়ে শর্ত পূরণ না হয় তখন স্বপ্ন ধীরে ধীরে ব্যক্তির জীবন থেকে হারিয়ে যায়। তবে প্রথম থেকেই যদি দার্শনিক রাফাল ওয়ালাডো এমারসনের উক্তি মেনে চলা যায় তাতে মনের জোর অনেক খানি বেশি পাওয়া যাবে বলেই মনে হয়, “ পথ যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই যেও না। যে দিকে কোনো পথ নেই, সেদিকে হাঁটো এবং নিজের চিহ্ন রেখে যাও।”
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct