সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়: কোনও অপরাধমূলক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ কাউকে ধরতেই পারে। সেই গ্রেফতার একজন কিম্বা অনেকের অভিযোগের ভিত্তিতে হতে পারে অথবা স্রেফ সন্দেহ বা অনুমানের ওপরও হতে পারে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে এটা পুলিসের কাজের মধ্যে পড়ে। এরপর পুলিশ ওই ধৃত ব্যক্তিকে আদালতে চালান করে। যদি ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য ধারায় অভিযোগ থাকে,তাহলে মহামান্য আদালত তাঁর জামিনের নির্দেশ দেন এবং ধৃত ব্যক্তি হাজতের বাইরে মুক্ত পৃথিবীতে আসতে পারেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আদালতে জামিনের নির্দেশের পরও কি সবার ভাগ্যে মুক্ত পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য হয় ? ধৃত ব্যক্তি যদি ভিন রাজ্যের বাসিন্দা হন এবং পরিবারের লোক কাছে না থাকে তখন তাঁর কি ভয়াবহ অবস্থা হয় ?
উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা প্রায় ৭০ বছরের বৃদ্ধা বাসন্তী দেবীকে যে অভিযোগে জেলে বন্দি করা হয়েছিল, সেই অভিযোগে দোষী প্রমাণিত হলেও সর্বোচ্চ শাস্তি হয় ৭ বছরের জেল। অথচ বিচারাধীন বন্দি হয়েই বাসন্তী দেবীর জীবনের ১০ বছর কেটে গেল বদ্ধ কারাগারে। কারণ, গ্রেফতার হওয়ার পরে নিম্ন আদালতে তাঁর জামিনের আদেশ হলেও ভিন রাজ্যের বাসিন্দা হওয়ায় এবং পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় জামিনের শর্ত অনুযায়ী কোনও জামিনদার ২০০০ টাকা দিতে রাজি হননি।
সুদূর উত্তর প্রদেশ থেকে মায়ের খোঁজে বাসন্তী দেবীর ছেলে দমদম সেন্ট্রাল জেলে এলেও কেউ তাঁকে মায়ের খোঁজ দিতে পারেনি এবং সন্ধান আনার জন্য উদ্যোগীও হয়নি। সৌভাগ্যক্রমে ঘটনাটি দক্ষিণ ২৪ পরগণার লিগাল এইড ডিফেন্স কাউন্সিলের আইনজীবি “সেঁজুতি চক্রবর্তী”-র নজরে আসার পর,তিনি বাসন্তী দেবীর মুক্তির জন্য উদ্যোগ নেন।
ভিন রাজ্যের বন্দিদের দুর্দশার কথা উঠলে যে অভাগা মহিলার কথা অন্তরকে ভীষণভাবে বিদ্ধ করে তিনি হলেন অন্ধ্রপ্রদেশের মানুষ ও তেলেগুভাষী লক্ষ্মী চিন্তলপুরী। উত্তর কলকাতায় একজন যুবকের খুনের ঘটনায় স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে পুলিশ লক্ষ্মীকে ধরে। নিম্ন আদালতে লক্ষ্মী দেবী সাজাপ্রাপ্ত হন। কলকাতার আলিপুর জেলেই তাঁর কষ্টের জীবন কাটছিল।কিন্তু সেটা হতে দেননি ওই জেল থেকে বেরিয়ে আসা আরেক হতভাগ্য বন্দিনী অপরাজিতা গঙ্গোপাধ্যায় (মুনমুন)। স্বামীকে হত্যার মিথ্যা অভিযোগে দুটো ছোট্ট সন্তানকে মায়ের কোলছাড়া রেখে ১৩ বছর জেলে কাটানো অপরাজিতা, লক্ষ্মীর হয়ে হাইকোর্টে আপিল করলে হাইকোর্ট জানায়, লক্ষ্মী যে দোষী সেটা নিশ্চিত নয়। তদনুযায়ী, হাইকোর্ট উপযুক্ত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দুই মাসের মধ্যে লক্ষ্মীকে মুক্তির আদেশ দেয়। চরম দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির শিকার ওড়িশার কেন্দ্রাপাড়া জেলার গ্রাম্য যুবক “ অর্জুন পারিদা”,যাঁর জীবনের মূল্যবান ৩৬ টা বছর বিনা বিচারে বদ্ধ গারদে বন্দি অবস্থায় কেটে গিয়েছিল। দিনমজুরের কাজে তিনি বাংলার মেদিনীপুর জেলায় এসেছিলেন। কিন্তু কাজ করিয়ে পয়সা না দেওয়ায় একজনের সাথে তাঁর বিবাদ বাঁধে। অর্জুনকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে। এরপর যেভাবেই হোক তাঁর ঠাই হয় জেলে। মেদিনীপুর, দমদম এবং আলিপুর মিলিয়ে ২৭ টি বছর তাঁর জেলে কেটে যায়।
ভিন রাজ্যের বাসিন্দা হওয়ায় এবং পরিবারের যোগাযোগ না মেলায় এই মানুষটি কোনও উকিল দিতে পারেননি। ফলে গারদেই তিনি পচে মরছিলেন। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় কারাপ্রাচীরে মাথা ঠুকতে ঠুকতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে গেলে তাঁকে পাঠানো হয় বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে।
কয়েক বছর এখানে থেকে কিছুটা সুস্থ হলে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী ‘কাজি নুরুজ্জামান’ এবং তাঁর সহকর্মীরা মিলে অনেক কষ্টে অর্জুনের বাড়ির ঠিকানা বের করেন।এরপর সকলে চাঁদা তুলে আর হাসপাতালের সুপার “ পবিত্র সরকার ‘ সাহেবের সহযোগিতায় নুরুজ্জামান ওড়িশা যান।
অনেক খুঁজে, নুরুজ্জামান এক প্রত্যন্ত গ্রামে অর্জুনের বাড়িতে পৌছান। অঞ্চল প্রধানের সঙ্গে দেখা করে ভোঁটার কার্ড ও অন্য কাগজ সমেত অর্জুনের পরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে নুরুজ্জামান বহরমপুর ফিরে আসেন। এরপর নানা আইনি প্রক্রিয়ার পর পরিবারের লোকেরা অর্জুনকে বাড়ি নিয়ে যান।
সুদীর্ঘ ৩৬ বছর বিনা বিচারে ভিন রাজ্যের গারদে বন্দি থাকার পর অর্জুন বাড়ির মুখ দেখেন। ততদিনে দুনিয়ার এবং তাঁর পরিবারের অনেক পট-পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।
এইরকম ঘটনা আরও আছে এবং অন্য রাজ্যেও হয়।
প্রশ্ন জাগে,প্রশাসনিক স্তরে বিভিন্ন ফাঁক, দীর্ঘসূত্রতা এবং আরও নানা কারণে আর কত মানুষকে এভাবে বদ্ধ গারদে পচে মরতে হবে ?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct