পাশারুল আলম: এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি মাননীয় শেখর কুমার যাদব সম্প্রতি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটি অনুষ্ঠানে যে মন্তব্য করেছেন, তা ভারতীয় বিচারব্যবস্থা এবং দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। বিচারপতি যাদবের বক্তব্য, বিশেষত সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজে বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এর ফলে বিচারব্যবস্থা, সংবিধান এবং সমাজের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। সংবিধানের শপথ নিয়ে একটি ওপেনে সভায় এই ধরনের মন্তব্য কতটুকু মানান সই তা নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আলোচনা শুরু হয়েছে।
প্রথমেই মাননীয় বিচারপতির বক্তব্যের সারাংশ বুঝে নিই। বিচারপতি শেখর কুমার যাদব তার ভাষণে বলেছেন, “দেশ বহু সংখ্যকের ইচ্ছায় চলবে,” যা সরাসরি ভারতের সংবিধানের সমতা ও সাম্যের নীতির পরিপন্থী। তিনি নাম না করে মুসলিম সমাজকে হিংস্র বলে ইঙ্গিত করেছেন। তার বক্তব্যে তিনি বলেন, যারা পশু হত্যা করে, তাদের সন্তানরা সহানুভূতিশীল হতে পারে না। যদিও তিনি তার বক্তব্যকে সাধারণীকরণের চেষ্টায় বলেছেন, “সংখ্যাগুরু সমাজ তাদের সন্তানদের দয়া ও সহানুভূতি শিক্ষা দেন,” তবুও এই বক্তব্যকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি লক্ষ্য করে দেওয়া বলে মনে করা হয়েছে। শুধু সাম্প্রতিক এই বক্তব্যই নয়,
মাননীয় বিচারপতির পূর্ববর্তী বিতর্কিত মন্তব্য পর্যালোচনা করলে এর ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়।
মাননীয় বিচারপতি যাদব গরুকে জাতীয় পশু ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়ে তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। তার দাবি ছিল, “গরু একমাত্র প্রাণী যা অক্সিজেন নির্গত করে।” এছাড়াও, গোরক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণার পক্ষে তিনি সওয়াল করেন। এসব মন্তব্য বৈজ্ঞানিক ও সংবিধানগত ভিত্তি থেকে বিচ্যুত বলে সমালোচিত হয়েছেন। আর এই সর্বশেষ মন্তব্য দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি যে ভরসা ও আস্থা সাধারণ মানুষের রয়েছে। সেই বিশ্বাস ও আস্থায় প্রশ্ন চিহ্ন পড়ায় স্বাভাবিক। তাই এই বক্তব্য সাধারণ একটি বক্তব্য হিসাবে অনেকেই দেখতে চান না। কেননা,
ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা, সমতা এবং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। বিশেষত, অনুচ্ছেদ ২৫ থেকে ৩০ নাগরিকদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা এবং সংখ্যালঘুদের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত অধিকার নিশ্চিত করে। বিচারপতি যাদবের মন্তব্য এই মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।সংবিধানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই বক্তব্য অন্য এক মাত্রা যোগ করেছে। তিনি প্রায় চৌত্রিশ বছর বিচারক পদে আসীন। একজন সিনিয়র বিচারকের মন্তব্যের কারনে জন মানসে যে প্রশ্নের উদয় হয়েছে। সেই প্রশ্ন নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠেছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, একজন বিচারপতি হিসেবে তার অবস্থান এমন হওয়া উচিত যা সংবিধানের মূল চেতনাকে রক্ষা করে। তবে তার সাম্প্রতিক মন্তব্য এই প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, একজন বিচারক কি ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করতে পারেন যা সংবিধানের নীতির পরিপন্থী?
উচ্চ আদালতের বিচারকের নিয়োগ দেন, কলেজিয়াম। তাই কলেজিয়ামের ভূমিকা ও বিচারক নিয়োগ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ এন, কে, সিং। তিনি বলেন,
বিচারপতিদের নিয়োগের সময় তাদের পেশাগত দক্ষতা এবং নিরপেক্ষতার উপর জোর দেওয়া হয়। তবে এই ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে, কলেজিয়াম কি বিচারকদের মতাদর্শগত প্রভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট যাচাই করে? বিচারপতি শেখর যাদবের মতো বিতর্কিত মন্তব্যকারী একজন বিচারকের ভূমিকা দেশের বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতাকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই বিচারপতি যাদবের বক্তব্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্তরে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
সিনিয়র আইনজীবী ইন্দ্রা জয় সিং এই মন্তব্যকে অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, একজন বিচারপতির এভাবে ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করা উচিত নয় যা সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে। সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও এসেছে । এআইএমআইএম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এই বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন এবং বিচারপতির মন্তব্যকে সাম্প্রদায়িক বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “একজন বিচারক যখন এমন কথা বলেন, তখন সংখ্যালঘু সমাজ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা করে।”
সাধারণ মানুষ, সংখ্যালঘু সমাজ ও নেটিজেনদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা গেছে। অনেকেই এই বক্তব্যকে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন সমাজের উপর এর প্রভাব পড়বে। এই ধরনের মন্তব্য বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করতে পারে।
বিচারপতির বক্তব্য বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করবে। কেউ কেউ আবার মনে করেন বিচারকের মধ্যে কেউ কেউ অবসরের পর সরকারী আনুকূল্য পাওয়ার জন্য এমন কাজ করে থাকেন। তবে বিচার ব্যবস্থায় তার কোনো প্রভাব পড়বে না। তাই তারা বলেন, অবসরের পর কম করে দুই বছর কোন বিচারক কোন সরকারী পদ গ্রহন করতে পারবে না, এই ধরনের আইন নিয়ে আসা দরকার। এটা সরকার বা মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট করতে পারেন। এটা হলে হয়তো মাননীয় বিচারকগণ আরোও সঠিক ও স্থির ভাবে ন্যায় দিতে সক্ষম হবেন।
পরিশেষে বলা যায়, মাননীয় বিচারপতি শেখর কুমার যাদবের বক্তব্য ভারতীয় বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও সংবিধান-প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলির সুরক্ষার প্রশ্ন তুলেছে। বিচারপতির মন্তব্য সংখ্যালঘু সমাজের মধ্যে ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। ভবিষ্যতে বিচারপতিদের নিয়োগ এবং তাদের মন্তব্যের উপর আরও জবাবদিহিতা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোটকথা ভারতের বিচারব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা বজায় রাখতে সংবিধানের মূল চেতনাকে সবসময় অগ্রাধিকার দিতে হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct