সারিউল ইসলাম, মুর্শিদাবাদ, আপনজন: ঢাকা থেকে মখসুদাবাদে ১৭০৪ সালে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন বাংলার দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ। পরে অবশ্য তার নাম অনুসারেই এলাকার নামকরণ করা হয় মুর্শিদাবাদ। ১৭১৭ সালে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার প্রথম নবাব হিসেবে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসেন তিনি। নাসিরি বংশের তথা মুর্শিদাবাদের প্রথম নবাব হিসেবে ১৭২৭ পর্যন্ত এক দশক রাজত্ব করেন। মুর্শিদকুলি খাঁ এর মৃত্যুর পর মসনদে বসে দ্বিতীয় নবাব হন তার জামাতা সুজাউদ্দিন খাঁ। সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর ১৭৩৯ সালে মুর্শিদাবাদের তৃতীয় নবাব হিসেবে মসনদে বসে তার পুত্র সরফরাজ খাঁ। কিন্তু সিংহাসন আরোহণের ১৩ মাসের মধ্যেই শুধু মসনদ নয় বরং পৃথিবী ছেড়েছিলেন তিনি। নবাবী ইতিহাসে প্রথম বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত আজিমাবাদ তথা বর্তমান পাটনার সুবেদার আলীবর্দী খাঁ সরফরাজের দুর্বলতা জানতেন। আর তাই বর্তমান জঙ্গিপুর মহকুমার অন্তর্গত গিরিয়া নামক ভাগীরথী তীরবর্তী এলাকায় সরফরাজকে নিয়ে গিয়ে আলীবর্দী হত্যা করে। শেষ হয় নাসিরি বংশের শাসনকাল। গিরিয়ার যুদ্ধের পর ১৭৪০ সালে মুর্শিদাবাদের মসনদে চতুর্থ নবাব হিসেবে বসেন আলীবর্দী খাঁ। অন্যদিকে গিরিয়ার প্রান্তরে সরফরাজ খাঁ এর নিথর দেহ পড়ে থাকে। সেখান থেকে তার দেহ উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয় মুর্শিদাবাদের নাগিনাবাগে। সেখানেই গোপনে সমাধিস্থ করা হয় তাকে। সরফরাজ খাঁ এর পাঁচ পুত্র ও কন্যা পালিয়ে যায় বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করে তার বংশধররা।
ভৌগোলিকভাবে মুর্শিদাবাদ জংশন রেল স্টেশন থেকে মাত্র ২০০ মিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত নাগিনাবাগে রয়েছে সরফরাজ খাঁ এর সমাধি। বছর তিনেক আগে ২০২১ সালের ৫ই অক্টোবর মুর্শিদাবাদ হেরিটেজ অ্যান্ড কালচারাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির উদ্যোগে সেই সমাধিকে বাঁধিয়ে সমাধির পুনর্নির্মাণ উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন জেলা শাসক শরদ কুমার দ্বিবেদী, পুলিশ সুপার কে শবরী রাজকুমার, এস্টেট ম্যানেজার, মহকুমা শাসক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, মহকুমা পুলিশ আধিকারিক সহ অন্যান্যরা। মুর্শিদাবাদ হেরিটেজ অ্যান্ড কালচারাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমাদের সংস্থার পক্ষ থেকে এই সমাধি টি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ এর অভাবে তা পুনরায় ধ্বংসের মুখে যেতে বসেছে। আমরা সংস্কার করেছিলাম কিন্তু সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় প্রশাসন বা পর্যটন দপ্তর কেউই উদ্যোগী নন। সমাধির চারিদিকে জঙ্গলে ভরে গিয়েছে। অতিসত্বর সেই জঙ্গল পরিষ্কার করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।’ নাগিনাবাগের স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ‘মাঝেমধ্যেই পর্যটকরা এখানে আসেন। দেখে যান সমাধি। কিন্তু তাদের মুখে সমাধি রক্ষণাবেক্ষণের সমালোচনা শোনা যায়।’ মুর্শিদাবাদ টাঙ্গা ইউনিয়নের সম্পাদক মনু শেখ বলেন, ‘আমাদের টাঙ্গা চালকরা পর্যটকদের উপর এবং পর্যটনের উপর নির্ভর করে চলে। কিন্তু প্রতিদিন মুর্শিদাবাদে পর্যটক সংখ্যা কমছে। তার বহু কারণ রয়েছে, যার মধ্যে একটি হল ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ না করা।’ সমাধি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘শুধুমাত্র সরফরাজ খাঁ এর সমাধি নয়, মুর্শিদাবাদের অন্যান্য ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলিও ধ্বংসের মুখে। মুর্শিদাবাদ হেরিটেজ সংস্থা সমাধি টি সংস্কার করেছে কিন্তু সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় প্রশাসন উৎসাহী নয়। পৌরসভা পর্যটকদের থেকে লেভি কর আদায় করছে, কিন্তু পর্যটনকেন্দ্রগুলি সংরক্ষণ করছে না। আমরা চাই সংরক্ষণ হোক, সংস্কার হোক এবং সেগুলি প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’
এ বিষয়ে মুর্শিদাবাদ পৌরসভার পৌরপিতা ইন্দ্রজিৎ ধর বলেন, ‘সমাধি সম্পর্কে আমরা অবগত নই, তাছাড়া কোন লিখিত অভিযোগ এখনো পর্যন্ত কেউ করেনি। তবে যেহেতু ইতিহাসের বা পর্যটনের বিষয় তাই আমরা বিষয়টি নিশ্চয় দেখব।’
সমাধি সংস্কার হলেও কবে সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, প্রশ্ন পর্যটন মহলে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct