এম মেহেদী সানি: পিতা হারা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র শাহাবাজ আলমকে ‘সোনা নাতি’ বলে দাদু অরিন্দম গুপ্ত তাঁর হস্টেল, লেখাপড়ার সমস্ত খরচের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে জোর চর্চায় ৷ অরিন্দম গুপ্তের প্রশংসাই পঞ্চমুখ নেটিজেনরা লিখছেন, ‘মানবতা আজও বেঁচে আছে’, ‘এমন মানুষ আছে বলেই পৃথিবী আজও ধ্বংস হয়নি’, ‘অরিন্দম বাবু দীর্ঘজীবী হোন’ আরও কত কি ৷ দেশজুড়ে সহিংসতার ঘটনা, জাতিগত বৈষম্য, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যখন বেড়েই চলেছে তখন এমনই ব্যতিক্রমী এই ঘটনা সামাজিক গণমাধ্যমে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে ৷ কিছুটা হলেও খোরাক পেয়েছেন মানবতাবাদী, পরধর্মসহিষ্ণু, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাকারীরা ৷ অরিন্দম গুপ্তের পোস্টকে হাতিয়ার করেই হাজার হাজার শেয়ারের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং মানবতাবোধ উন্মোচনের বার্তা দিয়েছেন নেটিজেনরা ৷
উল্লেখ্য, কলকাতার টালিগঞ্জের নাগতলার বাসিন্দা প্রাক্তন অধ্যাপক অরিন্দম গুপ্ত বৃহস্পতিবার একটি শিশুর সঙ্গে নিজের ছবি পোস্ট করে ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, “এই শিশু আমার সোনা নাতি, শাহাবাজ আলম । অসম্ভব মেধাবী । আমার ক্লাসে অঙ্ক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে বার কয়েক পুরস্কার পেয়েছে । ওর বাবা সিভিক ভলান্টিয়ার, মহবুল । এনএইচ ৩৪ এ কর্মরত ছিলো । এক অতিকায় ট্রাক তাকে থেঁতলে দিয়ে চলে যায় । শাহাবাজ শোকে পাথর হয়ে স্নান খাওয়া বন্ধ করে । ওর বাবা ওর চোখে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিলো ও ডাক্তার হবে ! সেটা আর হবে না, সম্ভবত এমন চিন্তা থেকে শাহাবাজ বোবা হয়ে যায় । এরপর আমি ওকে কোলকাতায়, আমার কাছে নিয়ে আসি । ওকে অঙ্ক, ইংরেজি, ই.ভি.এস পড়াতে শুরু করি । তারপর ওকে আল- আমীন মিশনের অ্যাডমিশন টেস্টে বসাই । অভাবনীয় ফল করে শাহাবাজ । আগামী ১৩ তারিখে ওকে কাউন্সেলিং এ ডেকেছে । ও ভর্তি হয়ে যাবে । ওর বাবার স্বপ্ন ছিলো মিশন... ডাক্তারি ! সফল হতে চলেছে ।
শাহাবাজের হস্টেল, লেখাপড়ার সমস্ত খরচের দায়িত্ব আমি নিলাম । আমি যদি ছ’বছর বেঁচে থাকি, শাহাবাজ মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে পড়বে । তার আগে যদি পটল তুলে ফেলি, তোমরা একটু দেখো ! এই মেধার যেন অকালমৃত্যু না হয় ।” এই পোস্টে ঝড় উঠে সামাজিক গণমাধ্যমে, কয়েক হাজার শেয়ার হয়েছে ২৪ ঘন্টায় ৷
কে এই অরিন্দম গুপ্ত, শাহাদাত আলমের কি পরিস্থিতি ‘আপনজন’-এর তরফে খোঁজ নিয়ে আমরা জানতে পারি, অরিন্দম গুপ্তের জন্ম জামশেদপুরে, সেখানেই রামকৃষ্ণ মিশনে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ নিয়ে, উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেন কলকাতায় ৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন ৷ পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন ৷ কর্মজীবন থেকেই শিক্ষানুরাগী তিনি, অনাদরে বেড়ে ওঠা গ্রাম বাংলার অত্যন্ত এলাকায় জাতি- ধর্ম -বর্ণ নির্বিশেষে মেধাবী অনাথ শিশুদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে কখনো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেন ৷ অরিন্দম বাবু জানান, ‘আমার যখন ৪৫ বছর বয়স আমি তখন প্রথমে একটা বাচ্চাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি ৷ সে আইআইটিয়ান, কর্মসূত্রে এখন অস্ট্রেলিয়াতে আছে ৷’ প্রায় চোদ্দ বছর আগে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন ৷ নিজে বিবাহ করেননি, একাকীত্ব কাটাতে গ্রাম গঞ্জে গিয়ে বাচ্চাদের পড়ানো, দরিদ্র অসহায় দুঃস্থ মেধাবী বাচ্চাদের নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে পড়াশোনা করানোর কাজ আরও জোরালো হয় ৷ ছাত্র-ছাত্রীদের অনুরোধে অরিন্দম গুপ্ত উত্তর দিনাজপুরে একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছেন ৷ স্কুল তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি দেখলাম মুসলিম জাতির মধ্যে ভীষণ মেধাবী বাচ্চা আছে, কিন্তু ওরা বেশিরভাগ ড্রপ আউট হয়ে যায় অথবা পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে চলে যায় ৷ পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়াই, যখন দেখি খুবই মেধাবী অথচ অভাবী সেই সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করি ৷ ‘অ্যাসে ইন্ডিয়ান মডেল স্কুল’ আমার সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে চলেছে ৷’ শাহাবাজও ওই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ৷ পিতাহারা মেধাবী ওই ছাত্রের সহায়তার ব্যাপারে অরিন্দম গুপ্ত বলেন, ‘ও অত্যন্ত মেধাবী, আমাকে দাদু বলে ডাকে আর তাছাড়া একটা বাচ্চা অসহায় দরিদ্র কিন্তু আমার একটু অতিরিক্ত পয়সা আছে আমি তাকে কিছুটা সহযোগিতা করব এটা স্বাভাবিক ব্যাপার, এটার মধ্যে আমি আলাদা কিছু দেখতে পাচ্ছি না ৷’ ‘অরিন্দম গুপ্তের নাতি শাহাবাজ আলম’ সম্প্রীতি দৃষ্টান্ত হিসেবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপনি কিভাবে দেখছেন ? এই প্রশ্নের জবাবে অরিন্দম গুপ্তের সাফ উত্তর আমি ধর্ম মানি না, তাই এটা কোনো ব্যাপার না ৷ আমি ঈদের সময় পায়েস খেতে যাই, পুজোর আনন্দ উপভোগ করি, আবার বড়দিনের মেলাতেও যাই ৷ জাত-পাত মানি না ধর্ম-বর্ণ মানি না, মানবতাই বড়ো ৷ আগামী বছর মেধাবীদের জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বারুইপুরে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথাও জানান অরিন্দম গুপ্ত ৷
শাহাবাজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, শাহাবাজ আলমের বাড়ি উত্তর দিনাজপুরের করণদিঘী থানার অন্তর্গত মোহনপুর গ্রামে ৷ শাহাবাজরা দুই ভাই বোন, বোনের বয়স বছর পাঁচেক ৷ বাবা মহবুল হক সিভিক ভলেন্টিয়ার ছিলেন, গত ৭ ই ফেব্রুয়ারি ডিউটিরত অবস্থায় এক লরির ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই প্রাণহারান ৷ নিজের সংসার, ছেলের পড়াশোনার খরচ, বাড়িতে অসুস্থ মা বাবার চিকিৎসা সবটাই চলত মহাবুলের রোজগারে ৷ শাহাবাজ আলমের বাবার মৃত্যুর পর মা রুনা লায়লা বাবার কাজটি পেলেও ছেলে মেয়ের পড়াশোনা, শশুর শাশুড়ির চিকিৎসা, সংসার কিভাবে সামাল দেবেন তা নিয়ে প্রতিমুহূর্তে চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন রুনা ৷
রুনা লায়লা জানান, ‘শাহবাজ আলম সপ্তম শ্রেণীতে আল-আমীন মিশনে ভর্তি হতে চলেছে, আগামী ১৩ তারিখ বেলপুকুর ক্যাম্পাসে কাউন্সিলিং রয়েছে শাহাবাজের ৷’ আল-আমীন মিশনের সামগ্রিক পড়াশোনা দায়িত্ব ইতিমধ্যেই গ্রহণ করেছেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী অরিন্দম গুপ্ত ৷ এমন অসহায় অবস্থায় শাহাবাজের শিক্ষার দায়িত্ব হাতে তুলে নেওয়ায় অরিন্দম বাবুকে কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি তার ভূমিকায় কার্যত বাকরুদ্ধ শাহাবাজের গোটা পরিবার ৷ সাহাবাজের মা বলেন, ‘শাহাবাজের দাদুর (অরিন্দম গুপ্ত) অবদান আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না, আমার বাবার মত পাশে দাঁড়াচ্ছেন ৷ তিনি অনেক বড় মনের মানুষ, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না ৷ শাহাবাজের বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা চিন্তায় পড়ে যায় তখন শাহাবাজের পাশে এসে দাঁড়ায় অরিন্দম বাবু ৷ তিনি সাহস জুগিয়েছেন, পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন, আমার ছেলেকে নিজের বাড়িতে রেখে আল-আমীন মিশনের প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করেছেন ৷ প্রবেশিকা পরীক্ষায় শাহাবাজ সফলও হয়েছে ৷ এই অবদান ভোলার নয় ৷’ আল-আমীন মিশনের সম্পাদক এম নুরুল ইসলামকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি ‘আপনজন’ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি দেখেছি এবং খোঁজ নিয়েছি, আগামী ১৩ তারিখ আমি বেলপুকুর ক্যাম্পাসে থাকবো, শাহবাজ ও তাঁর পরিবার এবং অরিন্দম বাবুর সঙ্গে কথা বলব ৷ কি করা যায় ভাবছি৷’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct