আইন সভাতে নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি হরণ করে গেরুয়া কর্মসূচি। এসবই নাকি হিন্দুদের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যেই হচ্ছে। কর্মসূচিগুলি বাস্তবায়িত হলে ভারতবর্ষের হিন্দুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়ে যাবে। এক শ্রেণির সহনাগরিকদের দৃঢ় বিশ্বাস, মোদীজি যেটাই করেন সেটার মধ্যেই রয়েছে হিন্দুদের কল্যাণ। রেল, ভেল, তেল, বিমান থেকে যেসব জাতীয় সম্পত্তি বিক্রি করছেন সবই তো তাদেরই কল্যাণে। লিখেছেন মুহাম্মাদ আবদুল মোমেন...
১৯৮০ সালে আত্মপ্রকাশ ঘটা একটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক পুঁজি বলতে গেলে বোঝায় হিন্দু - মুসলমান। হিন্দু - মুসলমান ছাড়া তাদের কোনও গতিই নেই। তারাই হচ্ছে স্বঘোষিত হিন্দু রক্ষক। বর্তমানে তারা ভারতবর্ষের শাসক। অথচ তাদের শাসনামলেই “হিন্দু খতরেমে”। আজ থেকে ১১ বছর আগে ওই তথাকথিত হিন্দুরক্ষক দলের ভারতবর্ষের মসনদ দখল করার দিনটাই নাকি স্বাধীনতা অর্জনের দিন। অর্থাৎ ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সালের ১৪ অগষ্ট পর্যন্ত স্বাধীন ছিল। ওই বছরেরই ১৫ অগষ্ট থেকে ২০১৪ সালের ১৯ মে পর্যন্ত ভারতবর্ষ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। ২০ মে থেকে স্বাধীনতা অর্জন করার পর থেকেই হিন্দু বিপদে আছে। যদিও ভারতীয়দের একটা বড় অংশের মধ্যে বিস্ময়কর প্রশ্ন - কমবেশি এক হাজার বছরের মুসলমান শাসনে হিন্দু বিপদে পড়েনি, দুশো বছরের ইংরেজ শাসনে হিন্দুর বিপদ আসেনি, ষাট বছরের কংগ্রেস শাসনেও হিন্দু বিপদে পড়েনি অথচ হিন্দু রক্ষক স্বঘোষিত হিন্দু বিপদ তারক নরেন্দ্র মোদীর শাসন শুরু হতেই কেন “হিন্দু খতরেমে মে?”
বিপত্তারক মোদীজি তাই হিন্দুর বিপদ দূর করছেন একের পর প্রকল্পের স্বার্থক রূপায়ণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ইতিপূর্বেই একাধিক সফল প্রকল্প সফল ভাবে লঞ্চ করেছেন। উল্লেখযোগ্য, বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণ, তিন তালাক নিষিদ্ধ, ৩৭০ ধারা বিলোপ, সিএএ, মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ ইত্যাদির পর এবার এখন পর্যন্ত শেষ কর্মসূচি মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পত্তি হড়প কর্মসূচি।
আইন সভাতে নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি হরণ করে গেরুয়া রক্ষা কর্মসূচি। এসবই নাকি হিন্দুদের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যেই হচ্ছে। কর্মসূচিগুলি বাস্তবায়িত হলে ভারতবর্ষের হিন্দুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়ে যাবে।
এক শ্রেণির সহনাগরিকদের দৃঢ় বিশ্বাস, মোদীজি যেটাই করেন সেটার মধ্যেই রয়েছে হিন্দুদের কল্যাণ। রেল, ভেল, তেল, বিমান থেকে যেসব জাতীয় সম্পত্তি বিক্রি করছেন সবই তো তা;রে কল্যাণে। জিএসটির নামে ‘লুটের প্রকল্প’লাগু করে ছোট মাঝারী ব্যবসায়ীদের ব্যবসা মেরে দিয়ে পুঁজিপতি আদানী আম্বানীদের বিপুল লুটের সুবিধা করে দেওয়ার মধ্যে রয়েছে হিন্দু কল্যাণ।
এবার মূল আলোচনায় আসাযাক। নরেন্দ্র মোদী সরকারের চোখ পড়েছে মুসলমানদের ধর্মীয় সম্পত্তি ওয়াকফ এর উপর। ভারতের জাতীয় সম্পত্তি রেলের সম্পত্তি বাদ দিলে সর্বাধিক সম্পত্তি এই ওয়াকফ এর অধীনে রয়েছে। যদিও ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলমানদের নিজস্ব সম্পত্তি; তারপরও সেই সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও সদ্ব্যবহার করার জন্য ভারত সরকার দ্বারা প্রণীত আইন রয়েছে। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৯৫ সালের আইন এখন পর্যন্ত চুড়ান্ত। আইন দ্বারা পরিচালিত প্রতিটি রাজ্যে মূলত যে সব রাজ্যে ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে সেই সব রাজ্যে স্বশাসিত সংস্থা অর্থাৎ বোর্ড রয়েছে। বোর্ডের উপর দেখভাল ও সংরক্ষণ ইত্যাদির ভার ন্যাস্ত ছিল। ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের বোর্ড সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ওয়াকফ সম্পত্তি যথাযোগ্য জরিপের মাধ্যমে সম্পত্তি এনরোল্ড করে রেখেছে।
‘ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪’ কেন কালাকানুন? তা জানতে হলে ওই আইনের মাধ্যমে মুসলমানদের সম্পত্তি হরণ করার উদ্দেশ্যে কী কী সংস্থান রেখে তা খতিয়ে দেখা দরকার।
বিলটিতে মুসলিমদের ধর্মীয় ও দাতব্য সংস্থাগুলোর অস্তিত্বের জন্য এক গভীর বিপদ। এই বিলের মাধ্যমে মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, ঈদগাহ, দাতব্য হাসপাতাল, এতিমখানা এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রাখার আঁটোসাঁটো ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যা তাদের স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় ভাবাবেগে মারাত্মক আঘাত হানার ষড়যন্ত্র। এই বিলের প্রধান প্রধান ধারাগুলোর হালকা ভাবে অনুধাবন করলে অনুমান করা যায়, মুসলিমদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের নীলনক্সা এই কালাকানুন।
সংশোধিত আইনে জেলা কালেক্টর ও পৌর কমিশনারকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে - একটি মাদ্রাসা, মসজিদ, কবরস্থান, ঈদগাহ, দরগাহসহ যেকোনো ধর্মীয় ওয়াকফ সম্পত্তি বিতর্কিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণার ক্ষমতা প্রদান করা হচ্ছে। তিনি চাইলে এই সম্পত্তির মালিকানা বদল করতে পারেন এবং তা সরকারি সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণাও করতে পারেন। এর ফলে মসজিদ - মাদ্রাসাসহ অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনাগুলি আইননত স্বীকৃতি হারিয়ে বিতর্কিত স্থান হয়ে উঠতে পারে। ফলত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনার পরিকল্পনা।
ওয়াকফ বোর্ডে দু’জন অ-মুসলিম সদস্য আবদ্ধতামূলক করে মুসলমানদের ধর্মীয় আচারাদিতে বি-ধর্মীদের হস্তক্ষেপের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এমনকি বোর্ডের প্রধানও অ-মুসলিম হতে পারেন। ফলত মুসলিমদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় সরকারি তথা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের উপযুক্ত পরিকল্পনা। এটা ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বললে কম বলা হবে স্বাধীনতা হরণ ছাড়া কিছু নয়। এরফলে প্রতিষ্ঠানগুলো তার ধর্মীয় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে বড়সড় বাধা সৃষ্টি করবে।
ওয়াকফ সম্পত্তি নিবন্ধিকরণের ক্ষেত্রে কালেক্টরের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করে সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণের অধিকার সরাসরি কালেক্টরের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। এই আইন পাশ ও বলবৎ হলে কোনো মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান বা অন্য ধর্মীয় ওয়াকফ সম্পত্তি নিবন্ধিত করতে হলে কালেক্টরের অনুমোদন লাগবে। অনুমোদন না দিলে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে সংরক্ষণের অন্তর্ভুক্ত হবেনা। কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ সম্পত্তি সেই প্রমাণপত্র না থাকলে সম্পত্তি অধিগ্রহণের হুমকি এমন অনেক ঐতিহ্যবাহী মসজিদ ও মাদ্রাসা রয়েছে যেগুলোর আনুষ্ঠানিক দলিল হয়তো নেই বা ত্রুটিপূর্ণ। এই বিল অনুযায়ী, যেসব ধর্মীয় স্থাপনার এমন প্রমাণপত্র নেই, সেগুলোকে বিতর্কিত ঘোষণা করে সরকার তা অধিগ্রহণ করতে পারে।
ঐতিহ্যবাহী টিপু সুলতান মসজিদ এবং জামা মসজিদের মতো স্থাপনাগুলোর অস্তিত্বও এমন পরিস্থিতিতে হুমকির মুখে পড়তে পারে। কারণ মসজিদগুলির জন্য জমি দান বা ক্রম কিম্বা অধিগ্রহণ যা কিছু হয়েছে তা কিন্তু কম করে পাঁচশো থেকে ছয়শো বছর আগে। এত বছর আগের নথিপত্র বা দলিল আদেল্লার অস্তিত্ত্ব না থাকাটাই স্বাভাবিক। ফলত এসবগুলোতে অবশ্যই হুমকির মুখে নয় বিদ্বেষ মনোভাবাপন্ন প্রশাসন এসবগুলোতে অধিগ্রহণ করে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনায় এই আইন প্রণয়ন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
নতুন ওয়াকফ আইনে
কোনো সম্পত্তির বিরোধ নিরসন কিম্বা নির্ধারণ ইত্যাদির ক্ষমতা কালেক্টরের হাতে প্রদান করে মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান ও অন্যান্য ওয়াকফ সম্পত্তির পরিদর্শন এবং বিরোধ নিরসণের ক্ষমতা কালেক্টরের হাতে চলে যাবে। এর ফলে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ বাড়বে এবং ওয়াকফ বোর্ড তার অস্তিত্ব হারাবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়ে রাজস্ব আদায়ে সরাসরি কালেক্টরের মাধ্যমে সরকার তথা শাসকদল করবে। ওয়াকফ প্রথায় চিরাচরিত ঐতিহ্য বা রীতি মুতাওয়াল্লি, সেই পদটি কেবল বিলুপ্ত করা হবেনা তাদের জন্য কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সংস্থান রাখা হচ্ছে।
ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪ মুসলিম সম্প্রদায়ের দাতব্য ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার গভীর ষড়যন্ত্র।
এই বিলের বিরুদ্ধে সার্বিক সচেতনতা এবং ঐক্যবদ্ধ একান্ত জরুরি।
লেখক সাতুলিয়া ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা শিক্ষক ও মাদ্রাসা ছাত্র আন্দোলনের প্রাক্তন নেতা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct