পাশারুল আলম: ভারতের রাজনীতিতে মহারাষ্ট্র সবসময় গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি দেখিয়ে দিয়েছে যে রাজ্যের রাজনীতি এখন আদর্শ ও নৈতিকতার মাপকাঠি থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বিশ্বাসের অভাব এবং অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ক্রমশই পরিষ্কার হয়ে উঠছে। মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনা (শিন্ডে গোষ্ঠী) ও এনসিপি (অজিত পাওয়ার গোষ্ঠী) মিলে সরকার গঠন করলেও রাজ্যের সাধারণ মানুষ এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে মেনে নিতে পারছে না।
মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে। ইভিএম মেশিনে কারচুপির অভিযোগ যেমন নতুন নয়, তেমনি এবার সাধারণ ভোটারদের মধ্যে এর বিরুদ্ধে বিরোধিতা আরও তীব্র হয়েছে। ভোটার লিস্ট থেকে বহু মানুষের নাম বাদ দেওয়া, ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, এবং নির্বাচনের শেষে নতুন করে ৭৫ লক্ষ ভোটদানের যে হিসাব নির্বাচন কমিশন দিয়েছে, তা জনমনে আরও সংশয় সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক নয়।মহারাষ্ট্রের ভোট প্রক্রিয়ায় এবার এমন কিছু তথ্য উঠে এসেছে যা সমস্ত চিন্তাশীল ব্যক্তিদের ভাবিয়ে তুলেছে। প্রায় উনচল্লিশ লক্ষ ভোটারের নাম বাতিল ও অন্য বুথে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। নতুন করে পাঁচ মাসের মধ্যে সাতচল্লিশ লক্ষ ভোটারের নাম নথিভুক্ত হয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে এসে ঠেকেছে।
গ্রামীণ ভারতের মানুষদের ইভিএম মেশিনের প্রতি আস্থা দীর্ঘদিন নেই। তারা বারবার কাগজের ব্যালট ফেরানোর দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু সরকার সেই দাবিকে উপেক্ষা করছে। যদিও এতদিন কোর্টের মাধ্যমে ইভিএম ব্যবস্থাকে রক্ষা করা হয়েছে, তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের যে স্রোত তৈরি হচ্ছে, তা আর অস্বীকার করা যাবে না। ইভিএম নিয়ে যেভাবে বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে, তা খণ্ডন করার মতো যথাযথ যুক্তি নির্বাচন কমিশনের কাছে নেই। এছাড়া ADR মতন নিরপেক্ষ সংস্থা গুলি যখন প্রশ্ন তুলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নির্বাচন কমিশন এড়িয়ে যান। স্বাভাবিক ভাবেই সাধারণ মানুষ থেকে শিক্ষিত মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন । ইভিএমের প্রতি আস্থা হারানো মানুষ ব্যালটের দাবিতে আন্দোলন সংঘটিত করার প্রয়াস চালাতে শুরু করেছে।
এই আস্থা ও বিশ্বাস হারানোর আর একটি কারন হল রাজনৈতিক দলগুলির স্বার্থের রাজনীতি।
রাজ্যের রাজনীতিতে আদর্শের কোনো স্থায়ী ভিত্তি নেই। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে আদর্শ, নৈতিকতা এবং জনগণের স্বার্থ পুরোপুরি উপেক্ষিত হচ্ছে। আদানি এবং কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলির প্রভাব মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সার্বিক ভাবে একাধিক কারন থাকলেও ভবিষ্যতে ইভিএম বিরোধী আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। সামগ্রিকভাবে ভারতের রাজনীতিতে এখন একটি সাধারণ জনগণ কেন্দ্রিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনেকেই অনুভব করছেন। এক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে কাগজের ব্যালটের দাবি শুধু মহারাষ্ট্র নয়, গোটা ভারতবর্ষেই জোরদার হচ্ছে। জনগণ মনে করে, তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ভোটিং প্রক্রিয়ায় সঠিকভাবে হওয়া উচিত। সেজন্য নির্বাচন কমিশনকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে কাগজের ব্যালট ফেরানো উচিত।
তাই বলা যেতে পারে, মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচন শুধুমাত্র একটি রাজ্যের বিষয় নয়, এটি গোটা ভারতের জন্য একটি নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নির্বাচন ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্বচ্ছতা এবং বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সংস্কার। জনগণের দাবি অনুযায়ী কাগজের ব্যালটে ভোটিং ব্যবস্থা চালু করা হলে তা নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জন আস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
*** মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct