সভ্য সমাজের প্রতিটি নাগরিক মাত্রই অসহায় মানুষের পক্ষে ও সব রকম আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াই উচিত।সেই হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, ইউপির দলিত, ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী, শ্রীলঙ্কার তামিল, আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ, ফিলিস্থিনবাসী সহ সকল নিপীড়িত জনগণের পক্ষে আমাদের কণ্ঠস্বর উচ্চ হওয়াই কাম্য। লিখেছেন এম রুহুল আমিন...
সভ্য সমাজের প্রতিটি নাগরিক মাত্রই অসহায় মানুষের পক্ষে ও সব রকম আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াই উচিৎ। সেই হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, ইউপির দলিত, ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী, শ্রীলঙ্কার তামিল, আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ, ফিলিস্থিনবাসী সহ সকল নিপীড়িত জনগণের পক্ষে আমাদের কণ্ঠস্বর উচ্চ হওয়াই কাম্য।
সম্প্রতি বাংলাদেশর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ভারত বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন, একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ, মিডিয়া চ্যানেল গুলির দায়িত্বহীন প্ররোচনা, দুই দেশের উগ্রবাদী ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের উস্কানি, একে অপরের পতাকাকে অশ্রদ্ধা, সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি করা, আর সোশ্যাল মিডিয়ার মতো অনিয়ন্ত্রিত একটি মাধ্যম বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আসলে সমস্যাটা হল বাংলাদেশী হিন্দুদের একটা অংশ নিজেদের ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের শিকার। এদেশের হিন্দুত্ববাদীরা তাদেরকে বাংলাদেশী হতে না দিয়ে হিন্দুত্বের পাঠ দিচ্ছেন। কিন্তু ভারতীয় মুসলমানরা মনে করে -’ এই মাটিতে তার, জন্ম এই মাটিতেই তার মৃত্যু’। সে ধর্মীয় বিশ্বাসে ইসলাম ধর্মাবলম্বী কিন্তু জাতীয়তায় ভারতীয়, আরবীয়, পাকিস্তানি বা বাংলাদেশী নয়। এক্ষেত্রে যতই হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি রাতদিন উস্কানি দিয়ে যাক, পাকিস্তানে পাঠাক, মসজিদ খুড়ে মন্দির খুঁজুক - তারা ভারতীয় আইন আদালতকে এখনো ভরসা করে। পাকিস্তান বা বাংলাদেশ বা আরবীয়দের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করে না। এদেশে সংখ্যালঘুদের ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিতে বাধ্য করা, গো হত্যার নামে পিটিয়ে খুন করা, বুলডোজার চালিয়ে বাড়ি ভাঙচুর করা আরও কত কি প্রতিনিয়ত ঘটে চলে। সংখ্যাগুরু অধিকাংশ মানুষের নীরবতা তাদের কষ্ট দেয় পীড়িত করে কিন্তু তারা বিশ্বাস করে- ঐক্য ও বৈচিত্রময় ভারতের পক্ষে থাকা একটা বিশাল অংশ ঠিক একদিন এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রতিহত করবে।
তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা বলছেন -এপার বঙ্গের সংখ্যালঘুদের ওপার বঙ্গের সংখ্যালঘুদেয় জন্য সোচ্চার হওয়া উচিৎ। ঠিকতো উচিৎ তো বটেই -অনেকেই করছেন। কিন্তু আওয়াজটা হয়তো খুব বেশি জোর পাচ্ছে না। এর জন্য বুকে মনে হয় অনেক চাপ চাপ ব্যথা!যখন গুজরাট দাঙ্গা, বাবরি শহীদ এর ছবি ভেসে ওঠে বুকে কষ্ট হয়| ধর্মসভা থেকে মুসলিম কোতল কিম্বা প্রকাশ্য রাস্তায় “ মুল্লে কাটে জায়েঙ্গে “স্লোগান ওঠে, জয় শ্রী রামের নামে মানুষ খুন হয় আর সংখ্যাগুরু সমাজের একটা বিশাল অংশ চুপ থাকে, অনেকেই না দেখার ভান করেন, কিম্বা মজা করেন, তা সংখ্যালঘুদেরকে কষ্ট দেয়। গুটি কতক সচেতন নাগরিক রাস্তায় নেমে একটু আধটু প্রতিবাদ করলেও তার আওয়াজ সরকারের কানে পৌঁছোয় না। রাম নবমী বা ধর্মীয় মিছিল থেকে উস্কানি চলে। অনেক ক্ষেত্রে মসজিদ মাদ্রাসায় আক্রমণ হয়। কিন্তু নাগরিক সমাজের মিছিল সেভাবে চোখে পড়ে না। কষ্ট পেতে পেতে সংখ্যালঘুরা নীরব হয়ে গেছে, অসহায় বোধ করে। আর এই কষ্টটা বোঝে বলেই ফিলিস্থিন-এর অসহায় নারী পুরুষের প্রতি সহমর্মী হয়ে ওঠে। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগণের প্রতিও সহমর্মিতা অনুভব করেন। ভারতীয় ক্রিকেট দল জিতলে তাদেরও আনন্দ হয় -তবে তাদের প্রকাশ সব সময় দেখনদারি হয়ে ওঠেনা এই যা। আবার অনেকেই ভারতকে দেশ মাতা রূপে পূজা করেন -সংখ্যালঘুদের সেই রকম দেখতে চান। সমস্যা এই সব জায়গায়। আমি যেমন খাই পরি অনুশীলন করি প্রতিবেশী তেমন করবে -কিন্তু এই এক রঙা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। যে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা গুটি কয়েক বিচ্ছিন্নতাবাদী দিয়ে সমগ্র সংখ্যালঘু সমাজকে দায়ী করা ঠিক না। ঠিক যেমন হিন্দুত্ববাদীকে ঘৃণা করা যায় কিন্তু সমগ্র হিন্দুদের নয় -এটা সংখ্যালঘুদের বোঝা উচিৎ। ভারতীয় পতাকার অবমাননা হলে সকলকে প্রতিবাদ করতে হবে। এ পতাকার জন্য কত শহীদের রক্ত বলিদান গেছে। হ্যাঁ ‘জনগণ মন’ কিম্বা ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা ‘ শুনলে তাদের বুকটাও চওড়া হয়! কিন্তু ঐ ভদ্র ভাষায় সব সময় প্রকাশ করতে পরে না। যখন তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতীয়ত্বের পরীক্ষা দিতে আসেনা। আর আসার মত লোকজন বা কয়জন? অধিকাংশ সেই ভাবে সংস্কৃতি মনোজ্ঞ নয়, দারিদ্র ও অশিক্ষা নিত্যসঙ্গী। একটু আধটু সংরক্ষণ পাচ্ছিলো তার জন্য মামলা, ওয়াকাফ আইনের নামে সম্পত্তি দখল -যেখান থেকে স্কলারশিপ পেয়ে অনেকে পড়াশোনা করতো। তাই কি লিখতে কি লিখবে ভেবে উঠতে সময় নেয় -লেখা আর হয়ে ওঠে না। আবার মিডিয়া হাউস গুলি সংখ্যালঘু মুখ কম আনেন। তাছাড়া সংখ্যালঘুদের মধ্যে শিক্ষা, সমাজ ও রাজনীতির নিয়ে ভাবার মানুষ কম-এর থেকে ধর্মীয় বিষয়ে চৰ্চা বেশি। দু একজন সোচ্চার হলেও তারা আবার প্রতিবেশীদের নানা প্রশ্নবানের সম্মুখীন|যুক্তি তর্কে না গিয়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় সরাসরি আক্রমণ করেন, যেমন -তুমি ভারতীয় না মুসলমান?, বাঙালি মুসলিম হলে বাংলদেশী বলে দেওয়া, মুসলিম নাম দেখলে পাকিস্তানি বা আরবিয়, কিছু হলেই মাদ্রাসার দোষ দেওয়া, জঙ্গী বলেতেও দ্বিধা নেই, বাঙলি মুসলিম হলে দুধেল গাই বা তৃণমোল্লা বা লুঙ্গিবাহিনী আর না হয় সুলতান, মোগলদের এর উত্তরসুরি ইত্যাদি।
এরা মাঠে ময়দানে রাত দিন ভারতীত্বের পরীক্ষা দিচ্ছে -বলছে আমরা ভারতীয় দাদা!আমাদের চৌদ্দ পুরুষের কবর এখনে -তবুও কাগজ দেখাতে হবে। তা কাগজ পত্র যখন দেখল -তাতে করে লাখ লাখ কোটি হিন্দুদের কাগজ আর মেলে না। কিন্তু রাজনৈতিক বাংলাদেশী হিন্দুদের দেখে খারাপ লাগে। আপনারা বাংলাদেশকে কেন নিজের দেশ মনে করছেন না। ১৯৪৭ বা বলা যেতে পারে ১৯৭১ পরবর্তীকালে আর এই সব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে যে যার দেশকে গড়ুন। খামোকা অন্য দেশের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক নেতাদের উস্কানিতে পা না দিয়ে নিজেদের বাংলাদেশী ভাবতে শিখুন। অন্ততঃ ভারতের সংখ্যালঘুদের থেকে শিক্ষা নিন অনুগ্রহ করে। কারণ আপনারা যতই উস্কানি দেবেন ভারতের সংখ্যালঘুরা ততই পীড়িত হবে শারীরিক ও মানসিকভাবে। এদিকে তাদেরকে সব সময় প্রমাণ দিয়ে যেতে হয় ভারতীয়ত্বের। কিন্তু এতদিনে পরিষ্কার যে না এদেশের সংখ্যালঘুরা ভারতীয়ত্বের পরীক্ষার অন্ততঃ প্রতিবেশী সংখ্যালঘুদের ১০০গোল দেবে। তাই ইদানিং আবিষ্কার হয়েছে -জয় শ্রীরাম বলতে হবে। অর্থাৎ ভারত এখন বহুত্ববাদী থেকে হিন্দুত্ববাদী হয়ে উঠার চেষ্টা করছে -যদিও ভারতের একটা বিশাল জনসমষ্টি বহুত্ববাদী ভারতে বিশ্বাসী। ধর্মীয় দেশ হলে তার অবস্থা কেমন হয় তা আরব, ইজরাইল, পাকিস্তানকে দেখলে বুঝতে পারবেন।
পরিশেষে বলি এই যে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা এপার থেকে উস্কানি দিচ্ছেন এতে সীমান্ত সমস্যা আরও বাড়বে। যদিও পরিসংখ্যান দিয়ে বলা হয় বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যা ক্রমাগত কমেছে। এটা আশঙ্কা জাগায় বৈ কি!তবে এটা হওয়ার পিছনে বিগত কয়েক দশক ধরে দেশত্যাগ কেন হল?১৯৭১ এর পরেও কি বিশাল মাত্রায় অত্যাচার হয়েছে না ভারতে চলে আসা ব্যক্তিদের সহযোগিতায় ভারতের উন্নত পরিষেবার সুযোগ নিতে আরও বহু মানুষ সীমান্ত পেরিয়েছে?আমরা হাসিনা সরকার ও আওয়ামী লীগকে ভালো বলছি কিন্তু তারাও ধরে রাখতে পারিনি?। CAA, NRC এর মত সমস্যায় ওপার থেকে আগত হিন্দু সমাজের বিশেষ করে মতুয়াদের ভাগ্য ঝুলে আছে -কাগজ পত্র না খুঁজে পেয়ে মাঝে মাঝে আত্মহত্যার খবর আসছে, আসামের একটা বিশাল অংশের মানুষ যার অধিকাংশ বাঙালি হিন্দু আজ অসহায়। তার সাথে আবার বাংলাদেশ ও ভারতীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির উস্কানিতে দুই দেশেই অস্থিরতা আগামীর জন্য সুখকর নয়!আসুন আমরা বরং এই হিন্দু মুসলিম খেলা না খেলে উগ্রতার প্রতিবাদ করি তবে পরিশেষে আবারও বলি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ভারতীয় ললিপপ না দেখিয়ে বরং তাদেরকে নিজেদের মত করে মোকাবিলা করতে দিন, যেমন করে ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলিমরা লড়াই করে চলছে -তার জন্য তারা কোনো বিদেশী শক্তির সাহায্য চাইনি। প্রয়োজনে বাংলাদেশের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে। আর একটা কথা ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একটি শক্তিশালী প্রতিনিধি কিন্তু বৈদেশিক নীতি নিয়ে আরও সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। এমনিতেই চিন, পাকিস্তান ভারতের ঘোষিত শত্রু। ইদানিং সম্পর্ক খারাপ হয়েছে মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান এর সঙ্গে|সম্প্রতি বাংলাদেশকে সেই তালিকায় যুক্ত করলে বিষয়টি আগামীতে আরও জটিল দিকে যাবে। এদিকে উত্তর পূর্বের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে চিনের ঘৃণ্য চক্রান্ত চলছে। মনিপুর অশান্ত। কাশ্মীর নিয়ে এমনিতেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ|আমি আশাবাদী ভারত বাংলাদেশের মধ্যেকার মিত্র সম্পর্ক দ্রুত মেরামতি হবে। এক্ষেত্রে উভয় দেশকে আরও সংযত ও সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সীমান্ত উত্তেজনা দ্রুত প্রশমিত করা দরকার। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে সম্পর্ক মজবুত করতে হবে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ ও অন্তরবর্তীকালীন সরকারকে আরও দায়িত্ববান হতে হবে। দুই দেশ একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাভাব রাখতে হবে। ভারতীয় পতাকার অবমাননা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ও নিন্দনীয়। সেই সঙ্গে ত্রিপুরায় বাংলাদেশ দুতাবাসে হামলা নিঃসন্দেহে হটকারী কাজ। আর হ্যাঁ সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব জানা নেই তবে মিডিয়া হাউসগুলিকে আরও সংযত হতে হবে। এমনিতেই ভারতীয় সংখ্যালঘুরা ভারতীয় মিডিয়ার মিথ্যাচার ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবে ক্ষুব্ধ। হ্যাঁ প্রতিবেশী দেশের মানুষের প্রতি সহমর্মিতা থাকা উচিৎ আর সমধর্মীয় হলে টান থাকবে এটা স্বাভাবিক। যেমন মুসলিমরা ফিলিস্থিন এর জন্য সোচ্চার হন। তবে নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণার মনোভাব রেখে প্রতিবেশীর প্রতি দরদ সন্দেহ বাড়ায় -মাঝে মাঝে মনে হয় এ যেন উগ্র প্যান ইসলামী ভাবধারার মত উগ্র প্যান হিন্দুত্ব ভাবধারার বিকাশ দেখছি -যারা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকে হিন্দু রাষ্ট্র দেখতে চায় -এ এক ভয়ঙ্কর ইজম! সচেতন নাগরিক মাত্রই এই সব বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তা ভাবনাকে সম্মিলিত ভাবে প্রতিহত করতে হবে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct