ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা জগতের এক ঊজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হলোন হুমায়ুন কবির। তিনি একজন প্রথিতযশা বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, ঘরে বাইরে এক বিশিষ্ট দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ। এই উপমহাদেশে তিনিই প্রথম যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। লিখেছেন ড. শামসুল আলম।
ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা জগতের এক ঊজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হলোন হুমায়ুন কবির। তিনি একজন প্রথিতযশা বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, ঘরে বাইরে এক বিশিষ্ট দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ। এই উপমহাদেশে তিনিই প্রথম যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। আজো এই স্থান উপমহাদেশের কেউ পান নি। ১৯৩০ সালে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সম্পাদক নির্বাচিত হন। এটাও ভারতবাসীদের একটা শ্রেষ্ঠ গর্বের বিষয়।তিনিই প্রথম ইংল্যান্ডের মাটিতে দাড়িয়ে অক্সফোর্ড ক্যাম্পাস থেকে বলতে পেরেছিলেন, “ এই সভা ব্রিটিশ রাজের ভারত নীতির নিন্দা করছে।” তিনিই একমাত্র ভারতীয় যিনি অক্সফোর্ডে থাকাকালীন একসাথে তিনটি ইংরেজী পত্রিকা পরিচালনা করেন, যথা ছাত্র নিউজপেপার, আইসিস ও চেরওয়েল। কবির ১৯৩৩ সালে ভারত শীর্ষক অক্সফোর্ড মজলিস নামে এক বই লেখেন যা ইতিপূর্বে আর কেউ করতে পারেন নি। ভারতে ফিরে আসার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছাড়াও তিনি বাংলা কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করেন। পাশাপাশি তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন, ট্রেডইউনিয়ন করেন এবং বাংলা আইনসভার বিধায়ক নির্বাচিত হন। ৫০-৬০ দশকে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও রাসায়নিক দপ্তরে কেবিনেট মন্ত্রী হন।
হুমায়ুন কবির ১৯০৬ সালের ২২
ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের কোমারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।১৯২২ সালে ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে আই এ পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে বি এ অনার্স এবং এম এ তে প্রথম স্থান লাভ করে অক্সফোর্ডের বৃত্তি পেয়ে ভর্তি হন এক্সেটার কলেজে। ১৯৩১ সালে তিনি দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। অক্সফোর্ডে এত বেশি জনপ্রিয়তা কবিরের মতো আর তখন কারো ছিল না।
১৯৩৩ সালে কবির ড. রাধাকৃষ্ণানের অনুরোধে অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেন এবং অল্প কিছু মাস পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর পদে যোগ দেন। মনে রাখতে হবে, শরৎ চন্দ্র বসু, আবুল হাসেম, সুরাবর্দীদেের সাথে একযোগে হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিদের বাংলা ভাগের বিরোধিতায় মুখর হন। ১৯৫০ দশকে তিনি কেন্দ্রে নেহেরু মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। এরপর তিনি যুগ্ম শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হন। এরপর হলেন কেন্দ্রের শিক্ষা সচিব যা কোন বাঙালী আজ পর্যন্ত হতে পারেন নি। এই সময় তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের ঊজ্জ্বল তারকা এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের উর্দুতে প্রণীত পাণ্ডুলিপি ইংরাজিতে অনুবাদ করেন যা ইন্ডিয়া উইনস্ ফ্রীডম নামে জগৎ বিখ্যাত।এরপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান হন। একাধিক দপ্তরে তিনি নেহেরু এবং শাস্ত্রীর অধীনে মন্ত্রীত্ব করেন। দূর্ভাগ্যবশত, ইন্দিরা গান্ধী তার অনন্যসাধারণ প্রতিভার প্রতি সুবিচার করেন নি। তাকে মাদ্রাজের গভর্নর করতে চাইলে তিনি প্রত্যাখ্যন করেন।
১৯৫২-৫৬ সাল অবধি কবির রাজ্যসভার সদস্য হন এবং ১৯৬২-৬৯ সাল অবধি বসিরহাট কেন্দ্র থেকে লোকসভায় নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬৭ সালে বাংলা কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন অজয় মুখার্জিকে সাথে নিয়ে। ভাঙড়ের একটি নির্বাচনী জনসভায় তিনি বলেন, “ একটা রুটি সেকতে গেলে একপিঠ পুড়ে যাবার আগে অন্য পিঠ সেকতে হয়। তেমনি কংগ্রেসী অপশাসনে রুটির মতো একপিঠ পুড়ছে। এবার আপনাকে অন্যপিঠ সেকতে হবে, অর্থাৎ কংগ্রেস জনবিরোধী সরকারের বদল ঘটাতে হবে।”
হুমায়ুন কবিরের ইংরেজিতে লেখা একাধিক বইয়ের মধ্যে দুটি বই জগৎ বিখ্যাত। সে দুটি হল ইমানুয়েল কান্টের দর্শন এবং নয়া ভারতের শিক্ষা। নদী ও নারী উপন্যাসও বাংলা সাহিত্যে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। তিনি বাঙালি জাতিকে গর্বিত করেছেন যখন দেখি তিনি জাতিসংঘের জাতিগত নিপীড়নের ওপর খসড়া রচনা করার দায়িত্ব পেলেন। প্রসঙ্ত উল্লেখ্য, কবির ১৯৫৭-৫৯ সালে মুসলিম সংখ্যালঘু বিষয়ক এমন নোট তৈরি করেন যাকে নেহেরু কেবিনেট প্রশংসা করে। তিনি ঐ নোটে লেখেন, সংখ্যালঘুরা কেন্দ্রের প্রতিটি দপ্তরে চাকরি তাদের জনসংখ্যা অনুযায়ী কত শতাংশ চাকরি পাচ্ছে তার লিখিত রিপোর্ট সরকারকে পেশ করতে হবে এবং কোথায় কোথায় বঞ্চিত হচ্ছে তাও লিপিবদ্ধ করে তার সমাধান খুজতে হবে। বিখ্যাত সাচার কমিটির রিপোর্টের পূর্বসূরি ছিলেন হুমায়ুন কবির যাকে আজো খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
হুমায়ুন কবির ছিলেন বাংলা সাহিত্যে এক অসামান্য দিকপাল যা,আজকাল অনেকে আমরা আজকাল ভুলে যাই। ১৯৪১ সালে লেখেন কবিতা এবং সমাজ, ১৯৪২ সালে “ সাহিত্যের মূল তত্ত্, ১৯৪৩ এ বাংলার মুসলিম রাজনীতি ১৯৪৫ এ বাংলার কাব্য, পুরুষ এবং নদী, স্বপ্ন সাধ, সাথী, অষ্টাদশী, নদী ও নারী, ভারতে কৃষি শিক্ষার নতুন ধারণা, ১৯৫১তে মার্কসবাদ, ১৯৬১তে মীর্জা আবু ডালিব খান প্রভৃতি।
হুমায়ুন কবিরের পারিবারিক জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। তার স্ত্রী ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের শান্তি দাশগুপ্ত। তার কন্যা লায়লা কবির খ্রিষ্টান ধর্মের জর্জ ফার্নান্ডেজের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার ভাই বাংলার প্রাক্তন মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির হাড়েয়া কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন, যার পুত্র আলতামাস কবির ছিলেন সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি।
১৮ আগস্ট ১৯৬৯ সালে মাত্র ৬৩ বছর বয়সে হুমায়ুন কবিরের মৃত্যু হয়। বাংলা ডথা ভারতের সর্বযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, প্রফেসর, রাজনীতিবিদ হিসাবে হুমায়ুন কবির চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাকে মরণোত্তর ভারতরত্নে ভূষিত করা হলে সমগ্র ভারতবাসী খুশি হবে। কলকাতায় হুমায়ুন কবির ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করলে শিক্ষাজগত উপকৃত হতে পারে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct