তায়েদুল ইসলাম: একটি কথা জনমানসে বার বার উঠে আসে জনপ্রতিনিধিত্বের জায়গায় মুসলিমদের অংশগ্ৰহণ ক্রমশ কমে আসছে। বিশেষ করে বিধায়ক ও সাংসদদের ক্ষেত্রে। সাম্প্রতিক কালে সে দাবি আরও জোরালো হচ্ছে। দাবি উঠছে মুসলিম বিধায়ক ও সাংসদদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ দাবির পিছনে যুক্তি হল মুসলিম বিধায়ক ও সাংসদদের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে বিধানসভা, লোকসভা এবং রাজ্য সভায় মুসলিম সমাজের সমস্যার কথা, তাদের আশা আকাঙ্খার কথা, বিভিন্ন দাবি দাওয়ার কথা তুলে ধরার নেতার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে মুসলিম সমাজের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। দাবি উঠছে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে সব দল মিলিয়ে লোকসভা বা রাজ্য সভায় সাংসদের সংখ্যা খুবই কম। এখানে মুসলিম জনসংখ্যা কমবেশি মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। জনসংখ্যার সমানুপাতে প্রতিনিধিত্ব হলে রাজ্যের ৪২ টি লোকসভার সাংসদের মধ্যে কম করে হলেও ১২ জন মুসলিম সাংসদ হওয়া দরকার। বিধানসভায় ২৯৪ জন বিধায়কের মধ্যে কম করে হলেও ৯৫ জন মুসলিম বিধায়ক হওয়া দরকার। এ দাবি রাজনৈতিক দল, নেতা, কর্মীদের মধ্যে গুরুত্ব না পেলেও জনমানসে জায়গা করে নিচ্ছে।
কিন্তু এ দাবি নিয়ে আলোচনা করার সময় দুটি বিষয় আলোচনার জোরালো দাবি রাখে। প্রথমটি হল,আমাদের দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় কি ধর্মীয় সম্প্রদায় ভিত্তিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার ব্যবস্থা আছে? এর উত্তর নিশ্চয় নাই। তা হলে উপায় কী? উপায় হল পৃথক নির্বাচক ( seperate electorate ) ব্যবস্থা চালু করা যা বৃটিশ ভারতে ছিল। ৪৭ পরবর্তী ভারতে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে এ পথ বন্ধ।
দ্বিতীয় হল, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে নির্বাচিত মুসলিম বিধায়ক বা সাংসদরা কি দলের নির্দেশের বাইরে গিয়ে মুসলিম সমাজের জন্য আলাদা করে কিছু বলতে পারেন? আমাদের বুঝতে হবে তাঁরা মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি নন। মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি হওয়ার জন্য ভোট চান না এবং মুসলিমরাও তাদের প্রতিনিধি তৈরি করার জন্য ভোট দেন না। তাঁরা তো নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং নির্বাচন এলাকার সমস্ত নির্বাচকের প্রতিনিধি। ভোটারও নিজ দলের প্রতিনিধি পাঠানোর জন্যই ভোট দেন। তা ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলি নিজ দলের জনপ্রতিনিধিদের উপর কড়া নির্দেশ জারি করে রাখে দলের মতামত না নিয়ে কোন কথা না বলার জন্য। কেউ কোথাও একটু আধটু সাহস দেখালে দল তাঁকে তৎক্ষণাৎ ভর্ৎসনা করে। পরে বিভিন্ন ভাবে গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। এবং পরবর্তী নির্বাচনে আর টিকিট দেয় না। ফলে বিভিন্ন দলের জনপ্রতিনিধিরা নিজ সমাজের আশা আকাঙ্খার কথা বলার ইচ্ছা থাকলেও বলার ঝুঁকি নেন না। ফলে বিভিন্ন দলে মুসলিম বিধায়ক ও সাংসদের সংখ্যা বৃদ্ধি হলে মুসলিম সমাজের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। চারপাশে খোঁজ নিলে অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। কংগ্রেসের নেতা এ আর আনতুলে কেবলমাত্র এই দাবি তুলেছিলেন কারকারের মৃত্যুর আগে এক ঘন্টা পর্যন্ত তাঁকে কে কে ফোন করেছিলেন তা তাঁর ফোন কল তদন্ত করে দেখা হোক। এই অপরাধে তাঁকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। তা ছাড়াও অনেক জনপ্রতিনিধি বিশেষ করে কথিত বামপন্থীরা নিজেরাই মনে করেন কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা করে কিছু বলা তাদের আদর্শ বিরোধী। মাত্র দুটো টাটকা উদাহরণ দিচ্ছি। জঙ্গীপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা হলেন হাজী লুৎফল হক, সম্বল স্যান্যাল, জয়নাল আবেদিন, আইনজীবী, প্রণব মুখার্জি, অভিষেক মুখার্জি, খলিলুর রহমান। কে কতটুকু কাজ করেছেন জঙগীপুরে কান পাতলেই বোঝা যাবে। বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলার সমস্ত স্তরে নেতা ও জনপ্রতিনিধির প্রায় সবটাই মুসলিম। এখন কি মুর্শিদাবাদের মুসলিমদের আশানুরূপ উন্নয়ন হচ্ছে। এখন তো আগের চেয়েও দুর্নীতি, স্বজন পোষণ, অব্যবস্থা ও বঞ্চনা বেশি। ফলে মুসলিম সমাজের আশানুরূপ উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দলে মুসলিম বিধায়ক ও সাংসদের সংখ্যা বৃদ্ধি কোন সমাধান নয়।
তা হলে সমাধান কী? আসলে কোন সমাজের উন্নয়ন নির্ভর করে রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। মুল প্রশ্ন হল, মুসলিম সমাজের প্রতি কোন দলের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন। তাই মুসলিম সমাজের প্রতি যে দলের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক বা যে দল মুসলিম সমাজের স্বার্থে কাজ করে সেই দলের বিধায়ক ও সাংসদের সংখ্যা বৃদ্ধি হলে মুসলিম সমাজের জন্য কিছু ভাল আশা করা যায় তাদের ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক না কেন। আবার যে দলের দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম সমাজের প্রতি নেতিবাচক বা যে দল মুসলিম সমাজের উন্নয়নের বিষয়ে আন্তরিক নয় সে দলের বিধায়ক ও সাংসদের সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও লাভ নেই যদিওবা তাদের ধর্মীয় পরিচয় মুসলিম হয়। এ রাজ্যে সিপিআইএম এবং তৃণমূল এর দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।
তা হলে পথ কী? পথ হল, বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা। এবং যে সব দল মুসলিম সমাজের জন্য কাজ করে তাদের প্রতিনিধি পাঠানোর ব্যবস্থা করা। বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় (FPTP) ছোট দলগুলোর প্রতিনিধি পাঠানো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তন করে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব( PR) ব্যবস্থা চালু করলে ছোট দলগুলোর পক্ষে প্রতিনিধি পাঠানো সহজ হবে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct