ভারতে উচ্চ শিক্ষার রূপরেখা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঠিক করার জন্য নানা সময়ে বহু কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সঠিক রূপরেখা তেমন ভাবে তৈরি করতে পারেনি আজও কোন কমিশন। আসলে বহুভাষা, বহু মত ও বৈচিত্র্যের মধ্যে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি করা অত্যন্ত কঠিন কাজ তেমনি ভাবে শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি চরমে। লিখেছেন ড. মুহাম্মদ ইসমাইল।
ভা রতে উচ্চ শিক্ষার রূপরেখা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঠিক করার জন্য নানা সময়ে বহু কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সঠিক রূপরেখা তেমন ভাবে তৈরি করতে পারেনি আজও কোন কমিশন। আসলে বহুভাষা, বহু মত ও বৈচিত্র্যের মধ্যে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি করা অত্যন্ত কঠিন কাজ তেমনি ভাবে শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি চরমে। তাই শিক্ষা ব্যবস্থা সংবিধানের যুগ্ম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মতামত বিনিময় এবং রাজ্য চাইলে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে পারে। তবে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় বরাবর উপেক্ষিত দেশীয় সমাজ ব্যবস্থা ও সমসাময়িক ব্যবস্থাপনা। ভারতের শিক্ষাবীদেরা সর্বদা বিদেশি শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করেছেন। তার প্রধান কারণ হলো ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জয়যাত্রা শুরু হয় বিদেশি শাসকদের হাত ধরে। তারা সেই সময়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, মাদ্রাসা থেকে শুরু করে সবটাই গড়ে তুলেন নিজেদের স্বার্থে। সিলেবাস থেকে শিক্ষণ পদ্ধতি সবটাই তারা তৈরি করেছিলেন তাদের শাসন ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য। তাই ভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষিতরা সরাসরি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেনি। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষেরা ছিল মাদ্রাসা, গুরুকুল থেকে শুরু করে নানা দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে। শুধু তাই নয়,তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলে পঠন-পাঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের উপর সুদীর্ঘ সময় ধরে কীভাবে শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা যায়। তাই বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, উপাচার্য, শিক্ষকেরা ও বেশির ভাগ বিদেশি ছিল। আসলে তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশের মধ্যে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন বিভাগে অনুগত দক্ষ প্রশাসক ও করণিক তৈরি করা। তা কিন্তু তারা করতে সক্ষম হয় এবং ভারতবর্ষে তারা দীর্ঘ ১৯২ বছর ধরে শাসন কায়েম রাখেন। অবশেষে ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হলে, ব্রিটিশদের ছেড়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলে একই শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখে। তারা কোন সময় উপলব্ধি করেনি ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির আদলে দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে পঠন পাঠন চালু করতে। সেই ধারা আজও অব্যাহত। আজও শোনা যায় তাদের সাথে তাল মিলিয়ে ভারতের বিভিন্ন পাঠক্রমের সিলেবাস ও কোষ কারিকুলাম থেকে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুকরণ করতে। আজও আমাদের লক্ষ্য পড়াশোনা করে বিদেশের সেবায় যাতে নিযুক্ত হতে পারি। সেই পদ্ধতি অনুকরণ করে আজও ছাত্র-ছাত্রীদের তৈরি করা হয়। ফলে দেশের মেধাবী থেকে মাঝারি মেধাবী বিদেশে কর্মরত। দেশ আজও উন্নয়নের নিরিখে পিছিয়ে ও দেশের মেধাবীরা বিদেশে চাকরি করে নোবেল থেকে শুরু করে নানা পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছেন। আর আমরা বিদেশের উন্নয়ন দেশের সন্তানের দ্বারা দেখার পর উল্লাস করছি। উচ্চ শিক্ষা থেকে বুনিয়াদি সবটাই নিয়ে দেশবাসী হতাশায়। কারণ দেশের আদলে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্যক্রম করা হয়নি। সামাজিক এবং পরিকাঠামগত উন্নয়নকে গুরুত্ব না দিয়ে বারবার স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা ও নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। তার ফলে শিক্ষার প্রকৃত ফলাফল ও বাস্তবায়ন হয়নি। ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো পরিকাঠামো গত কমতি ও ছাত্র শিক্ষকের কম অনুপাত। এছাড়া বিষয় ভিত্তিক নানা কোষের উপযুক্ত এবং যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক শিক্ষিকার ঘাটতি। ফলে বিদেশি আদলে তৈরি শিক্ষানীতি কোনোভাবেই সঠিক বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯১৪ সালে কেন্দ্রে নতুন সরকার আসার পর থেকে এমন হাবভাব করছেন যেন সবকিছুকেই উপেক্ষা করে আবেগ ও ইমোশনাল বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দেশের সবকিছু পরিবর্তন করে দেবেন। দেশের ইতিহাস পরিবর্তন থেকে জায়গার নাম পরিবর্তন এবং পঠন-পাঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে কয়েকবার সিলেবাস পরিবর্তন করে ফেলেছেন। কখনো বৈদিক শিক্ষা আবার কখনো সাংস্কৃতিক শিক্ষা, কখনো ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করানোর মতো পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়েছে। তার প্রধান কারণ অভাব ও অনটন। যে দেশের ৩৫ শতাংশের বেশি মানুষের দুবেলা খাবারের নিশ্চয়তা নেই, সেই দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনি কারণ বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। শিক্ষা ব্যবস্থার নীতি নির্ধারকেরা নানা সময়ে দুর্নীতির বেড়াজালে বন্দী হয়ে হাবুডুবু খায়, সেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বমানের হবে তা কল্পনাতীত। শুধু তাই নয়, স্কুলের বিভিন্ন উন্নয়ন খাতের টাকা, যে দেশের শিক্ষক, আধিকারিক কারচুপি করে ও বাচ্চাদের মিড ডে মিল, পোশাকের টাকায় কারচুপি করে,সেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্ব দরবারে পৌঁছাবে কীভাবে। যে দেশের শিক্ষক নিয়োগে কারচুপি হয় ও সরকারকে দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেয় শিক্ষিত যুবক যুবতীরা, সেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কীভাবে অগ্রগতি আশা করা যায়। শুধু তাই নয়,যোগ্যদের বঞ্চিত করে ঘুষ ও তেলবাজি করে বিভিন্ন আসন ও পদ অধিষ্ঠিত হন তাদের থেকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন কীভাবে আশা করা যায়। তারা সবকিছু জানার পরও বিভিন্নভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেদের বিলাসিতা করার জন্য বিভিন্ন কমিটি গঠন করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, মেনটর, পরামর্শদাতা হিসাবে নিয়োজিত হয়ে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন। তাদের থেকে দেশের শিক্ষা নিয়ে নতুন ভাবনাচিন্তা বাস্তব সম্মত নয়। তবে গত কয়েক দশক ধরে, শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে প্রতারণা ও নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য নানা ফাঁকফোকর বের করেছেন। দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোয়ালিটি পরীক্ষা করার জন্য সর্বভারতব্যাপী নেক মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাদের কার্যকলাপ অত্যন্ত হাস্যকর। দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে নেকের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, না হলে অনুমোদন বাতিল করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সরকারি কলেজ গুলো বিভিন্ন রাজ্যে সরকার দ্বারা পরিচালিত। পঠন পাঠন, শিক্ষক নিয়োগ, পরিকাঠামো থেকে সবকিছুর দায়িত্বভার তাদের উপর। অনেক ব্যক্তিগত কোন কাজ করতে পারে না সরকারি নির্দেশনা ছাড়া। কি পড়ানো হবে,কতজন শিক্ষক দেওয়া হবে, পরিকাঠামো গত উন্নয়নে কত টাকা অনুমোদন দেওয়া হবে সবটাই নির্ভর করে সরকারের উপর। তারপর নাকি কলেজ কর্তৃপক্ষকে মূল্যায়নের শামিল হতে হবে। তারা বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখে কি দিবে তার উপর নির্ভর করে। কেন্দ্র সরকারের নানা অনুদানের জন্য আবেদন করতে পারবে। তবে মূল্যায়নে সন্তোষজনক নাম্বার না পেলে বঞ্চিত হবে সবকিছু থেকে। শুধু তাই নয়, মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা করতে হবে এবং পিয়ার টিমের জন্য যাতায়াত খরচ, খাওয়া দাওয়া, অগ্রিম খরচ জমা করতে হবে। পিয়ার টিমকে খুশি করতে পারলে মিলতে পারে ভালো নাম্বার। তারপর দুর্নীতিবাজ ঘুসখোর সদস্য হলে ভাগ্য পরিবর্তন হতেই পারে। তারপর দেশের উন্নয়ন ও একত্রিত কারণে বহু মানুষ নিরলস প্রচেষ্টা করছেন। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষা নীতি গ্রহণ করা হয়েছে বিদেশি শিক্ষানীতির অনুকরণে। তারফলে ভারতীয় সমাজের বড় একটা অংশ আজও শিক্ষার সাথে তাল মিল রাখতে না পেরে আড়াল থেকে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভারতীয়রা গ্রহণ করতে পারেনি ও অনেক সময় নানা রাজ্যের বিরোধ দেখা গেছে।
লেখক: অধ্যাপক, দেওয়ান আব্দুল গণি কলেজ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct