সারিউল ইসলাম, মুর্শিদাবাদ, আপনজন: এপারে মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা, পদ্মা পার হলেই ওপারে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ। মাস চারেক ধরে মুর্শিদাবাদের লালগোলা ব্লকের তারানগর এলাকায় পদ্মা ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সপ্তাহ তিনেক আগে অব্দি একটু একটু করে বিঘের পর বিঘে জমি তলিয়ে গিয়েছে পদ্মার গর্ভে। ভাঙনে পদ্মায় তলিয়ে যাওয়া দুই শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে পদ্মায় নিখোঁজ হন লালগোলার ডিআইবি সিভিক ভলেন্টিয়ার আসিকুল ইসলাম। ভাঙনের জেরে ঘরছাড়া হয়েছে এলাকার প্রায় ৩০ টি পরিবার। খান্দুয়া বিএসএফ ক্যাম্পের সঙ্গে তারানগর হয়ে দুর্লভপুর সহ তৎসংলগ্ন সীমান্ত এলাকার একমাত্র রাস্তা ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার জেরে সীমান্তের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা করছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এক বিএসএফ আধিকারিক বলেন, ‘রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় আমরা গাড়ি নিয়ে পেট্রোলিং করতে পারছি না। প্রায় ১০ কিলোমিটার ঘুরে পৌঁছতে হচ্ছে নির্দিষ্ট স্থানে।’
অন্যদিকে ঘর ছাড়া ৩০ টি পরিবার এখন খোলা আকাশের নিচে ঘুমহীন অবস্থায় রাত কাটাচ্ছে। যাদের অন্য কোথাও ব্যবস্থা হয়েছে, তারা চলে গিয়েছেন এলাকা ছেড়ে। কিন্তু বাকি ৩০ টি পরিবার ত্রিপল খাটিয়ে রাত্রি যাপন করছে খোলা আকাশের নীচে।
মুর্শিদাবাদ জেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতবছর লালগোলা ব্লকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। তারানগর এলাকায় ঝোপঝাড়, নালা বেশি থাকায় মশার উপদ্রব বাড়ছে বলে সেখানকার বাসিন্দাদের দাবী। খোলা আকাশের নিচে বসবাস করা মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্ক থেকেই যাচ্ছে। অন্যদিকে বছর যত শেষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে শীত বাড়ছে। খোলা আকাশের নিচে বসবাস করা ৩০ টি পরিবার শীতের সময় বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে কিভাবে থাকবে, সেই চিন্তায় মাথায় হাত পড়েছে বাসিন্দাদের।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, ‘সরকারি ত্রাণ মাত্র একবার মিলেছিল তিন মাস আগে। প্রশাসনিক আধিকারিকরা আসেন, দেখেন এবং চলে যান। কোন সুরাহা হয় না।’ সেখানকার স্কুল পড়ুয়াদের পড়াশোনা শিকেই উঠেছে। বাসিন্দারা বলছেন, ‘আমাদের খাওয়া দাওয়ার ঠিক নেই, বাচ্চাদের পড়াশোনা অনেক দূরের কথা।’ কারো বই পদ্মার গর্ভে, তো কারোর হারিয়ে গিয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে তারানগর।
লালগোলার তারানগরের ভাঙনে সরকার পদক্ষেপ না নেওয়ায় প্রতিবাদে সরব হয়েছে বিশিষ্ট মহলও। ভাঙনের পাশে গিয়ে ভাঙনের ছবি এঁকে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন লালগোলার বাসিন্দা চিত্রশিল্পী ও পেশায় শিক্ষক মোহাম্মদ মিজানুর খান। তিনি বলেন, ‘এই মাটিতে আমার জন্ম, সেই মাটি একটু একটু করে ভেঙে চলে যাচ্ছে তার দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারিনি। নিজের কাজের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছি। কেবলমাত্র একটি ছবি নয়, ভাঙন নিয়ে একাধিক ছবি এঁকেছি আমি। কয়েক সপ্তাহ আগে দুই শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে যে সিভিক ভলেন্টিয়ার নিখোঁজ হয়েছে, সেই আসিকুল ইসলাম আমারই ছাত্র। তাকে নিয়েও ছবি এঁকেছি। ঘরবাড়ি পদ্মায় ধসে পড়ার দৃশ্য সহ বিভিন্ন ভাঙনের দৃশ্য আঁকা হয়েছে।’
ভাঙনের পাশে দাঁড়িয়ে ভাঙনের ছবি এঁকে তার শিল্পকলার মাধ্যমে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন তিনি। সকল স্তরের মানুষকে প্রতিবাদে সামিল হওয়ার আহ্বানও করেন ওই শিক্ষক। এখন লালগোলার তারানগর চাইছে ভাঙনের স্থায়ী সমাধান। সামসেরগঞ্জ ব্লকের মত লালগোলা ব্লকের অবস্থা যেন ভয়াবহ না হয়। সীমান্ত লাগোয়া তারানগরে পদ্মা ভাঙন রোধে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার একযোগে কাজ করে হলেও ভাঙন রোধ করা হোক। দাবি জানাচ্ছে সেখানকার বাসিন্দারা। সীমান্তের নিরাপত্তা সচল রাখতে ভাঙন রোধ করে রাস্তা মেরামত করা খুবই জরুরি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct