পাশারুল আলম: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক ফোরাম হিসেবে পরিচিত “কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিজ” বা COP, বর্তমানে বৈশ্বিক পদক্ষেপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (UNFCCC)-এর আওতায় প্রতিবছর এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিশ্বের দেশগুলো একত্রিত হয়ে জলবায়ু কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারণে অংশগ্রহণ করে। ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত সংকটের মুখোমুখি বিশ্বে COP সম্মেলনগুলোর গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।
এদিকে আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে ডোল্যান্ড ট্রাম নির্বাচিত হওয়ায় পরিবেশবিদরা চিন্তিত। কেননা, তিনি এই বিষয়ে মোটেই আগ্রহী নন। যদিও এই সম্মেলন ট্রামপের আসনে বসার পূর্বে অনুষ্ঠিত হবে। তবু ভয় কখন তিনি চুক্তি থেকে বেড়িয়ে যান।
এই বছর, আজারবাইজানকে 29 তম কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিস (COP29) এর সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছে, যা ১১ থেকে ২২ নভেম্বর বাকুতে অনুষ্ঠিত হবে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি সহ জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত করার জন্য অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহন ও এই প্রচেষ্টাকে অগ্রসর করতে বিভিন্ন পরিবেশবিদ ব্যবসায়িক নীতি নির্ধারকরা এবং এনজিও নেতৃত্ব উপস্থিত থাকবেন।
বর্তমান পরিবেশগত পরিস্থিতি:
জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান চিত্রটা উদ্বেগজনক। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ইতোমধ্যে প্রায় ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস প্রাক-শিল্প স্তরের উপরে বেড়েছে, যার প্রধান কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত গ্রীনহাউস গ্যাস। এই উষ্ণায়ন পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে—চরম আবহাওয়া, যেমন হারিকেন, দাবানল, খরা এবং বন্যার মতো ঘটনাগুলির তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও হিমবাহ গলে যাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, এবং বাস্তুতন্ত্র মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে, যা বহু প্রজাতিকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বায়ু ও জলের গুণমানও ব্যাপক হারে কমছে, যার ফলশ্রুতিতে বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ অকাল মৃত্যুর সম্মুখীন হচ্ছে। বায়ু দূষণের পাশাপাশি বন উজাড়, অপ্রতুল কৃষি পদ্ধতি এবং অন্যান্য অনৈতিক কাজের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, যা বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য এবং কার্বন শোষণের ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ণ করছে।
পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ সমস্যা:
যদি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মানবজাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। চরম আবহাওয়া পরিস্থিতির আরও তীব্রতা, খাদ্য ও পানির ঘাটতি, বাসস্থান সংকট এবং একাধিক অঞ্চল বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে, যার কারণে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। এই সংকট যে জীব জগতের জন্য এক অঘোষিত যুদ্ধ তা নিয়ে সমগ্র বিশ্ববাসী চিন্তিত। একদিকে পুঁজিবাদের বিস্তার তাদের নির্মিত লক্ষ লক্ষ কল কারখানা অন্য দিকে নানা ধরনের বিষাক্ত অস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োগ। বিশ্বের পরিবেশকে বাসযোগ্য থাকতে দিচ্ছে না। এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুধু পরিবেশগত সংকট নয়, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। দুর্বল ও উন্নয়নশীল দেশগুলো এই পরিবর্তনের জন্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, জীবিকার হ্রাস এবং স্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং সংঘর্ষের ঝুঁকি থাকবে, কারণ সম্পদের অভাব বাড়তে থাকবে।
COP সম্মেলন এবং তার সম্ভাব্য সমাধান:
COP সম্মেলনগুলি আন্তর্জাতিক জলবায়ু কর্মের রূপরেখা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। COP21-এর প্যারিস চুক্তি অন্যতম উল্লেখযোগ্য অর্জন, যেখানে বিশ্ব উষ্ণতাকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার এবং আদর্শভাবে ১.৫ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ করার অঙ্গীকার করা হয়। তবে এসব প্রতিশ্রুতি যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে বাস্তবায়িত না হওয়ায় নির্গমনের হার বাড়তে থাকায় বিশ্ব এখনও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের নেতৃত্ব ভালো ভালো কথা বললেও নিজ নিজ দেশে তা পালন করতে অনীহা দেখা যায় । তাই কমার থেকে দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। একদিকে যেমন জলবায়ু দূষিত হচ্ছে তেমনি পরিবেশ ধ্বংস হতে বসেছে।
তাই বর্তমান COP সম্মেলনে আরও সুনির্দিষ্ট ফলাফলের ওপর জোর দেয়া হয়েছে, যাতে কার্বন নির্গমন হ্রাস, নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়ন বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে যে দেশগুলো তাদের প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে তাদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (NDC) পুনর্বিবেচনা করবে এবং আরও শক্তিশালী করবে। এই নিয়ে যদি উন্নত দেশগুলির আগ্রহ না থাকে তাহলে সমুহ বিপদ। তাই এই সম্মেলন বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এর সম্মুখীন হবে।
চ্যালেঞ্জ সমূহ এবং সম্ভাব্য সমাধান:
COP সম্মেলনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল সব দেশের মধ্যে চুক্তি নিশ্চিত করা। উন্নয়নশীল দেশগুলো, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কম দায়ী কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তারা প্রায়শই আর্থিক সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়। উন্নত দেশগুলো প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও এই লক্ষ্য এখনও পুরোপুরি পূরণ হয়নি। বর্তমান COP সম্মেলন আর্থিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে।
এই চ্যালেঞ্জ গুলির অন্যতম জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসা এবং নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর। কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রসারে সাফল্য অর্জন করেছে, তবে অনেক দেশের জন্য কয়লা, তেল, এবং গ্যাসের উপর নির্ভরতা একটি বড় বাধা। COP সম্মেলন কয়লার ফেজ-আউট টাইমলাইন এবং জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য ভর্তুকি হ্রাসের বিষয়ে আলোচনা করার একটি ফোরাম হিসেবে কাজ করে।
কর্মীদের ভূমিকা এবং আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ:
COP সম্মেলনে গ্রেটা থানবার্গ এবং মেধা পাটকারের মতো আন্তর্জাতিক কর্মীরা জলবায়ু ন্যায়বিচার ও সমতার জন্য লড়াই করছেন। এশিয়া, আফ্রিকা, এবং ল্যাটিন আমেরিকার কর্মীরা তাদের আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ গুলোকে বৈশ্বিক আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে আহ্বান জানাচ্ছেন। তারা উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে জলবায়ু অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তার ওপর জোর দেন। তাদের দাবি, ধনী দেশগুলোর নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করার। এই কাজ করতে গেলে এক দিকে যেমন অর্থের প্রায়োজন তেমনি বিভিন্ন দেশের এই বিষয়ে আন্তরিক হওয়া আবশ্যক। রাষ্ট্রের ভূমিকা বিষয়ে জনগনকে একদিকে যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি সরাসরি রাষ্ট্রের কাছে নালিশ জানাতে হবে। তা না হলে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
ভারত ও দক্ষিন এশিয়া :
ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার মতো অঞ্চলে বায়ু দূষণ, জলের সংকট এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনা COP সম্মেলনে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। ভারত নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং COP আলোচনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাশে দাঁড়াচ্ছে। তবে ভারতেও প্রচুর ছুট দেওয়া হয়। তার ফলে দেশের দিল্লী সহ একাধিক শহর তার পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছে। গঙ্গা দূষণ নিয়ে বড় বড় কথা ও অর্থ ব্যয় বরাদ্দ শোনা গেলেও বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলে।
তাই পরিশেষে বলা যায়, COP সম্মেলন বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। যদিও বিগত সম্মেলনগুলো কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবে ক্রমবর্ধমান সংকটের মুখে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন। বর্তমান COP সম্মেলনে দেশগুলো উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং যাচাইযোগ্য লক্ষ্যের ওপর জোর দিলে তা স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে। তবে সাফল্য অর্জনের জন্য বৈশ্বিক সহযোগিতা, স্বচ্ছতা, এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি। অন্যথায়, ভবিষ্যত প্রজন্মকে একটি কঠিন পরিবেশ এবং হ্রাসকৃত প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে বসবাস করতে হতে পারে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct