বর্তমানে সামাজিক মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ শিল্প যার মধ্যে নিযুক্ত বহু মানুষের কর্মকান্ড। যেখানে নিযুক্ত অসংখ্য মানুষ ও কোটি কোটি মানুষের আমোদ ফুর্তি করার মাধ্যম। এছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্লাটফর্ম হিসাবে কাজ করছে এবং পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমের সুযোগে মানুষের জীবনে বহু জিনিস অত্যন্ত সহজলভ্যে পরিণত হয়েছে। তাই সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার কমিয়ে ভালো কাজে ব্যবহার করতে হবে। তবেই মানুষের জীবনে সমাজ মাধ্যম আশীর্বাদ হিসেবে বর্ষিত হবে। লিখেছেন ড. মুহাম্মদ ইসমাইল...
সা হিত্য নয়, সমাজমাধ্যমই বর্তমান সমাজের আয়না। আজকাল সকাল থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছু সমাজ মাধ্যমে আপডেট দেওয়া অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যুবক-যুবতী থেকে বৃদ্ধ -বৃদ্ধা। শুধু তাই নয়, মানুষ আজকাল ব্যক্তিগত বহু জিনিসও সমাজ মাধ্যমে শেয়ার করছেন কোন ভাবনা চিন্তা না করে। আমার বউ, আমার ছেলে, আমার মেয়ে থেকে নানা ছবি ও কার্যকলাপ শেয়ার করছেন। তার ফলে ঘরের বউ, ছেলে মেয়ে থেকে শুরু করে সকলেই পরিচিত পাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে। যদিও তারা পাড়া প্রতিবেশী থেকে নিজের বাবা-মা, ভাই-বোনদের মাসে একবার খবর রাখে না। অথচ প্রতিদিন সকাল ও বিকালে সমাজ মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করে কেমন আছো বন্ধুরা। উৎসব, জন্মদিন, পূজা-পার্বণ এর মত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে বাবা, মা, আত্মীয়-স্বজন নয় তারাই আজকাল আমন্ত্রিত ও বন্ধু-বান্ধবদের তালিকায়। শুধু তাই নয়, দুবেলা দুমুঠো বৃদ্ধ বাবা ও মাকে যারা খেতে দিতে পারে না তারাই আবার বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে নানা রকমারি খাবারের ছবি রান্না করে নানা মাধ্যমে শেয়ার করেন। শুধু তাই নয়, পড়াশোনা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম সম্পাদন হয় যার ফলে হাজার হাজার বেকার যুবক-যুবতী কাজের সন্ধানে পেয়েছেন। সামাজিক মাধ্যম মানে নানা রকমারি বিজ্ঞাপন ও নিজেকে মেলে ধরার খুব গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। শুধু তাই নয়, মতামত প্রকাশ ও যেমন খুশি তেমন সাজো অর্থাৎ আমরা সকলেই রাজারানী সামাজিক মাধ্যমের সুবাদে। তারপরে একদিকে যেমন অসংখ্য গ্রাম বাংলার ছেলে মেয়েরা জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন তাদের নিজস্ব প্রতিভা উপস্থাপন করে। তেমনি ভাবে বহু ছেলে মেয়ে নানা পেজ ও চ্যানেল খুলে নিজের নিজস্বতা প্রচার ও প্রসার করে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করছে। সামাজিক মাধ্যম সকলের জীবনে নতুন একমাত্রা যোগ করেছে এবং সকলেই যেন গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কাজ করছে। যেখানে মানুষ তাদের আঞ্চলিক ভাষাভাষী, রেওয়াজ, রীতিনীতি, আচার আচরণ, সংস্কৃতি, নাচ-গানের অনুষ্ঠান ও বক্তব্য তুলে ধরে জনপ্রিয় সিনেমা জগতের নায়ক নায়িকাদের টক্কর দিচ্ছেন। বহু সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েদের ফ্যান ও অনুগামীর সংখ্যা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, সমাজকর্মী, নায়ক-নায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থেকেও বেশি। সামাজিক মাধ্যমের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার ফলে মানুষের নিজস্বতা, রুচিবোধ, পারিবারিক মর্যাদা, বংশ ক্রম থেকে শুরু করে বহু জিনিস পরিবর্তন হয়েছে। পর্দার আড়ালে অবলা নারী, স্বতী- সাবিত্রীরা তাদের মত করে উপঢোকন সাজিয়ে সমাজ মাধ্যমে হাজির হয়েছে। তেমনই ভাবে বহু নারী নিজেদের রূপ, সৌন্দর্য, যৌবনকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন পোস্ট, অঙ্গভঙ্গির বক্তব্য, মন্তব্য ও কথাবার্তার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের মনোরঞ্জনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, একদিকে নারী সমাজের একাংশ যেখানে যৌনতার লালশা দেখিয়ে অনুগামীদের আকৃষ্ট করছেন তেমনইভাবে অন্যদিকে নারী সমাজ তাদের দক্ষতা, ভদ্রতা, কৌশল নানা প্রশিক্ষক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে পুরুষেরা কিছুটা হলেও নারীদের থেকে সমাজ মাধ্যমে পিছিয়ে। বিভিন্ন সংস্থা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি অফিস, আদালত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সকলেই সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের মতো অ্যাকাউন্ট খুলে কার্যক্রম প্রচার করছেন। বিবাহ, বিচ্ছেদ, জমি ক্রয়- বিক্রয় থেকে শুরু করে সবকিছু কেনাবেচা চলছে নানা সামাজিক মাধ্যমে। বাজার ঘাট থেকে শুরু করে কেনাকাটা সবটাই আজ বাড়িতে বসে অনলাইনে ও ও অফলাইনে সম্পাদন হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে। নারী পুরুষ তার পছন্দমত সঙ্গিনী খোজা থেকে বন্ধুত্ব স্থাপন করার জন্য নানা বিশ্বাসযোগ্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। যেখানে নিশ্চিত ভবিষ্যতের ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছেন ও পছন্দমত সঙ্গিনী পেয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছেন। আজকাল আর প্রয়োজন হয় না কোন কিছু জানতে কারো উপর নির্ভর করতে। সামাজিক মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করলে লক্ষ লক্ষ পোস্ট ও ভিডিও থেকে শুরু করে নানা উপাদান মিলছে নিমেষে। আজকাল মেয়েদের শশুরালয়ে যাওয়ার জন্য খুন্তি-হাতা নিয়ে মায়ের সাথে হেঁসেলে যেতে হয় না রান্নাবান্না শেখার জন্য। সামাজিক মাধ্যমে সহজেই পেয়ে যাচ্ছে কত হাজার হাজার খাবারের রেসিপি ও রান্না করার পদ্ধতি সহ নানা উপকরণ। সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে শিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের পার্থক্য অনেক কমেছে। শুধু তাই নয়, মানুষ শিক্ষিত হওয়ার পরও যে তার রুচি ও মানের উন্নয়ন হয় না তা ধরা পড়েছে সামাজিক মাধ্যমের কারণে। সামাজিক মাধ্যমের কারণে, ঘরে খাবারে টান পড়লেও সকলের কাছে দামি মোবাইল থেকে শুরু করে নানা ডিভাইস রয়েছে। দেশের ৩৫ শতাংশের বেশি খেতে না পাওয়া মানুষের কাছেও রয়েছে মোবাইল ও তার সংসার খরচে হিমশিম খেলে ও মোবাইল ফোনে দিব্বি চলছে ফেসবুক, ইউটিউব থেকে শুরু করে নানা রংবেরঙের তথ্যচিত্র দেখার আয়োজন। মানুষ বর্তমানে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে গিয়ে নিজেরা সামাজিক মাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে। তার ফলে দেশ ও পৃথিবীজুড়ে নানা অপরাধ, দুর্নীতি ও জঘন্য কাজের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধ ও ছোট ছোট থেকে নানা বয়সের মানুষ ল্যাংটা ছবি ও কুরুচিকর বিজ্ঞাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। শুধু তাই নয়, ছোট ছোট শিশুরা নানা সামাজিক মাধ্যমে পাওয়ার নানা অসামাজিক কাজকর্ম দেখে তাতে লিপ্ত হয়ে পড়ছেন। তাদের আচার-ব্যবহার ও প্রাপ্ত-বয়স্কদের মতো চলাফেরার চালচলন তৈরি হচ্ছে। একটা রক্ষণশীল সমাজের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। এছাড়া সামাজিক মাধ্যমে নানা অভিনয়, কার্যক্রম দেখে আজকের জেনারেশন নানাভাবে প্রলুব্ধ হয়ে পড়ছেন ও ভালো-মন্দের তেমনভাবে পার্থক্য করতে পারছেন না। আজকের দিনে গাড়ি খারাপ হলে অনলাইন সাহায্য, রান্নার স্বাদ ও রকমারি খাবারের সন্ধান থেকে নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজের সন্ধানের জন্য সামাজিক মাধ্যমের উপর নির্ভর করছেন। প্রয়োজন হয় না গুরুজনদের পরামর্শ থেকে হাতেনাতে শেখানোর। তার ফলে বহু মানুষ কাজ হারাচ্ছেন এবং পাচ্ছেন।সমাজ ব্যবস্থা অনেকটা নির্ভরতা কাটিয়ে তুলে স্বনির্ভরের দিকে এগিয়েছে। এই সামাজিক মাধ্যমে ছেলেমেয়েরা সরাসরি শিক্ষকদের ছাড়া শিক্ষালাভ করছেন এবং অক্ষর জ্ঞান থেকে শুরু করে নানা ভাষায় কথা বলা। বিভিন্ন ভাষার অর্থ থেকে শুরু করে অনেক কিছু নিজে নিজে বাচ্চারা শিখছেন।
সামাজিক মাধ্যমের সুবাদে বাচ্চারা আজকাল একাধিক ভাষায় কথাবার্তা বলছেন কিন্তু তাদের হয়তো সেইসব ভাষার সাথে কোন সম্পর্ক নেই একদিনের জন্য। বর্তমানে সামাজিক মাধ্যমে মানব জীবনের মেরুদন্ড মনে করছেন এবং এই মেরুদন্ড সোজা রাখতে হলে সামাজিক মাধ্যমের সাথে সম্পর্ক দৃড় থাকতে হবে। আজকের দিনে বিভিন্ন ধর্মের ধার্মিক তাদের ধর্মের বাণী ও নানা বক্তব্য ধর্মীয় সভা থেকে শুরু করে সারাদিনের ধর্ম, আচরণ-আচার, প্রচার ও প্রসার করছেন বিভিন্ন মাধ্যমে।
পৃথিবীজুড়ে ৫.১৭ বিলিয়ন মানুষ বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছেন, তবে গত নয় বছরে ২.০৭ বিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে।মানুষ গড়ে ৬.৭টা সামাজিক প্ল্যাটফর্মের সাথে জড়িত। বিশ্বব্যাপী ৬৩.৭শতাংশের কাছাকাছি মানুষ সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার করে, তবে ১৮ বছরের বেশি দর্শকদের মধ্যে ৮৬.১ শতাংশ। এছাড়া মাথাপিছু একজন মানুষ দৈনিক ২ ঘন্টা ২০মিনিট ব্যয় করেন সামাজিক মাধ্যমে।সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৪৬.৬ শতাংশ মহিলা এবং ৫৩.৪ শতাংশ পুরুষ। এছাড়া বিশ্বব্যাপী ফেসবুক ব্যবহার করেন ৩.০৭ বিলিয়ন, ইউটিউব ব্যবহার করেন ২.৫বিলিয়ন, হোয়াটসঅ্যাপ 2 বিলিয়ন, ইনস্টাগ্রাম 2 বিলিয়ন, এবং টিকটোক ১.৫৮ বিলিয়ন। এই বিশাল সংখ্যাক মানুষের পরিসেবা ও তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার বহু মানুষের দরকার। শুধু তাই নয়, তাদের চাহিদা পূরনের জন্য নানা প্রশিক্ষিত কর্মচারী থেকে শুরু করে নানা সাধারণ মানুষের দরকার। তার ফলে মানুষ জীবনজীবিকা থেকে শুরু মনোরঞ্জনের জন্য নির্ভর করছে সামাজিক মাধ্যমের ওপর।
শুধু বর্তমানে সামাজিক মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ শিল্প যার মধ্যে নিযুক্ত বহু মানুষের কর্মকান্ড। যেখানে নিযুক্ত অসংখ্য মানুষ ও কোটি কোটি মানুষের আমোদ ফুর্তি করার মাধ্যম। এছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্লাটফর্ম হিসাবে কাজ করছে এবং পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমের সুযোগে মানুষের জীবনে বহু জিনিস অত্যন্ত সহজলভ্যে পরিণত হয়েছে। তাই সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার কমিয়ে ভালো কাজে ব্যবহার করতে হবে। তবেই মানুষের জীবনে সমাজ মাধ্যম আশীর্বাদ হিসেবে বর্ষিত হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, দেওয়ান আব্দুল গণি কলেজ
*** মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct