সাধারণভাবে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ঘরানায় ইসলাম পালন করে, যাহা কঠোরভাবে বা উদারভাবে কোনটাই নয়। ধর্ম বাঙালি মুসলিম সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, কিন্তু সমাজের একমাত্র নিয়ন্ত্রক নয়। এই বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী বেশিরভাগই কৃষক এবং তাদের জীবিকা প্রধানত কৃষিকাজ। তারা জমিদার হিসাবে নয় রায়ত হিসাবে স্বল্প জমির অধিকারী ক্ষুদ্র কৃষক। তাদের বাঙালি সত্তা নিয়ে লিখেছেন বীরভূম জেলার নলহাটির ক্যারিয়ার পয়েন্ট গুরুকুল স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী আসমা তাহরিন।
বর্তমান বিশ্বে বিপুল সংখ্যক মুসলমান, প্রায় ১৭.৩৭ কোটি মুসলিম মানুষ তাদের মাতৃভাষা হিসাবে বাংলায় কথা বলে। এটি বিশ্বের মোট মুসলিম জনসংখ্যার 17% এরও বেশি। এই মুসলিম জনসংখ্যা প্রধানত বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের কাছাকাছি ভারতের কিছু পার্শ্ববর্তী রাজ্যে বসবাস করে। এই মুসলিম জনসংখ্যার বিন্যাস এমন যে বাংলাদেশে ১৩.৬ কোটি মুসলিম বাস করে (বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৯১%), পশ্চিমবঙ্গ ২.৪৭ কোটি মুসলিম (পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ২৭.০১%), আসামে ৯০ লক্ষ মুসলিম, (আসামের মোট জনসংখ্যার ৩৪.২২%) এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাভাষী ভারতের ঝাড়খণ্ড এবং ত্রিপুরা রাজ্যে বাস করে (২০১১ জনগননা অনুযায়ী)। সাধারণভাবে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ঘরানায় ইসলাম পালন করে, যাহা কঠোরভাবে বা উদারভাবে কোনটাই নয়। ধর্ম বাঙালি মুসলিম সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিন্তু সমাজের একমাত্র নিয়ন্ত্রক নয়।
এই বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী বেশিরভাগই কৃষক এবং তাদের জীবিকা প্রধানত কৃষিকাজ। তারা জমিদার হিসাবে নয় রায়ত হিসাবে স্বল্প জমির অধিকারী ক্ষুদ্র কৃষক। তারা সাধারণত নাপিত, কামার, কুমোর, জেলে, ধোপা, মুচি, তেলী, তাঁতি ইত্যাদি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সাথে তাদের জমির কাছাকাছি বাংলার গ্রামীণ অংশে বসবাস করত।
তারা ভারত উপমহাদেশের উচ্চবর্ণের হিন্দু জনসংখ্যার তুলনায় পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের মতো অগ্রসর নয়। কিন্তু তাদের স্বাস্থ্যবিধি, নৈতিক মনোভাব, সামাজিক আচার-আচরণ ইত্যাদি হিন্দু সম্প্রদায়ের উচ্চবর্ণের মতোই। তারা অত্যান্ত সহানুভূতিশীল, সহনশীল, পরিশ্রমী, সামান্য ঘরোয়া সুযোগ-সুবিধা এবং পার্থিব সম্পদের অধিকারী সম্পন্ন মানুষজন।
বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের খাদ্যাভ্যাস তাদের মধ্যে প্রচলিত; তারা তাদের খাদ্য তালিকায় ভাত, মাছ, শাকসবজি ইত্যাদি গ্রহণ করে। পোশাক হিসেবে পুরুষদের পরনে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, পায়জামা ইত্যাদি এবং মহিলাদের পরনে শাড়ির প্রচলন। সাধারণভাবে মহিলারা কোন হিজাব/বোরখা ব্যবহার করে না।
এখন ইতিহাসের এক বিরাট রহস্য যে, এক হাজার বছর আগে বাংলায় ইসলামের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না কিন্তু বর্তমান সময়ে বিপুল সংখ্যক বাঙালি ইসলামের ছাদের তলায় এসেছে। কেন ভারত উপমহাদেশের এই বিচ্ছিন্ন অংশটি মূল ইসলামী ভূমি থেকে অনেক দূরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল? মুসলিম শাসনকাল এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের শুরুতে বাংলায় মুসলিম জনসংখ্যার কোনো ঐতিহাসিক তথ্য ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক পরিচালিত আদমশুমারির মাধ্যমে এটি প্রথম প্রকাশ পায় যে বিপুল সংখ্যক বাঙালি জনসংখ্যা মুসলমান।
ইসলাম ধর্মে বাঙালিদের গণধর্মান্তর নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদরা বাংলায় ইসলামী শাসনের স্বর্ণালী সময়কে ম্লান করতে এবং বাংলার মুসলিম শাসককে ক্ষুদ্র করে দেখানোর জন্য-বলপ্রয়োগ করে ধর্মান্তকরনের মতবাদের উপর জোর দিয়েছিলেন; এবং পক্ষান্তরে তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসনকে হিন্দু সমাজের জন্য কল্যাণকর দেখানোর জন্য এই মতবাদ কে তুলে ধরা হয়েছিল । এবং তাদের ধারা অনুসরণ করে ভারতীয় ইতিহাসবিদরা তাদেরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলায় জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ মতবাদকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অন্যদিকে মুসলিম অভিজাত শ্রেণী মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে বাংলায় মুসলমানদের অভিবাসনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
বাংলার জনসংখ্যা কখন এবং কীভাবে ইসলামের ছাদের নিচে এসেছিল তা নিশ্চিত করা না গেলেও বাংলায় মুসলমানদের ধর্মান্তরিতকরণের প্রকৃত কারণ নির্ধারণের জন্য কিছু ঐতিহাসিক তথ্য ও প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ভিত্তিতে একটি সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে।
বেঙ্গল ডেল্টা হল নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমির নিচু সমতল ভূমি যেখানে এই ব-দ্বীপের মধ্য দিয়ে দুটি মহান নদী গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। ফলে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এই এলাকা কৃষির জন্য উর্বর; এবং প্রাচীনকাল থেকেই সারা বাংলায় যাতায়াত ও যোগাযোগ সহজ ছিল। প্রায় ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বে ভারতের পূর্বাঞ্চলে ইন্দো-আর্য আগমনের আগে অনেক অনার্য উপজাতি সেখানে প্রচুর সমৃদ্ধির সাথে বসবাস করতো। তারা বেশিরভাগই অস্ট্রাল, মুন্ডা, মঙ্গোলয়েড এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মিশ্র উপজাতি; এবং তাদের ভাষা, প্রথা, ধর্ম, সামাজিক সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে খুব গর্বিত জাতি ছিল।
এই ইন্দো-আর্য আক্রমণকারীরা বাংলার জনগণের আর্যকরণের মিশন নিয়ে বাংলা বদ্বীপে এসেছিল; কিন্তু এলাকার মানুষের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের কারণে ব্যর্থ হয়। যদিও এই নবাগত আর্যরা তাদের মিশন পূরণের জন্য আচার-অনুষ্ঠান এবং সামাজিক প্রথার সংস্কার/পরিবর্তন করেছিলেন কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলার জনগণের কাছে তাদের বর্ণ ব্যবস্থা/সামাজিক শ্রেণী ব্যবস্থা বাঙালীকে আকৃষ্ঠ করতে ব্যর্থ হয়। ভারতে বৌদ্ধ আন্দোলন শুরুর আগে এই ইন্দো-আর্য গোষ্ঠী বাংলার বিভিন্ন উপজাতির সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। এবং ইন্দো-আর্য নবাগতদের অনমনীয় মনোভাব বাংলায় বৌদ্ধধর্মের মসৃণ বিকাশের জন্য একটি শক্তিশালী কারণে পরিণত হয়েছিল। মৌর্য রাজবংশের সময় (322 B.C.E থেকে 185 B.C.E), বাংলা বৌদ্ধধর্মকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায় যেহেতু বৌদ্ধধর্ম তৎকালীন বঙ্গীয় জনগণের মানসিকতা অনুসারে নিজেকে সংস্কার/পুনর্বিন্যাস করেছিল। যদিও ব্রাহ্মণ সমাজ স্বল্প সংখ্যক ধর্মান্তরিত বৈদিক জনগণের সাথে বাংলার মূলধারা থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রেখে তাদের গোঁড়ামি রক্ষা করে, তবুও বাঙালি জনগণকে তাদের রীতি ও প্রথা অনুযায়ী বাংলা শাসনের জন্য ধর্মান্তরিত করার জন্য উপযুক্ত মুহুর্তের অপেক্ষায় ছিল। গুপ্ত রাজবংশের সময় (300 C.E থেকে 530 C.E), বৈদিক ধর্ম ভারতে হিন্দু সনাতনী হিসাবে বিভিন্ন চেহেরা নিয়ে পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। ৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে শশাঙ্কের রাজত্বকালে, বাংলার এই ব্রাহ্মণ সমাজের জন্য তাদের লক্ষ্য পূরণের প্রথম সুযোগ আসে এবং শশাঙ্ক ব্রাহ্মণদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন এবং বাংলার বৌদ্ধদের দমন করেছিলেন যা বাংলার জনগণকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই সময়ের মধ্যে বাংলা ভাষা মাগধী প্রাকৃত (পরিবর্তিত সংস্কৃত ভাষা) থেকে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ ভাষা আকারে রূপ লাভ কারে, যা বাংলার জনগণ লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসাবে স্বাগত জানায়। বাংলায় পাল রাজবংশের (৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৬১ খ্রিস্টাব্দ) সময় বৌদ্ধধর্ম আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। এটি ছিল বাংলার স্বর্ণালী যুগ। এই সময় বাংলা স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধশালী হয়; এবং কলা ও স্থাপত্যের অগ্রগতি এই সময়ে পরিলক্ষিত হয়েছিল। পাল রাজবংশের রাজারা সব দিক থেকে উদারপন্থী ছিলেন; তারা সকল ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি সহনশীল ছিল। প্রকৃত অর্থে এই সময়ে বাংলা একটি স্বাধীন ভাষা হিসেবে আবির্ভূত হয়; এই সময়ে রচিত বাংলা ভাষায় প্রথম লিখিত গ্রন্থ ‘চর্যাপদ’। বৌদ্ধ পণ্ডিতরা ভারতের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলির সমস্ত তরুণ পণ্ডিতদের আকৃষ্ট করেছিলেন। পাল রাজবংশের পতনের পর, সেন রাজবংশ একটি ব্রাহ্মণ রাজবংশ বাংলায় ক্ষমতায় আসে। এটা অভিযোগ করা হয় যে তারা ছিল অতি-রক্ষণশীল সনাতন হিন্দু যারা অন্য ধর্ম, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, সামাজিক প্রথার বিরোধিতা করেছিল; এবং ধর্ম ও বর্ণ দ্বারা মানুষকে বিভক্ত করে বাংলায় একটি শক্তিশালী বর্ণপ্রথা প্রতিষ্ঠা করে। তারা বাংলার পরিবর্তে সংস্কৃত ভাষার প্রচার ও প্রসার করে যার ফলে বাংলায় ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দেয়। তারা পূর্ববর্তী যুগের সকল মূল্যবান ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে বলে এমনও অভিযোগ রয়েছে, তারা সকল ধর্মীয়, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিসৌধ, স্থাপত্য এমনকি বৌদ্ধ পন্ডিতদের লেখাও ধ্বংস করেছে বলে কথিত আছে। তারা হিন্দু সমাজকে দুটি শ্রেণীতে পুনর্বিন্যস্ত করেছে - উচ্চ বর্ণ এবং নিম্ন বর্ণ; এমনকি তারা ব্রাহ্মণকে বিভিন্ন স্তরে শ্রেণীবদ্ধ করেছে। দেখা যায় বাংলায় তাদের শাসনকালে বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। সমস্ত বৌদ্ধ পণ্ডিত- শিল্পী, স্থপতি, লেখক, ভাস্কর, চিত্রকর, বক্তারা তাদের প্রতিভা এবং দক্ষতা নিয়ে বাংলা থেকে পালিয়ে যান এবং বাংলায় একটি বড় শিক্ষাগত শূন্যতা তৈরি হয়। এমনকি সমস্ত ঐতিহ্যপূর্ণ রচনাবলী হয় ধ্বংস হয়ে গেছে বা বৌদ্ধ পণ্ডিতরা প্রতিবেশী দেশে নিয়ে চলে গেছে।
মুসলিম সুলতান/রাজার শাসনে আসার অনেক আগে থেকেই বাংলা মুসলমানদের কাছে পরিচিত ছিল। এমন প্রমাণ রয়েছে যা থেকে বোঝা যায় যে প্রকৃতপক্ষে বাংলায় মুসলিম শাসনের আগে অনেক মুসলমান বাংলায় বসবাস করতেন, খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত।
১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি নামে একজন তুর্কী জেনারেল সমগ্র বাংলাকে মুসলিম শাসনের অধীনে নিয়ে আসেন। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির এই উদ্দেশ্যে মাত্র আঠারোজন ঘোড়সওয়ারের প্রয়োজন ছিল বলে একটি বিতর্কিত কাহিনী রয়েছে। এটি হতে পারে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের এটি একটি সরলীকৃত সংস্করণ, যা খুব বেশি প্রতিরোধ ছাড়াই বাংলা জয় হয়েছিল। এটি একটি ইঙ্গিত হতে পারে যে বাংলার স্থানীয় জনগণ বাংলায় মুসলিম বাহিনীর আবির্ভাবকে স্বাগত জানিয়েছে। যেহেতু বৌদ্ধরা, সেন রাজবংশের শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছিল, তারা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজিকে তার বাংলা অভিযানের সময় সাহায্য করতে পারে। অনেক বৌদ্ধ এই মুসলমানদের আক্রমণকে ব্রাহ্মণ্য নিপীড়ন থেকে মুক্তি হিসাবে দেখতে পারে।
খিলজি কর্তৃক বাংলা জয়ের পর, বাংলা স্বাধীনভাবে সুলতান দ্বারা বা দিল্লির গভর্নর দ্বারা 1204 C.E থেকে 1352 C.E যুগে শাসিত হয়েছিল; তারা ইসলামের সুন্নি মাজহাবের অন্তর্গত তুর্কি মুসলমান। ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র বাংলার প্রথম স্বাধীন একমাত্র শাসক হন এবং বাংলায় ইলিয়াস শাহ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ইলিয়াস শাহ রাজবংশ ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়; রাজা গণেশ ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় ক্ষমতায় আসেন, রাজা গণেশের পুত্র জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ ইসলামে ধর্মান্তরিত হন এবং বাংলার প্রথম ধর্মান্তরিত মুসলিম শাসক হন। ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় হাবশী শাসনের সংক্ষিপ্ত সময়ের পরে, ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলায় হোসেন শাহ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলায় পাল রাজবংশ (750 C.E থেকে 1161C.E) শাসন কালের মত এই শাসন কাল বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প ও সাহিত্যকর্ম, তাঁত ও কারুশিল্প এবং স্থপতি ইত্যাদির বিচারে এটি ছিল বাংলার সুবর্ণ যুগ।
এরপর বাংলায় সুর রাজবংশের গভর্নররা (১৫৩২ খ্রি. থেকে ১৫৫৬ খ্রি.) শাসন করেন। মুহাম্মদ শাহ রাজবংশ (1554 C.E-1564 C.E) এবং কররানী রাজবংশ (1564-1576) স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করেছিল। এর পরে বাংলা মুঘলদের গভর্নর/সুবাহদারদের অধীনে আসে (১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দ)।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা দখলের আগে, বাংলা প্রায় স্বাধীনভাবে নবাবদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল (১৭১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ)। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি/ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর/গভর্নর-জেনারেল বাংলার শাসক ছিলেন। ভারত জুড়ে ১৮৫৮ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর, ভারতের অন্যান্য অংশের সাথে বাংলাও ব্রিটিশ রাজের (১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) সরাসরি শাসনের অধীনে আসে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান নামে দুটি অংশে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ভারত স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়েছিল, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এখন পর্যন্ত ভারতের একটি প্রদেশ।
এখন ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণ আনুসন্ধানের মাধ্যমে বাংলার ইসলামিকরণের মূল বিষয়গুলো বিশ্লেষণাত্মকভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদদের পাশাপাশি কিছু ভারতীয় ইতিহাসবিদ জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের উপর জোর দিয়েছিলেন, কিন্তু এটি সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। মিলট, একজন ইতিহাসবিদ যথার্থই উল্লেখ করেছেন যে বাংলার মুসলিম শাসকদের দ্বারা অমুসলিমদের উপর ব্যাপক নিপীড়নের প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলায় ধর্মান্তরিত মুসলিম শাসক জালালউদ্দিন শাহ-এর সময় কিছু সীমিত নিপীড়ন ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু তার মনোভাব ছিল তার পিতা গণেশের প্রতিক্রিয়া, যিনি তার রাজত্বকালে অহিন্দুদের নিপীড়ন করেছিলেন, গণেশ বাংলার একজন হিন্দু শাসক (সীমিত সময়ের জন্য)। জালালুদ্দিনের শাহ এর সমসাময়িক একজন লেখক গোপাল তুর্কিদের দ্বারা ব্রাহ্মণদের নিপীড়নের অভিযোগ এনেছিলেন, কিন্তু এটি স্ববিরোধী কারণ জালালুদ্দিন ছিলেন একজন ধর্মান্তরিত মুসলমান এবং তিনি যিনি গোপাল হালদারের বর্ণনা অনুসারে হিন্দু ধর্মগ্রন্থের বাংলায় অনুবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণের তত্ত্বটি খণ্ডিত হয়েছে এই ভাবে যে -- উত্তর ভারতীয়রা ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত হয়নি যদিও এটি বাংলার তুলনায় মুসলিম শাসকদের প্রত্যক্ষ শাসনের অধীনে ছিল। তাই ইসলাম ধর্মে বাংলার জনগণের ব্যাপক ধর্মান্তরের অনেক কারণ থাকতে পারে কিন্তু জোর করে ধর্মান্তরিত করণ নয়।
এটা ইসলামিক বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে মুসলিম জনসংখ্যার ব্যাপক অভিবাসনের ঘটনা নয়, অন্যথায় বাঙালি মুসলমানের নৃ-দৈহিক বৈশিষ্ট্য বাঙালি হিন্দু থেকে আলাদা হত। বাঙালী মুসলমানের সামাজিক প্রথা, সংস্কৃতি, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পরিধান ইত্যাদির ওপরে বাঙালি হিন্দুর সাথে একই রকম ভাবে মিলে যায়। তাই বাংলায় মুসলিম জনগণের ব্যাপক অভিবাসন নিয়ে স্বাধীনতা-পূর্ব মুসলিম অভিজাতদের দাবি নিরর্থক। কিছু মুসলিম অভিজাত বাংলায় অভিবাসী হতে পারে, কিন্তু সাধারণ মুসলিম জনগণ বাংলার মাটির সন্তান। এটা স্পষ্ট যে তুর্কি মুসলমানদের দ্বারা বাংলায় রাজত্ব করার আগে কিছু প্রচারকের আগমন ঘটেছিল যারা আরব বণিকদের সাথে বাংলায় এসেছিল, কিন্তু এই সময়ে ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা খুব বেশি ছিল না। সুফি প্রচারকরা ইসলাম এর প্রসারে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিল। সুফিরা ইসলাম প্রচারের জন্য মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের আগেই বাংলায় আগমন করেছিল। চিস্তিয়াহ, কাদিরিয়াহ, নকশবন্দিয়া এবং সোহরাওয়ার্দিয়াহ নামক চারটি সুফী ঘারানা জনসাধারণকে ইসলামের ছাদে আনার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। এই সূফী শিক্ষকরা পার্থিব বিষয়ে কোন আসক্তি না দেখিয়ে তাদের সরল একনিষ্ঠ জীবন দ্বারা সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিলেন। সাধারণভাবে তারা ইসলামের একটি পরিবর্তিত এবং সংস্কৃত ধারা অনুশীলন করত যা বাংলার সংস্কৃতি ও রীতিনীতির সাথে অনেক বেশি উপযোগী/উপযুক্ত ছিল। তাদের ইসলাম ছিল ইসলাম এর খোলসে একটি আন্তর্জাতিক ধর্ম। সুফি দরবেশরা ছিল দুর্দান্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এবং দক্ষ প্রচারক, সাথে সাথে তাদের চিন্তাভাবনা/মতাদর্শ একটি সহজ এবং দেশীয় ভঙ্গিতে প্রচারনা করতো যা বিশেষভাবে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। তারা ইসলামের মোড়কে সকল ধর্মকে মান্যাতা দিত। তাদের কাছে ইসলামের দুর্দান্ত ভাবনাগুলি-- যেমন সবার জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, বিশ্বাস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মর্যাদায় সমতা (বিশেষত ধর্মীয় বিষয়ে) এবং সুযোগ, সকলের প্রতি ভাই ভাই মনোভাব, যাজক প্রথা থেকে স্বাধীনতা, জাতপাতের বিভেদ থেকে স্বাধীনতা। . মুসলিম বিজয়ের পর তারা ইসলামী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছিলেন।
নবম শতাব্দী থেকে সুফিরা তাদের মিশন শুরু করলেও, দ্বাদশ শতাব্দীর পর বিশিষ্ট সুফি দরবেশরা বাংলায় আসা শুরু করেন। মহান সূফী ওস্তাদ জালালুদ্দীন তাবরেজী, সোহরাওয়ার্দীয়াহ ঘারানা, সাইখ আবদুল্লাহ কিরমানি, চিস্তিয়াহ ঘারানা, সাইয়েখ জালাল (শাহ জালাল), সোহরাওয়ার্দিয়াহ ঘারানা এবং বিভিন্ন আরও অনেক ঘারানার সুফি সাধক/দরবেশ ইসলাম প্রচারের জন্য তাদের দরদী, অপূর্ব চরিত্র, মানবিক সেবার মনোভাব নিয়ে বাংলায় এসেছিলেন। বাংলায় ইসলাম প্রচারে তাদের তৎপরতার নিদর্শন বাংলার বিভিন্ন অংশে পাওয়া বহু পাথরের শিলালিপিতে পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদ ইবনে-বতুতা দাবি করেছেন যে বাংলায় ইসলামের প্রসার --এই সুফি প্রচারকদের মহৎ প্রচেষ্টা। বাংলার গণধর্মান্তরের উত্তর পেতে হলে ভারত উপমহাদেশে ইসলামের আগমনের আগে বাংলার জনসংখ্যার গঠন প্রকৃতি বুঝতে হবে। সমস্ত ইতিহাসবিদ প্রায় একমত যে বাংলা সমগ্রভাবে বৌদ্ধ ছিলেন এবং তারা কখনই সামগ্রিক ভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদে দীক্ষিত হয়নি। ব্রাহ্মণ্য ধারণাগুলি বাংলার জনগণের মধ্যে কখনও অনুপ্রবেশ করেনি, যদিও ব্রাহ্মণ্য শাসকরা বৌদ্ধ ধর্ম থেকে হিন্দু রূপান্তরের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। ব্রাহ্মণ্য সেন শাসকরা ব্রাহ্মণ্যবাদের একান্ত পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের নিম্নবর্ণের নিপীড়ক হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। অন্যদিকে সুফি সাধক ও ইসলাম ধর্মপ্রচারকরা বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কাছে মসিহা হিসেবে আবির্ভূত হন। পরম সত্তার বুদ্ধধর্মের যে ধারণা এবং সুফি ইসলামে আল্লাহর ধারণাগুলি বৌদ্ধদের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয় রূপে প্রতিভাত হয়েছিল। এইভাবে বৌদ্ধ জনগণ এবং তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতি যা বাংলায় ইসলাম প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল, যা মুসলিম জনগণ দ্বারা অধ্যুষিত কাশ্মীর, আফগানিস্তান এবং ভারতের অন্যান্য অংশের ইসলামিকরণের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। হিন্দুদের কিছু উচ্চ বর্ণ এবং হিন্দুদের একটি বৃহৎ সংখ্যক নিম্নবর্ণের মানুষ ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়। এখন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে মুসলমানরা বাংলা তথা ভারতে ইউরোপীয়দের আগমনের অনেক আগে থেকেই থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল মূলতও সুফি সাধক বা দরবেশদের মহান প্রচারনা ও বৌদ্ধ বাঙালীদের তাদের সাদর অভ্যর্থনা ও তাদের পারস্পরিক ভাবনার আদান প্রদানের মাধ্যমে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct