আপনজন ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয় পাওয়ায় বার্ষিক আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ ২৯’ এ ফের দুশ্চিন্তার কালো মেঘ দেখা দিয়েছে। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে সম্মেলন শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের এই পালাবদল হুট করে আট বছর আগের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। সংশয়ের কারণ, আট বছর আগে ২০১৬ সালের নভেম্বরে মরক্কোর মারাকেশে বসেছিল বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলন। সম্মেলন শুরু হয়েছিল ট্রাম্পের জয়ের খবর দিয়ে। উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। কারণ, নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প বারবার জলবায়ু পরিবর্তন ও সেই সম্পর্কিত আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তাকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, জলবায়ু আন্দোলন এক ‘ব্যয়বহুল ধাপ্পাবাজি’। যুক্তিহীন, অহেতুক এবং সেটা ‘চীনের স্বার্থে চীনাদের তৈরি’। এসব মন্তব্য ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল তার ঘোষণা। বলেছিলেন, প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে আসবে। সেই ঘোষণা মারাকেশে সমবেত আন্দোলনকর্মীদের মনে যে হতাশার সৃষ্টি করেছিল, সম্ভবত তারই পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। আগামী সোমবার থেকে সেখানে শুরু হতে চলেছে ‘কপ ২৯’। কে জানে, তিনি প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দ্বিতীয়বারের মতো দেবেন কি না। কিন্তু গত চার বছরের অর্জন যে তিনি নষ্ট করে দিতে পারেন, সেই শঙ্কা পুরো বাকু সম্মেলন জুড়েই থাকবে।
এবার নির্বাচনী প্রচার চলাকালে ট্রাম্প বারবার কড়া ভাষায় প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ‘এনার্জি’ বা শক্তি নীতির সমালোচনা করেছেন। কাজেই মনে করা হচ্ছে, জলবায়ু–সংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় অর্থ তিনি হয়তো দিতে চাইবেন না। জলবায়ু পরিবর্তনের স্বার্থে প্রণোদনা হিসেবে বাইডেন যে ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন আইন’ (আইআরএ) পাস করিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে ভর্তুকি ও কর–এ ছাড় দিয়ে সেই অর্থ জলবায়ু রক্ষায় লগ্নি করা হচ্ছে, তা প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। ‘ড্রিল বেবি ড্রিল’ যাঁর মন্ত্র, প্রচারের সময় বারাবার যিনি জীবাশ্ম জ্বালানিতে বাড়তি লগ্নির কথা শুনিয়েছেন, জলবায়ু নিয়ে যাবতীয় দুশ্চিন্তাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে আরও বেশি করে তেল ও গ্যাস উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছেন, সেই ট্রাম্প দ্বিতীয় দফার রাজত্বে উল্টো পথে হাঁটবেন, তা ভাবা বাতুলতা। ট্রাম্পকে ঘিরে এসব শঙ্কা সত্যি হলে জলবায়ু পরিবর্তনের যাবতীয় অর্জনই বিফলে যাবে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে যুক্তরাষ্ট্র। সবচেয়ে বেশি জীবাষ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশও তারা। ২০৩০ সালের মধ্যে দূষণ নির্গমন ৫০–৫২ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা (২০০৫ সালের তুলনায়) তারা নিজেরাই নির্ধারণ করেছিল। সেই লক্ষ্যমাত্রা আদতে ২০১৯ সালে সে দেশের মোট দূষণমাত্রার মাত্র ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ বিরাট কিছু একটা নয়। তবু শুধু সেই লক্ষ্যমাত্রাই শিকেয় উঠবে তা নয়। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টন নির্গমন বাড়তি করবে।
শঙ্কা সত্যি হলে তা হবে পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের বার্ষিক নির্গমনের সমতুল্য। অন্যভাবে বলা যায়, গত পাঁচ বছরে সারা পৃথিবীতে বাতাস, সৌর ও অন্যান্য দূষণমুক্ত নবায়নযোগ্য পরিচ্ছন্ন শক্তি উৎপাদনের মধ্য দিয়ে যা সাশ্রয় হয়েছে, তা দ্বিগুণ অকার্যকর হয়ে যাবে। নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে বিশ্বব্যাপী যে একাগ্রতা এসেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেসব উদ্যোগও। ধাক্কা খাবে ২০২৪ সালের মধ্যে ওই ক্ষেত্রে দুই ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রাও।বিশ্বব্যাপী সবারই প্রথম নজর সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে। কারণ, তা কম খরচে করা যায়। ট্রাম্প আরো বেশি গ্যাস ও তেল উৎপাদনে কূপ খননের নির্দেশ দিলে অন্যত্র তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে বাধ্য।দূষণ নিয়ন্ত্রণে বৈদ্যুতিক গাড়ির চল পাঁচ বছর ধরে সারা পৃথিবীতেই বেড়ে চলেছে। ২০২৩ সালে বিশ্বে যত গাড়ি বিক্রি হয়েছে, তার ১৮ শতাংশ বৈদ্যুতিক। গত এক বছরে এই বিক্রি ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে সবাইকে টেক্কা দিয়েছে চীন। এটা ট্রাম্পের সহ্যের অতীত। কারণ, চীনের উৎপাদন খরচ সবার চেয়ে কম।নির্বাচনী প্রচারে বারবার ট্রাম্প চীনের মোকাবিলার কথা শুনিয়ে এসেছেন। আমেরিকানদের আরো বেশি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে যিনি ভোটে জিতলেন, আরও বেশি করে গ্যাস ও তেলকূপ খনন না করলে বেশি কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত তার পক্ষে করা কঠিন।ধারণা করা হচ্ছে, সেই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যপূর্ণ গাড়ি উৎপাদনের দিকেও তিনি মনোযোগী হবেন। এতে চাকরির প্রতিশ্রুতি হয়তো তিনি রক্ষা করবেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে জলবায়ু ও পরিবেশের দফারফা অনিবার্য।পরিবেশ আন্দোলনকর্মীদের হতাশা বাড়িয়ে বাকুতে ‘কপ ২৯’–এর আসরে হয়তো নতুন করে ট্রাম্পের ছায়া দীর্ঘায়িত হতে চলেছে। তেমন হলে নিশ্চিতই ‘সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়।’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct