সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়: কাগজে-কলমে “আইন ও বিচার সবার জন্য সমান “কিন্তু বাস্তবে কি সেটা হয়? অনেকে বলেন ,“যার অর্থ আছে বিচার তার জন্য.যার অর্থ নেই বিচার তার বিরুদ্ধে”। আইন তথা বিচারব্যবস্থায় সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আস্থা রেখেই বলি,কথাটা অবশ্যই সত্য কিন্তু শুধু অর্থ নয়,লোকবল যার নেই বিচার তার বেলায়ও বিরূপ এমনকি অপরাধ যার বিরুদ্ধে হয়েছে শাস্তিও তাকেই পেতে হয়। নীচের ঘটনাটা তার প্রমাণ।
বাংলার সমাজের সঙ্গে সমগ্র দেশের একটা বিশাল ফারাক আছে।এখানকার একটা অত্যন্ত জঘন্য প্রবণতা যে,একদম কোনও লাভ ছাড়া শুধুমাত্র আনন্দ পাবার জন্য অনেকে মিলে কোনও একজন কমজোরকে কষ্ট দেয়। বিচার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে। কোনও এক রাস্তা দিয়ে ৩০-৩৫ বছরের তিনজন যুবক প্রায়ই তিনটে আলাদা বাইকে চড়ে পিছন পিছন যেত। সেদিন এক জায়গায় বসে তারা গল্প করছিল। ওদের একজন বলল, “ একদিন চলন্ত বাইক থেকে পিকুকে এক লাথি মেরে ড্রেনে ফেলে দিবি”? বাকিরা তাতে সায় দিল।এই ধরণের কাজে মানুষ দুর্বলকেই টার্গেট করে। ১৯ বছরের “পিকু হাজরা” বাস্তবেই ছিল খুব দুর্বল। ওর বাবা-মা ছিলনা। ওকে একা পেয়ে কাকা-কাকিমা এবং তাদের ছেলেরা ওর সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করত। অতিষ্ট হয়ে, সে নিজের বাড়ি থেকে চলে এসে এখানে মামার বাড়িতে থাকত। একটা কাজও সে করত। নিজের উপার্জন থেকে কিছু টাকাও সে মামাকে দিত। তা’ স্বত্বেও মামা-মামি তাকে বোঝা মনে করত।
পরিকল্পনামাফিক একদিন চলন্ত বাইক থেকে প্রথম আরোহী “লিটন ঘোষ” পিকুকে সজোরে এক লাথি মেরে পাশের ড্রেনে ফেলে দিয়ে একটা বিজয়ীর হাসি হাসতে হাসতে পালাল।পিছনের বাইক আরহীরাও হো-হো করে হেসে চলে গেল।কয়েকজন ছুটে এসে ওকে ড্রেন থেকে তুলে জল দিয়ে ধুয়ে দিল। ওর মুখে এমনকি চোখেও ড্রেনের নোংরা জল ঢুকে গিয়েছিল।জামা-প্যান্ট ড্রেনের জলে ভিজে দুর্গন্ধ ছাড়ছিল। চোট তার ভালোই লেগেছিল। কয়েক জায়গায় কেটে রক্ত বেরোচ্ছিল।পরিষ্কার হয়ে পোশাক পাল্টাবার পর মামা তাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে গেল। ডাক্তারবাবু পিকুকে টিটেনাস ইঞ্জেকশন দিলেন সেইসঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক আর পেইন কিলার লিখে দিলেন। তবে থানা পুলিশের ভয়ে কেসটা তাঁর ইনজুরি রেজিস্টারে লিখলেন না। মামাও ডাক্তারবাবুকে এ’জন্য চাপ দিল না।
এলাকার একজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ পিকুর মামাকে বললেন,“পুলিশে ডায়রি করুন নয়ত ভবিষ্যতে অসুবিধা হতে পারে”। কিন্তু মামা ওসব ঝামেলা করতে চাইল না। পরদিন থেকে পিকুর শরীরের নানা জায়গায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল। ডাক্তার পিকুকে অন্তত ৮-১০ দিন বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন। কিন্তু সামান্য ৩-৪ দিন বিশ্রামের পরই মামা-মামির চাপে তাকে কাজে জয়েন করতে হল।
আস্তে আস্তে সুস্থ হলেও একটা মানসিক যন্ত্রণা আর প্রতিশোধ-স্পৃহা পিকুকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। সেদিন পায়ে হেঁটে লিটন কোথাও যাচ্ছিল। দেখতে পেয়ে পিকু ওই দিকে ছুটে এসে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা একটা তিন ফুট মত লম্বা কাটা গাছের ডাল লিটনের কাঁধে সজোরে চালাল। ভাগ্য ভালো যে, আঘাতটা মাথায় লাগেনি। লিটন চিৎকার করে উঠল। ৩-৪ জন তেড়ে এসে পিকুকে ধরে ফেলল। তাকে যে যেভাবে পারল কিল, চড় ও ঘুষি মারল। ততক্ষণে লিটনের বন্ধুরাও চলে এল।ওরাও পিকুকে মারতে লাগল। ওরা কেউ ভাবল না যে,কিছুদিন আগে পিকুকেও অন্যায়ভাবে এর চেয়ে মারাত্মকভাবে ঘায়েল করা হয়েছিল। পিকুকে আটকে রেখে পুলিশে খবর দেওয়া হল। বন্ধুরা লিটনকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। প্রথমে রাজি না হলেও লিটনের বন্ধুদের চাপে ডাক্তারবাবু এই কেসটা পিকুর নাম দিয়ে তাঁর ইনজুরি রেজিস্টারে নথিভুক্ত করলেন। এরপর বন্ধুরা লিটনকে একটা সরকারি হাসপাতালেও দেখিয়ে পিকুর নাম উল্লেখ করে আঘাতটা এন্ট্রি করালো।পিকুর বন্ধুরা জানত যে, এইভাবে একজনের বিরুদ্ধে কেস জোরদার হয়। এখান থেকে এটাই স্পষ্ট যে,লোকবল থাকলে ফৌজদারি মামলা তথা বিচার অনুকূলে নেওয়া যায় এবং প্রতিপক্ষের বিপক্ষে জোরালো কেস করা যায়।
পুলিশ এসে পিকুকে ধরে নিয়ে গেল। কয়েকজন থানায় গিয়ে পিকুর নামে ডায়রি করল। পুলিশ পিকুকে থানার লক-আপে বন্দি রেখে পরদিন কোর্টে চালান করল। আঘাতে রক্তপাত হয়নি।সেই অনুযায়ী ভারতীয় দণ্ডবিধির নির্দিষ্ট ধারায় পিকুর বিরুদ্ধে মামলা রুজু হল।ধারাটি জামিনযোগ্য হলেও মামা বা অন্য কেউ পিকুর জামিনের জন্য এগিয়ে এলো না। ফলে, বিচারাধীন বন্দি হিসাবে তাকে জেলে আটকে রাখা হল। এখানেও বোঝা যায় যে,লোকবলের অভাবে বিচারক্ষেত্রে একজন কত কোনঠাসা। এইরকম পিকুর মত আরও অনেক অভাগা বিচারাধীন বন্দি হিসাবে জেলে আটক রয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এন.সি.আর.বি.)-র সর্বশেষ ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুয়ায়ী দেশে মোট বন্দির প্রায় ৭৬ % বিচারাধীন।কিন্তু এই নিয়ে ক’জন ভাবেন ?
গভীরভাবে বিচার করলে পিকু অপরাধীই নয় বরং জঘন্য অপরাধ তার বিরুদ্ধেই হয়েছে। কিন্তু আইন তো তা’ বলবে না।এখানে পিকুর করা আঘাতের বিরুদ্ধে ডায়রি হয়েছে ,আদালতে এটাই বিচার্য ,পিকুর ওপর হওয়া অপরাধ বিচার্য নয়,কারণ ওটার তখন ডায়রি হয়নি। পিকুর লোকবল নেই ,তাই তার হয়ে কেউ ডায়রি করেনি। পিকু বিনা কারণে লিটনকে মারেনি,তাকে মারার প্রতিশোধ হিসাবে সে মেরেছে। আইনের ভাষায় একে বলে প্ররোচনা (প্রোভোকেশন)। এতে কেস লঘু হয়। কিন্তু কে করবে তার প্রমাণ ?
ভারতীয় দণ্ডবিধির যে ধারায় মামলা রুজু হয়েছিল,তাতে শাস্তি হতে পারে এক বছরের জেল। কিন্তু পিকুর হয়ে তদ্বির করার এবং তার পক্ষে লড়বার জন্য ভালো উকিল দেবার কেউ ছিলনা। বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে ,এইসব ক্ষেত্রে মামলার ফয়সালা হতে দীর্ঘদিন লেগে যায়। বিচার জগতে এইরকম দৃষ্টান্ত অজস্র। দেখা যায়,ততদিনে বিচারাধীন বন্দি হিসাবেই তার কয়েক বছর জেলে কেটে গিয়েছে।হয়ত পিকুর ক্ষেত্রেও সেটাই হবে।তাছাড়া মানুষের কাছেও পিকু যথেষ্ট মার খেয়েছে।সেটাও তার একটা শাস্তি। মনুষ্য সমাজে আসল অভাগা পিকুর মত ছেলেরা। অনেক আন্দোলন দেশে হয় কিন্তু পিকুদের জন্য ক’জন ভাবেন ? কারাগারের আধুনিক এবং অলংকারিক নাম সংশোধনাগার। প্রশ্ন জাগে, আসল সংশোধনগুলো দরকার কোথায় ?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct