ড. মুহাম্মদ ইসমাইল, আপনজন: বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ভাষা ইংরেজি হলেও মাত্র ১৮ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ কথাবার্তা বলে। এই ভাষা পৃথিবীজুড়ে রাজ করছে সর্ব দেশে। তবে চাইনিজ, ফ্রেঞ্চ, হিন্দি থেকে বাংলা ভাষা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ভাষা হিসেবে তালিকাভুক্ত। ভাষা নিজেদের ভাব বিনিময় ও আদান-প্রদানের মাধ্যম। যার মধ্য দিয়ে আমরা লিখিত ভাবে ও অঙ্গভঙ্গি করে ভাবের আদান প্রদান করে থাকি। তবে গত কয়েক দশক ধরে, পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা ভাষা বিশ্বের জনপ্রিয় ভাষা হলেও নানা কারণে অবহেলিত। তার ফলে নিজস্ব ভাষাভাষী নিজেদের ভাষার গুরুত্ব লোপ পাচ্ছে এবং ইংরেজি প্রধান ভাষা হয়ে উঠেছে। যদিও আমাদের দেশের বহু সাহিত্যিক, কবি,লেখক থেকে শুরু করে শিক্ষক,অধ্যাপক,নেতা-নেত্রী,প্রধানমন্ত্রী,মুখ্যমন্ত্রী ইংরেজি জানতো না। তা নিয়ে কোনোদিন কানাঘুষা শোনা যায়নি। তবে গত দুই দশক সময়কাল থেকে আমাদের দেশের সব কিছুতেই মাপকাঠি যেন ইংরেজি আর ইংরেজি। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত হোক ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেই জনসাধারণের চোখে হিরো। অথচ সরকারি তরফে মাতৃভাষার প্রসার ও উন্নয়নে উৎসাহিত করা হচ্ছে নানাভাবে সরকারি সহযোগিতা প্রদান করে। মাতৃভাষায় গবেষণা ও উন্নয়নে ভাষা ও সাহিত্য এক্যাডেমি খোলা হয়েছে। তারপরও একজন মানুষ ইংরেজিতে কথা বলতে না পারা ও লিখতে না পারা কে দুর্বলতা বলে উপহাস করা হচ্ছে। হঠাৎ করে আমাদের দেশেও সংস্কৃতির এতটা অবনমন হল যে সব কিছুতেই আমরা ইংরেজি ও ইংরেজদের অভ্যাস, আচার, ব্যবহার রপ্ত করতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছি। তার কারণ হিসাবে অবশ্যই ভারতীয় অর্থনৈতিক মন্দা ও উন্নত জীবন যাত্রার জন্য লালসাকে দায় করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল, কত শতাংশ ভারতীয় পড়াশুনা ও শিক্ষা লাভ করে ইংরেজির ওপর ভর করে নানা দেশে ও জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। তারজন্য সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে ইংরেজি গ্রহণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছি। শুধু তাই নয়,ছাত্র, যুবক,বৃদ্ধ,আবাল বৃদ্ধ বণিতা থেকে সকলের সুরে একটাই স্লোগান ইংরেজি জানা অত্যন্ত অপরিহার্য। একটা জাতি কতটা অন্ত শূন্য হলে এমন ধারণা বসবতি হয়, যদিও আমরা কোন ভাবে ইতিহাসে খুঁজে পাচ্ছি না, আমাদের ৯০শতাংশের বেশি মানুষজন কোন কালেই ইংরেজি প্রধান দেশের উপর নির্ভর করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতেন না।বর্তমানেও সামান্য মানুষ ইংরেজি ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চলে বসবাস করেন। তবে কেন আমরা নিজেদের ভাষা,সংস্কৃতি, আচার ও ব্যবহারকে পরিবর্তন করে বিদেশিদের সাথে অভিযোজন ঘটানোর চেষ্টা করছি। তার উত্তরে বহু লোক বলবেন ইংরেজি জানলে ভবিষ্যৎ গড়ার ও কাজের সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু তার আড়ালে যে আমরা নিজেদের উন্নয়নের ব্যর্থতা প্রকাশ করছি তা পরিষ্কারভাবে বলা যায়। ভারতের জল, আবহাওয়ায় বড় হয়ে দেশের উন্নয়নে নিয়োজিত না হতে, বিদেশি টাকা অর্জনের জন্য দেশের ভবিষ্যৎ ও প্রজন্মের সম্ভাবনাময় জীবনে সংকট ডেকে আনছি তা বলা বাহুল্য। শুধু তাই নয়, দেশের মধ্যে বহু মানুষ আজ হীনমন্যতায় ভুগছেন কারণ ভালো বাংলা ও তার দেশীয় মাতৃভাষা জানার জন্য । কারণ সে ইংরেজিতে স্বাবলম্বী নয়। ভারতবর্ষ বহু ভাষাভাষীর দেশ, পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল ভাষার মধ্যে হিন্দি, বাংলা তামিল,পাঞ্জাবি,গুজরাটি ও তেলুগু ভাষা। ভারতে ইংরেজি মাতৃভাষার সংখ্যা নগণ্য। অথচ ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীণ কাজকর্মে বহুল জনপ্রিয় ভাষা ইংরেজি। প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হয় ইংরেজি মাধ্যমে। পড়ানো হয় ইংরেজি সমস্ত ক্লাসে গুরুত্ব সহকারে অথচ নিজেদের দেশের ভাষা এবং মাতৃভাষা অবহেলিত। বহু রাজ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের মাতৃভাষায় পড়াশোনা করার সুযোগ নেই। আর দৈনিক ও নিত্য কাজের জন্য আবেদন পত্র থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় ইংরেজিতে। অথচ দেশের ৮০শতাংশ মানুষ ইংরেজি ভালো করে জানে না। শুধু তাই নয়, নানা সরকারি,বেসরকারি অফিসে শিক্ষিত মানুষেরাও ভালো করে ইংরেজি জানে না। তারপরও অফিস থেকে শুরু করে সরকারি ও বেসরকারি কার্যকলাপ সম্পাদন হয় ইংরেজিতে। বহু শিক্ষক, পণ্ডিত, লেখক, কবি, রাজ নেতা থেকে শুরু করে বহু মানুষকে অসুবিধায় পড়তে হয় ইংরেজি না জানার কারণে। অথচ সমস্যাটা তাদের নয়, দেশ তাদের, ভাষা,তাদের, আর নিজস্ব ভাষাই তারা শিক্ষিত, পণ্ডিত ও দিকপাল। কিন্তু ইংরেজি না জানার কারণেই উপহাসের শিকার তারা এবং যোগ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত। তাই স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উদয় হয়, কেন নিজস্ব মাতৃভাষাকে অবহেলা করে ইংরেজিকে গুরুত্ব দিতে বলা হলো। একদিন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে উপস্থিত হয়ে দেখলাম বক্তা থেকে শ্রোতা সকলেই বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ অথচ বক্তা বক্তৃতা করছেন ইংরেজিতে। তারপরে অধিকাংশ শ্রোতা ঠিকঠাক বুঝতে পারছিলেন না। কিন্তু পরবর্তী বক্তা বাংলায় ভাষণ শুরু করতে শ্রোতা মন্ডলী সজাগ হয়ে উঠলেন ও সকলের চোখে মুখে হাসি ফুটল। পূর্বের বক্তার নিকট কোন প্রশ্ন ছিল না শ্রোতাদের থেকে ইংরেজি না জানার কারণে অথচ বাংলা ভাষায় ভাষণ প্রদানকারী বক্তার সাথে দেখলাম অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠলো বক্তৃতা চলার মধ্য দিয়ে। স্কুলের শিক্ষক ইংরেজি জানে না, কলেজে অধ্যাপক ইংরেজি জানে না, বিডিও ভালো ইংরেজি জানেনা এমন কথা শোনা যায় নানা মহলে কিন্তু প্রশ্ন হল বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল, সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, অঙ্কের শিক্ষক কেন ইংরেজি জানবে। দেশীয় ভাষায় শিক্ষা প্রদান করলে ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক থেকে শুরু করে সকলেই উপকৃত হবেন ও বেশি বেশি বুঝতে পারবেন। তাহলে অযথা কেন গুটিকয়েক মানুষের জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্য দেশের জনগণের উপর জোর করে ইংরেজি চাপানো হবে। আসলে ইংরেজি জানা মানুষেরা বরাবর ইংরেজ ও বিদেশি শাসকদের তল্পি বাহক ছিলেন ও আজও তারা তাদের চাকর বাকর এবং তল্পি বাহক হিসেবে কাজ করে নানা দেশে। তারাই চাই বিদেশি সংস্কৃতির আদলে তৈরি হোক দেশের সবকিছু ও দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পরম্পরা ধ্বংস হোক।১৪০ কোটি জনসংখ্যা বিশিষ্ট দেশে আমরা নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক না হয়ে অন্যদের থেকে আমদানি করছি ভাষা ও সংস্কৃতি। অত্যন্ত দুর্ভাগ্য, ভারত আজ বিশ্ব দরবারে অবহেলিত, না আছে ভাষা, না আছে সংস্কৃতি, না আছে নিজস্বতা, শুধু বিদেশিদের ও চাটুকারিতা রয়েছে। চীন ও রাশিয়া নিজেদের মত করে নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আর আমরা সমস্ত কাজে ইংরেজিকে বকলমে জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছি সর্বক্ষেত্রে। ব্লক,ভূমিদপ্তর,মৎস্য দপ্তর থেকে দপ্তর ও অশিক্ষিত এবং মূর্খ কৃষকদের নানা সুযোগ-সুবিধা পেতে ইংরেজিতে বিজ্ঞাপন জারি করছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্য, ভারতীয় প্রশাসন ও তার অধীন সমস্ত কার্যালয় সুবিধাভোগীদের দিকে লক্ষ না রেখে শাসন ব্যবস্থা চালাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, এই সমস্ত প্রশাসনিক কার্যকলাপের ফলে শিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত বহু মানুষকে নির্ভর করতে হচ্ছে ইংরেজি জানা গুটি কয়েক মানুষের উপর।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct