ভোট শেষ। স্ট্রং রুম পাহারা দেওয়ার জন্য ৭৮ কোম্পানি রেখে ফিরে যেতে শুরু করেছে বাকি কেন্দ্রীয় বাহিনী। রাজ্য জুড়ে এখন প্রশ্ন, ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসে কি লাগাম পরানো যাবে? নাকি এখন থেকেই যেমন ইঙ্গিত মিলছে, তার ধারা বজায় রেখে ১৯ মে ফলপ্রকাশের পরে ঢাকে আরও বেশি চড়াম চড়াম পড়বে?
বাংলায় নির্বাচন ঘিরে সন্ত্রাসের ঐতিহ্য বহু দিনের। তবে অতীতে রাজনৈতিক দলগুলিই সেই সন্ত্রাসে এক সময় রাশ টেনে ধরত। শাসক দলের নেতারাও চেষ্টা করতেন, তাঁদের কর্মী বাহিনীর উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে। আর এ বারের বিধানসভা ভোটে রাজনৈতিক সমীকরণের অন্যতম প্রধান বিষয়ই সন্ত্রাস। মারের হাত থেকে বাঁচতে এক সময়ের যুযুধান বাম ও কংগ্রেস এ বার হাত মিলিয়ে লড়েছে। কিন্তু ভোট শেষের আগেই এ বার কলকাতা-সহ জেলায় জেলায় যে ভাবে হিংসা শুরু হয়েছে, তাতে প্রশ্ন উঠেছে— সন্ত্রাস থামাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা কি দেখা যাবে আদৌ?
বিরোধী বাম ও কংগ্রেসের জোট অবশ্য চাইছে, হিংসার এই পরম্পরা বন্ধ হোক। মানুষ নিজের ভোট নিজে দেওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে তৃণমূল হামলা চালাচ্ছে, এই অভিযোগ আনছে তারা। সঙ্গে হিংসা থামানোর বার্তাও দিচ্ছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র যে কারণে বলেছেন, ‘‘মানুষকে বলছি, কোনও ভাবেই প্ররোচনায় পা দেবেন না। ধৈর্য ধরুন, এলাকায় শান্তি বজায় রাখুন।’’ তাঁর আরও বার্তা, ‘‘তবে এ সবের পরেও হিংসা চললে মানুষকে সমবেত করে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে হবে।’’
হিংসা থামানোর কথা বলছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘অন্য রাজ্যে কোথাও এমন সন্ত্রাস হয় না। বাংলায় রাজনীতির হিংসার শুরু হয়েছিল বাম আমলে। এখন সব নিয়ন্ত্রণহীন।’’ জোট ক্ষমতায় আসবে দাবি করে হুঁশিয়ারির সুরেই অধীর বলেন, ‘‘কোনও ভাবেই সন্ত্রাস বরদাস্ত করা হবে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’’
বিরোধীরা শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বললেও ভোটের প্রচারে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলে গিয়েছেন, ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে তিনি সবাইকে বুঝে নেবেন! বিরোধী থেকে পুলিশ পর্যন্ত, ক্ষমতায় ফিরে সকলের হিসেব বুঝে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন! এ বার সরকারে ফিরলে পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজবে না বলেও জানিয়ে রেখেছেন তৃণমূল নেতারা। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী হিংসা থামানোর কোনও বার্তা তো দেনইনি। বরং, বলে রেখেছেন এখন কিছু ঘটলে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব বর্তাবে নির্বাচন কমিশনের উপরে! তবে এর মধ্যেই শাসক দলের অন্দরে কিছুটা ভিন্ন সুর ধরা পড়েছে মুকুল রায়ের কথায়! তৃণমূলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুলবাবু শুক্রবার বলেছেন, ‘‘ভোট শেষ। শাসক দলকে অনেক বেশি সহনশীল হতে হবে। শান্তি বজায় রাখা মূলত শাসক দলের দায়িত্ব। তবে বিরোধীদেরও বুঝতে হবে, বাস্তবতার উপরে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করতে হয়। এখন আর ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নিলে চলবে না!’’ কিন্তু ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেওয়ার কথা তো মুখ্যমন্ত্রীই বলেছেন! জবাবে মুকুলবাবুর দাবি, ‘‘ওটা সূর্যবাবুও বলেছেন!’’ আবার পিজি হাসপাতালে মুকুলবাবুর সম্পূর্ণ উল্টো সুরে মদন মিত্র দাবি করেছেন, ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী তাণ্ডব চালিয়েছে বলেই মানুষের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে!
এখন প্রশ্ন, ভোট-পর্বে বাহিনীর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করা পুলিশ কি পারবে ভোট-পরবর্তী হিংসা সামাল দিতে? এখনও কমিশনের অধীনে থাকলেও কলকাতার বাঘা যতীন-সহ নানা প্রান্তে যা ঘটেছে, তাতে পুলিশের ভূমিকায় আস্থা রাখার মতো কিছু দেখা যাচ্ছে না! রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দিয়েছেন, কোথাও গোলমাল হলেই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজ্য পুলিশের এডি়জি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মারও দাবি, ‘‘পুলিশ হিংসা বরদাস্ত করবে না।’’ নাটাবাড়ি ও খেজুরিতে দু’টি গুলিচালনার অভিযোগ ছাড়া এ দিন অবশ্য তেমন গোলমালের অভিযোগ ওঠেনি।