পশ্চিমবাংলায় অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ ১৯৯৪ সালে শতকরা ৫ ভাগ থেকে শুরু হয়ে ১৯৯৯ সালে বেড়ে হয় শতকরা সাত ভাগ। বঞ্চিত শ্রেণিগুলির প্রবল ক্ষোভের মুখে সংরক্ষিত পদের সংখ্যা শতকরা সতেরো হয় ২০১০ সালে কিন্তু সাতাশ ভাগ সংরক্ষণের দাবি অপূর্ণ থেকেই যায়। এমতাবস্থায় হাইকোর্টের এই আদেশ তাদের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের সমতুল। এ নিয়ে লিখেছেন কাজী মোহাম্মাদ শেরিফ।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণির তালিকাভুক্ত মোট ১৮০ টি শ্রেণি/গোষ্ঠীর মধ্যে ১১৪ টি শ্রেণি/গোষ্ঠীর নাম মহামান্য কোলকাতা হাইকোর্টের এক আদেশবলে লুপ্ত হয়েছে অতি সম্প্রতি। একই সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা শতকরা ১৭ থেকে এক ধাক্কায় কমিয়ে শতকরা সাতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবাংলায় অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ এবং সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী তাদের জন্য সংরক্ষণ অন্তত শতকরা ২৭ ভাগ হওয়া উচিত। কিন্তু অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ ১৯৯৪ সালে শতকরা ৫ ভাগ থেকে শুরু হয়ে ১৯৯৯ সালে বেড়ে হয় শতকরা সাত ভাগ। বঞ্চিত শ্রেণি গুলির প্রবল ক্ষোভের মুখে সংরক্ষিত পদের সংখ্যা শতকরা সতেরো হয় ২০১০ সালে কিন্তু সাতাশ ভাগ সংরক্ষণের দাবি অপূর্ণ থেকেই যায়। এমতাবস্থায় হাইকোর্টের এই আদেশ তাদের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের সমতুল।
দেশের সংবিধানের মূল চারটি লক্ষ্যের অন্যতম হচ্ছে ন্যায় (জাস্টিস)। সংবিধানের ব্যাখ্যায় এই ন্যায় ত্রিমাত্রিক - সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক । সংবিধানের মুখবন্ধে সে কথা গুরুত্ব সহকারে বলা আছে।
ভারতের সংবিধান দেশের ন্যায়াধিকার বা বিচার ব্যবস্থা্র উপর সংবিধান- রক্ষকের দায়িত্বাভার ন্যস্ত করেছে। সংবিধানের রক্ষকের ভূমিকা যার উপর ন্যস্ত তার পক্ষে সাংবিধানিক লক্ষ্যের বিপরীত পথে হাঁটতে শুরু করে সামাজিক ন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করা এক বিপজ্জনক অধ্যায়ের সূচনা বলে সাধারণ মানুষ চিন্তিত ।
ভারতের সংবিধানে সামাজিক ন্যায়ের নির্দেশনা এমন সুদ্রৃড় ভাবে প্রোথিত যে তা উপেক্ষা করার কোন অবকাশ নেই। কিন্তু ভারতে অপর অনগ্ৰসর শ্রেণির মানুষদের সামাজিক ন্যায় পাওয়ার জন্য দশকের পর দশক নিরন্তর সংগ্ৰাম করতে হয়েছে। সাতচল্লিশে স্বাধীন হওয়া দেশ পঞ্চাশেই সংবিধান রচনা সম্পন্ন করে, এবং সাংবিধানিক নির্দেশনা মান্য করে ভারতের সংবিধানের ৩৪০ অনুচ্ছেদ অনুসারে, ২৯ শে জানুয়ারী ১৯৫৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে প্রথম অনগ্রসর শ্রেণি কমিশন গঠিত হয়েছিল। এটি প্রথম অনগ্রসর শ্রেণি কমিশন, বা কাকা কার্লেকর কমিশন নামেও পরিচিত। সংবিধানে কমিশনের প্রতি নির্দেশ ছিল শিক্ষা এবং সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া নাগরিকদের অবস্থা অনুসন্ধান এবং অনুধাবন করে তাদের অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি হিসাবে চিহ্নিত করা এবং তাদের অবস্থার উন্নয়নে রাষ্ট্রের করণীয় এবং কর্তব্য সুপারিশ করা। কাজটি অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন এবিষয়ে সন্দেহ নেই । এব্যাপারে গ্ৰহনীয় পদ্ধতি সম্পর্কে বা পিছিয়ে পড়া শ্রেণি চিহ্নিত করণের পদ্ধতি বা মাপকাঠি সম্পর্কে সংবিধানে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। তৎসত্ত্বেও কাকা কালেলকর কমিশন ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করে রিপোর্ট পেশ করে ৩০শ মার্চ ১৯৫৫ । সংসদে সেই রিপোর্ট পেশ হওয়ার পর অনগ্ৰসর শ্রেণি চিহ্নিত করণের পদ্ধতি এবং সুপারিশ নিয়ে নানা বিতর্কের সূচনা করা হয় এবং অহেতুক বিতর্কের সুচনা করে সমগ্ৰ প্রক্রিয়া জটিলতর করে দেয়া হয়। সকল অনাকাঙ্ক্ষিত বাধা অতিক্রম করে সংবিধান প্রতিশ্রুত সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘ সংগ্ৰাম করতে হয় অনগ্ৰসর শ্রেণির মানুষদের। সেই সংগ্ৰাম কোন কোন সমেয়ে রক্তাক্ত রুপও নিয়ে ছিল। বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল বহু মানুষকে, দীর্ঘ কাল কারা বন্দি থাকতে হয়েছিল একাধিক আন্দোলন কারীদের। বহু সরকারের উত্থান -পতন ঘটায় সেই সুদীর্ঘ আন্দোলন। অবশেষে, সুদীর্ঘ সংগ্ৰামের পর, ১৯৯০ সালের সাত ই আগষ্ট তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে ঘোষণা করেন দ্বিতীয় অনগ্ৰসর শ্রেণি কমিশন বা মন্ডল কমিশনের সুপারিশ মেনে কেন্দ্রীয় সরকারের বা তার অধীনস্থ সকল বিভাগের নিয়োগের ক্ষেত্রে শতকরা সাতাশ ভাগ পদ সংরক্ষিত রাখবে অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণির প্রার্থী দের জন্য। এই সংরক্ষণ সম্পর্কিত সরকারি আদেশ নামা প্রকাশিত হয় তের ই আগষ্ট, ১৯৯০।
কিন্তু ঘটনার সেখানেই ইতি ঘটেনি। সেই সরকারি আদেশনামার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ সংগঠিত করে সামাজিক ন্যায় এর বিরুদ্ধ পন্থীরা। বিরোধীতা শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় সুপ্রিম কোর্টে।
সামাজিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাকল্পে সুপ্রিম কোর্টের নয়-বিচারক বিশিষ্ট এক সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৯৯২ সালের ষোলই নভেম্বর মন্ডল কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সংরক্ষণ সম্পর্কিত ১৯৯০ সালের আদেশনামায় সিলমোহর লাগিয়ে এক যুগান্তকারী রায় দেন যা ইন্দ্র সাহনি মামলার রায় নামে সারা দেশে এখন সুপরিচিত।
সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়ে রাজ্য সরকার গুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল প্রতিটি রাজ্যের সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণির মানুষদের জন্য পদ সংরক্ষণের জন্য রাজ্য স্তরের কমিশন অথবা ট্রাইব্যুনাল গঠন করার জন্য।
তদনান্তিন পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুপ্রিম কোর্টের সেই আদেশ অনুসারে, ১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে অনগ্ৰসর শ্রেণির জন্য কমিশন গঠন সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করেন । ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে সংরক্ষণ সম্পর্কিত প্রথম আদেশ নামা প্রকাশিত হয়, শতকরা পাঁচ ভাগ পদ অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত রাখার নির্দেশ সমেত। বলাবাহুল্য অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণের প্রক্রিয়া চলতে থাকে শম্বুক গতিতে।
২০১০ সালের শুরুতে দেখা যায় তখন পর্যন্ত্য মাত্র ৬৬ টি শ্রেণি/গোষ্ঠী কে চিহ্নিত করণ সম্ভব হয়েছে এবং তাদের জন্য মাত্র শতকরা সাত ভাগ আসন সংরক্ষিত হয়েছে। এই ছেষট্টি টি শ্রেণি/গোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিম ধর্মাবলম্বী দের সংখ্যা ছিল মাত্র এগারো/বারোটি। অবশ্য অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণি রুপে তালিকাভুক্তির জন্য একশো বিয়াল্লিশ টি শ্রেনী / গোষ্ঠীর আবেদন পত্র তখনো কমিশনের কাছে পড়ে আছে ।
অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ দের সংবিধান প্রদত্ত সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসার প্রশ্নে সরকারের এই শম্বুক গতিতে কাজের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করলে সরকার বাধ্য হয় দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে। ১৯০৯-১০ সালে যেখানে কমিশন ্মাত্র সাতটি আবেদন কারির শুনানি করতে পেরেছিল, ২০১০-১১ সালে কমিশন শুনানি করে পয়ষট্টি টি আবেদনের এবং সেই বছরেই সংরক্ষণের তালিকায় আরও বিয়াল্লিশ টি নাম সংযোজিত হয়। একই সঙ্গে সংরক্ষণের শতকরা ভাগ আরও দশ ভাগ বাড়ান হয় । ফলে পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের জন্য সংরক্ষণ শতকরা সতেরো হয়। দীর্ঘ কাল থেকে অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকা মুসলিম ধর্মাবলম্বী দের আবেদন গুলি এই সময় থেকেই কমিশন তৎপরতার সঙ্গে বিচার করতে শুরু করে এবং বলাই বাহুল্য বঞ্চিত শ্রেণি গুলি তালিকাভুক্ত হতে থাকে।
২০১২ সালের এর মধ্যেই সংরক্ষণের আওতায় আসে মোট ১৮০ টি শ্রেণি/ গোষ্ঠী এবং একটি নতুন আইন প্রনয়ণ করে ব্যবস্থাটির আইনি ভিত সুদ্রৃড় করা হয়।
বলাবাহুল্য ২০১০ সাল থেকে যে শ্রেণি/গোষ্ঠী গুলি নথিভুক্ত হয় তাদের মধ্যে অল্প কয়েকটি বাদ দিয়ে বাকি সবকটিই মূসলিম ধর্মাবলম্বীদের। এই রাজ্যে অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণির মানুষের মধ্যে মুসলিমেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সাচার কমিটির রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় তাদের শিক্ষা এবং জন উন্নয়নমূলক প্রায় সব সরকারি প্রয়াসের থেকে দীর্ঘকাল যাবত বঞ্চিত রাখার কারণে তারা সর্বাধিক পশ্চাৎপদ সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীকালে রঙ্গরাজন কমিটির রিপোর্টএ অবস্থার আরও অবনতির চিত্র ফুটে উঠেছিল। পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ চালু হওয়ার প্রথম প্রায় পনের বছরে বিনা কারণে অনগ্ৰসর শ্রেণির প্রাপ্য সংরক্ষণ থেকে মুসলিম পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় গুলিকে বঞ্চিত রাখার ফল যে তাদের পক্ষে বিষময় হয়েছিল এই কথা এখন কেউই অস্বীকার করেন না। বহুদিন ধরে বঞ্চনার শিকার হওয়া মুসলিম অনগ্ৰসর শ্রেণি গুলিকে ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে দ্রুত গতিতে প্রাপ্য সংরক্ষণের আওতাভুক্ত করার ফলে বাঙালি মুসলিম সমাজের অগ্ৰগতির রুদ্ধদ্বার নিঃসন্দেহে খুলে গিয়েছিল। সংরক্ষণের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায় এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দূরদর্শী সংবিধান প্রণেতারা দেখেছিলেন তার বাস্তবায়ন যে সম্ভব এই উপলদ্ধি পিছিয়ে পড়া সকল সমাজের মানুষ অনুভব করতে আরম্ভ করে সেই সময়ে।
কিন্তু সামাজিক ন্যায় এবং সাম্য বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদ ঐ সময়ে দূর্বল হয়ে পড়লেও বিলীন হয়ে যায়নি । ২০১১ সাল থেকেই মুসলিম শ্রেণি/গোষ্ঠী গুলিকে সংরক্ষণের আওতাভুক্ত করার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা শুরু হয়। মূল দাবি ছিল ২০১০ সালের পর তালিকাভুক্ত শ্রেনিগুলিকে তালিকা থেকে বাদ দেয়ার । কারন হিসাবে বিভিন্ন বক্তব্য পেশ করা হয়েছিল যথা ঃ - কেবল মাত্র রাজনৈতিক স্বার্থে সরকার ধর্মের নিরিখে বিচার করে অনগ্রসর শ্রেনীভুক্ত করেছে। অনগ্রসরতা নির্ধারণের কোন সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন না করেই ২০১০ সালের পর থেকে তালিকাভুক্তি করা হয়েছে ইত্যাদি,ইত্যাদি।
কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই যুক্তিগ্ৰাহ্য কারণ প্রমাণ সহকারে পেশ করতে পারেনি। পেশ করা সম্ভব ছিলনা কারন তথ্য প্রমাণ সংগ্ৰহের পর নিয়ম নিষ্ঠ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্বাচিত শ্রেণি/গোষ্ঠী গুলির নাম কমিশন সুপারিশ করেছিল এবং রাজ্য সরকার একমাত্র কমিশনের সুপারিশকৃত শ্রেণি/ গোষ্ঠী গুলিকেই তালিকাভুক্ত করে। উপরন্তু তালিকাভুক্ত নাম গুলিকে ২০১২ সালে আরও একবার নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ সংস্থার দ্বারা অর্থনৈতিক/সামাজিক অবস্থার পুনর্মূল্যায়ন করা হয় তুলনামূলক আনগ্রসরতা নির্ণয়ের জন্য। এই সংক্রান্ত সকল তথ্য কমিশনের কাছে আছে। বিভিন্ন সময়ে দাখিল করা যুক্তি তথ্য প্রমাণ বিহীন পিটিশন গুলি গুরুত্বহীন বিবেচনার ফলে অবহেলিত অবস্থায় হাইকোর্টে দীর্ঘকাল পড়েছিল। সে গুলিকে হঠাৎ ই খুঁজে বের করে অতিদ্রুত শুনানি এবং রায় দান করা হয় চলতি বছরের ২২ শে মে। বস্তুত তথ্য, নথী, প্রমাণের পরীক্ষা / পর্যবেক্ষণ ব্যতিরেকে এই বিচার করা হয়েছে যা ন্যায় এবং বিচার, উভয় এর পরিপন্থী। এর ফলে অনগ্ৰসর শ্রেণির অধিকাংশ মানুষের এখন ধারনা সামাজিক ন্যায়, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী মানুষদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ফলে সার্বিক স্তরে যে অবনমন ঘটেছে তার প্রতিচ্ছায়ার কুফল আদালতের এই ন্যায় বর্জিত রায়। তাদের মতে কোর্টের এই রায় চূড়ান্ত অবিচারের নামান্তর। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কাছে এই রায় সংবিধানের মূলনীতির বিরোধী। রাজ্য সরকার এই রায় মেনে নেয়নি, প্রতিকারের জন্য সর্বোচ্চ আদালতের স্মরণাপন্ন হয়েছে। অনগ্ৰসর শ্রেণির অনেকে পৃথকভাবে সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন পেশ করেছে এই রায়কে রহিত করার জন্য। সারা বাংলায় আন্দোলন শুরু হয়েছে এই রায়ের বিরুদ্ধে।
কিন্তু আদালতের এই ন্যায় বর্জিত বিধানের ফলে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমান সমাজে। সংরক্ষণ ব্যবস্থার সুফলে ২০১০ সাল থেকে বাঙালি মুস্লিম সমাজে এক নূতন যুগের সূচনা হয়েছিল। দীর্ঘকাল থেকে পিছিয়ে থাকা বাঙালি মুসলিম সমাজের সামনে উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে দিয়েছিল সংরক্ষণ ব্যবস্থা, তার ফল স্বরূপ অল্পবিস্তর একটি শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম সমাজ তৈরি হয়েছে। তাদের অনেকের মধ্যেই এক নূতন চেতনার সঞ্চার লক্ষ্য করা যাচ্ছে এখন। এই চেতনা বাঙালি মুসলমানের সুপ্ত সত্তাকে জাগ্রত করেছে। বাঙালি মুসলমান তার দ্বিমাত্রিক সত্ত্বাকে উপলব্ধি করতে পারছে এখন। সে বুঝতে পেরেছে তার ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে মূল নিবাসী, হাজার হাজার বছর ধরে বাঙলার মাটিতে বাস করা বাঙলার আদিম অধিবাসীদের রক্ত ধারা। তার পক্ষে হ্রদয়ঙ্গম করা সম্ভব হয়েছে বাঙালির রক্ত, বাঙলা ভাষা এবং সংস্কৃতি তার চেতনার অঙ্গ, সীমান্তের এপার - ওপারে বাস করা সব বাঙালি তার আপনজন। অন্যদিকে ইসলাম তাকে দিয়েছে নৈতিকতা এবং বিশ্বাস। একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী উম্মাহর সে অবিচ্ছেদ্য অংশ, সে উম্মাহ পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাস করুক না কেন। তার নৈতিকতা তাকে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষহীন সংগ্ৰামে উদ্বুদ্ধ করেছে।
বাঙালি মুসলমান নিঃসন্দেহে বাংলার অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। অন্যান্য অনগ্ৰসর শ্রেণির বিরুদ্ধে আদালতের রায় যে অন্যায় করেছে তার বিরুদ্ধে সংগ্ৰামের নৈতিক দায় মূখ্যত তারই। এই দায় সে স্বীকার করে।
এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্ৰামের জন্য ইতিমধ্যেই গড়ে উঠতে শুরু করেছে বাঙালি অনগ্ৰসর শ্রেণি সংগঠন। ন্যায়ের দাবিতে সংগঠিত হচ্ছে বাঙলার আপামর অনগ্ৰসর শ্রেণি।
বাঙলায় আর এক নতুন যুগের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে বাঙালি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct