তন্ময় সিং, আপনজন: বিপদ আমাদের মধ্যে ছিলই, আমরা প্রতারিত হচ্ছিলাম আমরা আইনের কড়া নাড়ছিলাম। কিন্তু কখনোই সেই জায়গাটা তৈরি হচ্ছিল না যাতে সারা ভারতব্যাপী এই বিপদ সম্পর্কে একটা সচেতনতা তৈরি করা যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী তার মন কি বাত অনুষ্ঠানে এই বিপদ সম্পর্কে আলোচনা করে অন্তত সারা ভারতবাসীকে সচেতন করে দিলেন যে মোবাইলের নতুন মোবাইলে ডিজিটাল অ্যারেস্ট হওয়ার ভয় পাইয়ে যে অ্যারেস্ট না করার জন্য টাকা দাবি করা হচ্ছে তা আসলে ভুয়ো। কতগুলো উদাহরণ দিলেই আমরা বুঝতে পারব কিভাবে আমরা এই স্ক্যামের মাধ্যমে নিজেরা প্রতারিত হচ্ছি।
অনলাইনে সব জিনিস কিনে অস্মিত, মোবাইলে ট্র্যাক করা কুরিয়ার সার্ভিসকে তার বহুদিনকার অভ্যাস। হঠাৎ করে তার মোবাইলে মেসেজ আছে যে আপনার ঠিকানা আপডেট না করার জন্য আমরা ডেলিভারি করতে পারছি না। চিন্তিত হলেও অস্মিত ফোন করে কাস্টমার কেয়ারে, ফোন করার পর কাস্টমার কেয়ারে অ্যাড্রেস আপডেট করতে গিয়ে হয় বিপদ, প্রথমে অ্যাড্রেস আপডেট করার পর ও টিপি আছে ওটিপি দিয়ে দেয়ার পর হয় বিপদ। অস্মিত দেখে সামরিক পোশাকে সজ্জিত একদল লোক যাদের মাথার উপর সরকারি প্রতীক তারা ভিডিও কলে তাকে জানাচ্ছে যে আপনি ড্রাগস এর অর্ডার দেন, অনলাইন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। আমরা বহুদিন ধরে আপনার সন্ধানে আছি আমরা আপনার বাড়ি আমরা ট্র্যাক করে ফেলেছি কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পেশাল ফোর্স আপনার বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে। মাথায় হাত অস্মিতের। ফোনের কল কাটার মতন ক্ষমতা তার নেই ফোন পুরোপুরি হ্যাক করে নিয়েছে ওই সংস্থা। অস্মিত বুঝতে পারে তার মান সম্মান ইজ্জত সব এবার বরবাদ হয়ে যাবে। করুন স্বরে প্রার্থনা করে যে আমি দোষী না হলেও বলুন আমাকে কি করতে হবে। শেষ পর্যন্ত এক লক্ষ টাকা অ্যাকাউন্ট ট্রান্সফার করতে বাধ্য হয় অস্মিত।
পরের ঘটনাটাও একই রকম। অনলাইনে মাল কেনার পর, কুরিয়ারের ডিটেলস পাই প্রিয়াংকা। তারপরে একদিন হঠাৎ তার ফোনে আসে ফোন, জানানো হয় ওই কুরিয়ার কোম্পানি থেকে পার্সেল ডেলিভারি না হওয়ার জন্য ফোন করা হয়েছে । আপনার বাড়ি আমাদের ডেলিভারি ম্যান খুঁজে পাইনি তাই আপনি যদি পুনরায় ডেলিভারি চান তাহলে “এক” টিপুন। নিঃসন্দেহে এক টেপার পরে ফোনে আসে ওটিপি, পরিষ্কার ওই কুরিয়ার কোম্পানি থেকে আসা ওটিপি নিশংসয়ে শেয়ার করার পর প্রিয়াঙ্কাকে জানানো হয় বোম্বে ডক ইয়ার্ডে একটি সরকারি সংস্থা তার কুরিয়ার আটক করেছে কুরিয়ারের মধ্যে ড্রাগস ছিল। মানসিক ভাবে চাপ দেয়া শুরু হয় শেষ পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কা চাপের কাছে নতিস্বীকার করে সমঝোতা করে ২৫ হাজারে নিজের সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্য।
পরের ঘটনাটিও একই রকম ফেসবুকে হঠাৎ করে ভিডিও কল আসে রাকেশের। এক মহিলা ভিডিও কল করে কথা বলতে শুরু করার সাথে সাথে উলঙ্গ হয়ে যায় এবং বলে তার সাথে এই ভিডিও কলের ছবি ভাইরাল করে দেবে তার পরিচিত মহলে এবং স্ক্রিনশট পাঠাতে শুরু করে তার বন্ধুবান্ধবদের কাছে। ভিডিও তে চলে আসে সরকারি আধিকারিকদের ছবি রাকেশ কে জানানো হয় যে সে সেক্স রাকেট এর সাথে যুক্ত অবিলম্বে যদি না সে জরিমানা দেয় তাহলে তাকে অ্যারেস্ট করা হবে এবং বোম্বের কোর্টে প্রডিউস করা হবে। শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশ হাজার দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পায় রাকেশ।
কোভিড পরবর্তী পৃথিবীতে মানুষ দাস হয়ে গেছে মোবাইলের। সারাদিন প্রত্যেকে মোবাইলে বন্দী। কারো সময় কেটে যাচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা রিল দেখে, কারো অনলাইনে বিভিন্ন শপিং সাইট সার্ফ করে আবার কারো বিভিন্ন অনলাইন সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ দেখে। শৈশব ও কৈশোর ও বন্দী হয়ে গেছে মোবাইলে বিভিন্ন গেম এর চক্করে অথবা পর্নের বিভিন্ন সাইটে। এরই সাথে সাথে সক্রিয় হয়েছে জামতাড়া গ্যাং মতো দেশি বিদেশি স্ক্যামার রা। টেলিগ্রামে পয়সার হাতছানি, কখনো ক্রিপ্টো কারেন্সি কখনো বিভিন্ন বেটিং সাইট থেকে পয়সা রোজগারের হাতছানি, সহজেই সফট টার্গেট পেয়ে যাই এই ধরণের স্ক্যামাররা।
কিন্তু এই “ডিজিটাল অ্যারেস্ট” মোবাইলের দুনিয়ার নতুন বিপদ। এখানে আপনার ফোনে ভিডিও কলে আপনাকে আটকে রেখে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করবে স্ক্যামাররা যেখানে আপনি দেখতে পাবেন সরকারি আধিকারিকদের অফিস, সরকারি বিভিন্ন প্রতীক এবং সকলেই নির্দিষ্ট পোশাকে সুসজ্জিত। আপনি বুঝতেই পারবেন না যে এরা আসলে স্ক্যামার। আমাদের প্রাচীন প্রবাদ “বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা”। আমরা খুব সহজেই তাই এই আইনি ঝামেলার থেকে বাঁচতে যেকোনো সহজ পথ এবং অনেক সময় ঘুর পথে সমঝোতাতেও রাজি হয়ে যায়। স্ক্যামাররা আমাদের এই স্বভাবত প্রবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে “ডিজিটাল অ্যারেস্ট” কে এই ২০২৪ ও ২৫ সবচেয়ে বড় বিপদ হিসেবে সারা পৃথিবীর সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশের কাছে পরিণত করেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে পূজার দিনগুলিতে মানুষকে সাবধান করতে হয়েছে এবং সচেতন করতে হয়েছে এই “ডিজিটাল অ্যারেস্ট” সম্পর্কে এবং আবেদন করতে হয়েছে এতে পা না দেওয়ার।
প্রধানমন্ত্রী বার্তা দেওয়ার পর তার “মন কি বাত” অনুষ্ঠানে, দেশজুড়ে এই স্ক্যামারদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ শুরু হয়েছে। লাওস, কম্বোডিয়া, মায়ানমার প্রভৃতি দেশ থেকে এই স্ক্যাম চালাচ্ছে বলে জানাচ্ছে সাইবার পুলিশ। তাদের বিভিন্ন ডকুমেন্ট জাল করে ডিজিটাল অ্যারেস্ট মেমো জারি করছে স্ক্যামাররা। এখন পর্যন্ত ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম রেকর্ড থেকে পাওয়া গেছে ২০২৪ এ শুধুমাত্র প্রায় একশ কুড়ি কোটি টাকা ফ্রড হওয়ার খবর আনুষ্ঠানিকভাবে জমা পড়েছে এই “ডিজিটাল অ্যারেস্ট” এর মাধ্যমে। একটি সারা দেশের সাইবার সেল ও ১৯৩০ নির্দিষ্ট নাম্বার এই প্রতারণা রোধের জন্য গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও বেড়ে চলেছে এই ঘটনা।
তাহলে উপায়। আমাদের ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী “ডিজিটাল অ্যারেস্ট” বলে কোন শব্দবন্ধ আমাদের ভারতীয় আইনে নেই। তাই আপনার কাছে ফোন এলে আপনি নিশ্চিত থাকুন এটা সম্ভব নয়। এরপরেও আপনার ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে আপনাকে ওরা ভীত করলেও, আপনাকে চিন্তা করতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনভাবেই ওই চাপের কাছে এবং উনাদের লোক দেখানো সেটআপের সামনে মাথা না নোওয়ানোর। শুধুমাত্র ব্যাপক সচেতনতা সমস্ত মোবাইল গ্রাহকদের মধ্যে গড়ে তুলতে পারলেই আমরা এই “ডিজিটাল অ্যারেস্ট” নামক স্ক্যামারদের কে বেকার করে দিতে পারব। দিনের শেষে আমাদের মনে রাখতে হবে সবচেয়ে বড় সত্যটা: ফোনে বা ভিডিও কলে আমাকে কেউ অ্যারেস্ট করতে পারবে না ভারতের সংবিধান কাউকে সেই অধিকার দেয়নি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct