প্রশ্ন করা এবং তার উত্তরের মধ্যে একক কোনো শব্দের সীমাবদ্ধতা গণতান্ত্রিক এবং মুক্ত সমাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আজকের বিশ্বে প্রশ্ন করার সাহসিকতা এবং তার গভীরে যাওয়ার প্রবণতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে জনগণের সচেতনতা এবং যুক্তিবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরল ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে যে কোনো প্রশ্নের উত্তর প্রদান আসলে মূল বিষয়টির গভীরে প্রবেশ না করা এবং অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার বলেছেন, “যেখানে চিন্তাশক্তি সীমাবদ্ধ, সেখানে কর্তৃত্ব চালাতে সহজ হয়,” অর্থাৎ সরল উত্তরকে কার্যকরী করে শাসকগোষ্ঠী সমাজের উপর তাদের ক্ষমতা আরো মজবুত করে তোলার সুযোগ পায়। লিখেছেন পাশরুল আলম...
প্রশ্ন করা এবং তার উত্তরের মধ্যে একক কোনো শব্দের সীমাবদ্ধতা গণতান্ত্রিক এবং মুক্ত সমাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আজকের বিশ্বে প্রশ্ন করার সাহসিকতা এবং তার গভীরে যাওয়ার প্রবণতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে জনগণের সচেতনতা এবং যুক্তিবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরল ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে যে কোনো প্রশ্নের উত্তর প্রদান আসলে মূল বিষয়টির গভীরে প্রবেশ না করা এবং অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার বলেছেন, “যেখানে চিন্তাশক্তি সীমাবদ্ধ, সেখানে কর্তৃত্ব চালাতে সহজ হয়,” অর্থাৎ সরল উত্তরকে কার্যকরী করে শাসকগোষ্ঠী সমাজের উপর তাদের ক্ষমতা আরো মজবুত করে তোলার সুযোগ পায়।
সরল উত্তর এবং তার সামাজিক বিপদ আমাদের সমাজে বেশ কিছুদিন যাবৎ সক্রিয় হয়েছে। এক্ষেত্রে মানুষ সহজে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে এবং সরল ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ তে সাড়া দেয়। উদাহরণস্বরূপ, কালো টাকা বের করার মতো ইস্যুতে সরল ‘হ্যাঁ’ দিয়ে সমর্থন জানানোর পর নোটবন্দীর মতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যার ফলে দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। এই ক্ষেত্রে যদি সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলত যে, “কীভাবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হবে এবং এর আর্থিক প্রভাব কি হতে পারে?” তাহলে হয়তো জনগণ এতো সহজে এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিত না এবং এর ফলে দেশের অর্থনীতি সুরক্ষিত থাকত।
সেই সময় কেউ প্রশ্ন তুললো না যে, “কিভাবে কালো টাকা ধরা হবে? এই প্রক্রিয়ার ফলে আমার ব্যক্তিগত ক্ষতি কি হতে পারে?” কালো টাকা কাগজের নোটে আছে নাকি সম্পত্তি হিসাবে রূপান্তর করে রেখেছে ? নোটবন্দী হলে কিভাবে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ হবে? এই বিষয়গুলি কেউ জানতে চাইল না। এক্ষেত্রে যদি মানুষ সরাসরি ‘হ্যাঁ’ না বলে, বরং বিষয়টি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করত, তাহলে হয়ত তারা বুঝতে পারত যে, এই পদক্ষেপের মধ্যে গোপন স্বার্থ রয়েছে যা শুধুমাত্র একশ্রেণির মানুষের উপকারে আসবে।
একইভাবে ভারতের প্রেক্ষাপটে ঘুষপেটি ইস্যুতে প্রশ্ন তুলে সহজভাবে ‘হ্যাঁ’ উত্তর চাওয়া হয়েছে, ( ঘুষপেটিকো দেশ সে নিকালে চাহিয়ে কি নাহি?) যা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন তোলার সময় যদি বিষয়টিকে বিশদভাবে বিবেচনা করা হতো, যেমন—কাদের ঘুষপেটি হিসেবে সনাক্ত করা হবে এবং কীভাবে তাদের চিহ্নিত করা হবে, তাহলে হয়তো সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভীতি ও অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হতো না। আসামের মতো রাজ্যে এ নিয়ে বড় বিভাজন তৈরি হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী এমিল দ্যুরখেইম বলেন, “সমাজে সংহতি তখনই রক্ষা হয় যখন প্রতিটি ব্যক্তির অধিকার এবং দায়িত্ব পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত থাকে।”
যেহেতু সংখ্যালঘুদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এই কথা বলা হয়েছিল। তাই পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরনার্থীদের মধ্যে উত্তেজনার পারদ জমতে শুরু করল। শুধুমাত্র সংখ্যালঘুরাই কি এর শিকার হবে? তারা একবারের জন্য ভেবে দেখলো না, আমরাও তো ঘুষপেটি। যে জাল দিয়ে ঘুষপেটি ধরবে সেই জালে আমরা কি ধরা খাব না। এই প্রশ্নগুলো মানুষ জিজ্ঞাসা করতে ভুলে যায়। আর এই ভুলের ফলশ্রুতিতে, নির্দোষ মানুষজন অযথা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হয়। তার উজ্জ্বল উদাহরন আসাম।
মুসলিম নারীদের ন্যায়ের জন্য তিন তালাক বন্ধে আইন প্রণয়ন করা হল। কিন্তু কেউ প্রশ্ন তুললো না, শুধুমাত্র মুসলিম নারীদের জন্য কেন? কেন অন্যান্য ধর্মের নারীদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়?” এই প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে আমাদের সমাজ। যদি সেই প্রশ্নের সাথে উল্টে প্রশ্ন করা হত, মুসলিমদের মধ্যে শতকরা কত জন তালাক দেয় ? অমুসলিমদের মধ্যে স্বামী পরিত্যক্তা কত জন নারী আছে? তাদের বেলায় কি বিধান? ন্যায় করলে সবার জন্য হওয়া দরকার কিন্তু এক কথায় বলা হলো তিন তালাক তুলে দেওয়া উচিত কিনা ‘হ্যাঁ’ আর ‘ না’ শব্দ বন্ধের মধ্যে উত্তর দিন। এ রকম ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ উত্তর চেয়ে বৃহৎ নারী সমাজকে বাদ দেওয়া হল। এই ‘হ্যাঁ’ ‘না’ বলার পূর্বে একবারের জন্য নিজের পাড়া-প্রতিবেশীদের দিকে লক্ষ্য করল না যে, আমাদের সমাজে, আমাদের গ্রামে, আমাদের পাড়ায়, আমাদের শহরে কতজন অমুসলিম স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা রয়েছে? এই সামাজিক চিত্র পরখ করে যদি প্রশ্ন করা হতো আমাদের সমাজেও তো স্বামী পরিত্যক্তারা রয়েছেন তাদের বেলায় কোন আইন নেই কেন?
সিভিল কোড চালু করা উচিত কিনা এই প্রশ্নের উত্তর চাওয়া হয় ‘ হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ এর মধ্য দিয়ে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের জন্য একই আইন হওয়ায় বাঞ্চনীয়। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরে যদি বলা হয়, কে কোন নিয়মে বিয়ে করবে, তার সমাজ কাকে কিভাবে সম্পত্তির অংশ দিবে, সেটা তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত হওয়া দরকার। এই কমন সিভিল কোড লাগু হলে আমার সমাজে প্রচলিত নিয়ম রীতির কোন পরিবর্তন হবে কিনা? সিভিল আর ক্রিমিনাল আইনের মধ্যে তফাৎ কি? দেশে ক্রিমিনাল আইন তো সবার জন্য এক। তাহলে সিভিল কোড কি ? কেউ ভাবে না, অন্যের ঘরে পাথর ছুটতে গিয়ে আমার ঘরে এসে সেই পাথর পড়বে কিনা? এ বিষয়ে ভাববার বিন্দুমাত্র অবকাশ না দিয়ে, শুধু ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ এর মধ্যে উত্তর চাওয়া হল। সাধারণ মানুষ এত কিছু না ভেবে নেতার ভাষণরত মুখের দিকে তাকিয়ে হাহা বলে চিৎকার করলো?
কমন সিভিল কোড ইস্যুতে সহজ উত্তরে মানুষ সম্মতি দিচ্ছে, কিন্তু বিষয়টির সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়ে তেমন আলোচনা হচ্ছে না। বরং, কমন সিভিল কোড কার্যকর হলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সামাজিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বিপুল পরিবর্তন হবে। তা বিচার বিবেচনা না করে সম্মতি দেওয়া মানে সমস্ত জনজাতি ও সম্প্রদায়ের চিরায়ত প্রথা গুলিকে বিলীন করার যে অপচেষ্টা শুরু হবে, তাতে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে।
এই ধরনের বহু উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে শাসকগোষ্ঠীর প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়ার ফলে জনগণ বিপদে পড়েছে। ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার প্রশ্নটি তার একটি বড় উদাহরণ। যদি সেই সময়ে মানুষ প্রশ্ন তুলত, “এই ধারা তুলে দিলে এর প্রভাব কি হবে? সেখানে বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রা কেমন হবে?” তাহলে হয়ত বিষয়টি এত সরলভাবে মেনে নেওয়া হত না। এতে আমাদের কি লাভ বা ক্ষতি। ৩৭০ এবং ৩৭১ ধরার মধ্যে তফাৎ কি ? এটা কি শুধু জম্মু কাশ্মীরে সীমাবদ্ধ নাকি এই ধরনের ৩৫ক ধরার মত আরোও কেউ সুযোগ পেয়ে থাকে। তাদের বেলায় কি হবে? এই প্রশ্ন করলেই অনেক কথা বের হত। ৩৭০ ধরা তুলে দিয়ে ভারত জয় করার স্বপ্নে বিভোর হলো। অদ্ভুত এক কথা, কাশ্মীর চিরকাল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই তো আছে। তাহলে কি ৩৫ক ধারা তুলে দেওয়ায় সেখানকার জমি জায়গা গরিব ভারতীয়দের মধ্যে বিল বন্টন করা হবে, নাকি পুঁজিপতিদের সেখানে জমি দেওয়া হবে? ৩৭০ তুলে দেওয়ার পর আপামর ভারতবাসীর কি লাভ হবে ? এই প্রশ্ন করা হয়নি !
আজকাল বলা হয় এক দেশ, এক ভোট নীতি কার্যকরী করা উচিত কিনা ? কেউ জানতে চায়না এটা কি করে সম্ভব? এই নীতি কার্যকরী করতে গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী নীতি মানা হবে নাকি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নীতি মানা হবে? বিভিন্ন দলও এই রকম বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ‘হোনা চাহিয়ে কিয়া নাহি ‘?
প্রশ্নের সরল উত্তরের প্রবণতা শাসকদের ক্ষমতা বাড়ানোর একটি কৌশল হিসেবে কাজ করে। তাই অধিকার রক্ষায় উত্তরে প্রশ্নের প্রয়োজন। একজন মানুষের প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা তাকে সচেতন এবং অধিকার সচেতন নাগরিকে পরিণত করে। অনেক সময় প্রশ্নের পরিবর্তে প্রশ্ন করলেই সঠিক উত্তর বেরিয়ে আসে। এ বিষয়ে বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি বলেন, “প্রশ্ন তোলাই হলো একমাত্র উপায় যার মাধ্যমে আমরা শাসকদের কাছ থেকে প্রকৃত তথ্য বের করতে পারি।” তাই একটি সমাজে প্রশ্নের বিকল্প নেই, বরং এটি সমাজের প্রতিটি মানুষকে আরও শক্তিশালী ও অধিকার সচেতন করে তোলে।
গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিদের উচিত সরকারের কাছে সরল উত্তরের বদলে বিস্তারিত বিশ্লেষণ চাওয়া। পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিকের উচিত প্রতিটি প্রশ্নকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করা এবং উত্তর দেওয়ার আগে তার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব পর্যালোচনা করা। এর ফলে শাসকগোষ্ঠীও তাদের সিদ্ধান্তে আরও দায়িত্বশীল হবে এবং একটি সুশৃঙ্খল, সচেতন সমাজ গড়ে উঠবে।
*** মতামত লেখকের নিজস্ব
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct