ভোটের আগে ভোটারের মনে ছিল ভূতের ভয়। শেষ পর্যন্ত ভূত তাড়িয়ে অবশ্য নিজের ভোট নিজেই দিয়েছেন। কিন্তু এ বার সর্ষের মধ্যেই ভূত দেখা শুরু হয়েছে শাসক শিবিরে!
হলদিয়ায় নিজেদের শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মীরা নিজের দলকেই ভোট দিয়েছেন কি না, রীতিমতো লিখিত ফরমান পাঠিয়ে তা যাচাই করতে নেমেছে তৃণমূল! তাঁরা যে বুথে গিয়ে দলীয় প্রতীকেই বোতাম টিপে এসেছেন, বুথ স্তরের নেতৃত্বের কাছ থেকে সেই ব্যাপারে সিলমোহর আদায় করে আনতে বলা হয়েছে কর্মীদের। এই সংক্রান্ত চিঠি-চাপাটি জমা দিয়ে দিতে হবে ফলপ্রকাশের আগেই। ফরমানে বলা নেই, কিন্তু অনুচ্চারিত যে বার্তা শ্রমিকেরা পড়ে নিতে পারছেন, সেটা হল— শাসক দলের বাক্সেই ভোট পড়েছে বলে নেতারা নিশ্চিত না-হলে আগামী দিনে ঠিকা শ্রমিকের কাজ পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে!
ভোটের বাক্সে অন্তর্ঘাতের নালিশ সব দলেই কোথাও না কোথাও, কখনও না কখনও ওঠে। কিন্তু ফল বেরোনোর আগেই নিজেদের ইউনিয়নের কর্মীরা দলকে ভোট দিয়েছেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে এমন ফরমান জারির নজির রাজ্য রাজনীতিতে বিশেষ নেই! এ বারের ভোটে শাসক শিবিরের আতঙ্কই এমন পদক্ষেপের মধ্যে স্পষ্ট বলে মনে করছে বিরোধীরা। সিপিএমের এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘ঘটনাটা হয়তো হলদিয়ায় ঘটেছে। কিন্তু রাজ্যে বহু জায়গাতেই এ বার ‘সাইলেন্ট ভোটিং’ হয়েছে। শাসকের ঘরের ভোট কোন দিকে গিয়েছে, ওরাও জানে না! সর্বত্রই সন্দেহ আর অবিশ্বাস!’’ তৃণমূল সূত্রও বলছে, দক্ষিণ বঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায়, এমনকী খাস কলকাতার বহু কেন্দ্রে ‘নিঃশব্দ ভোট’ দলের অন্দরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
কী ঘটেছে হলদিয়ায়? সেখানে ‘হলদিয়া রিফাইনারি টাউনশিপ মেনটেনেন্স কন্ট্র্যাক্টর্স ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’-এর তরফে জারি করা এক নির্দেশে লেখা রয়েছে, ‘‘গত ০৫.০৫.২০১৬... বিধানসভা নির্বাচনে... আপনারা আমাদের সংগঠনের সহিত কি ভাবে যুক্ত ছিলেন বা আপনাদের কতখানি দায়বদ্ধতা ছিল, তাহা আমাদের সংগঠন সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারায় আগামী দিনের মূল্যায়ন করা যাচ্ছে না। অতএব... আপনার এলাকায় বুথের যে সকল নেতৃত্ব আছেন, তাহাদের নিকট হইতে শীল সহ চিঠি আনিতে হইবে...।’’ আগামী ১২ তারিখের মধ্যে এই চিঠি জমা দিতে শ্রমিকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশিকার নীচে সই করেছেন ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দীপেন্দু বেরা।
এ বারের শেষ দফার ভোট ছিল পূর্ব মেদিনীপুরেই। কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া নজরদারিতে শান্তিতে মিটেছে ভোট। আর সেই ভোট মেটার পরের দিনই জারি করা হয়েছে এই নির্দেশনামা। আইওসি হলদিয়া রিফাইনারির আবাসন রয়েছে হলদিয়া টাউনশিপে। সেখানেই হলদিয়া রিফাইনারি টাউনশিপ মেনটেনেন্স কন্ট্র্যাক্টর্স ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের কর্মীরা ঠিকা শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন। তৃণমূলের ওই শ্রমিক সংগঠনে প্রায় তিনশো কর্মী রয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রের খবর, ঠিকা শ্রমিক হিসাবে যাঁরা ওখানে কাজ করেন, তাঁরা আসেন মূলত খেজুরি, নন্দীগ্রাম, মহিষাদল, নন্দকুমার থেকে। জোট-শিবিরের হিসাবে, এ বার মহিষাদল বা নন্দকুমারে ভোট ভাল হয়েছে। আবার নন্দীগ্রামে সব বুথে বিরোধীদের এজেন্ট বসতে না পারলেও মানুষ নিজের ভোট নিজে দিয়েছেন। পরিস্থিতির ফেরে শাসক দলের নেতারা বুঝে উঠতে পারছেন না, নিজেদের এলাকায় গিয়ে ইউনিয়নভুক্ত ঠিকা শ্রমিকেরা ঠিক কাকে ভোট দিয়েছেন! তার জন্যই প্রায় মুচলেকা তলব করতে হচ্ছে! বুথ স্তরের নেতাদের শংসাপত্র জোগাড় করে আনতে বলা হচ্ছে। হলদিয়ায় ছোট-মাঝারি কারখানার সংখ্যা অজস্র। এখনও পর্যন্ত একটি জায়গা থেকেই এমন নির্দেশিকার খবর এসেছে ঠিকই, কিন্তু ভোটের আগে সব কারখানার ইউনিটেই শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন, ভোটের দিন শ্রমিকদের ভূমিকার উপরে সব রকম নজরদারি থাকবে!
যদিও প্রশ্ন হল, বুথে গিয়ে কে কোন চিহ্নে ভোট দিয়ে এসেছেন, তার প্রমাণ আদায় কী ভাবে সম্ভব? সংশ্লিষ্ট বুথের নেতা কারও হয়ে শংসাপত্র লিখে দিলেই কি প্রমাণ হয় যে, ওই ব্যক্তি তৃণমূলকেই ভোট দিয়ে এসেছেন? শাসক দলের একাংশই বলছে, আতঙ্কের জেরে এমন আজব পদক্ষেপ করলেও তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
নোটিস জারির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি তথা হলদিয়া পুরসভার চেয়ারম্যান দেবপ্রসাদ মণ্ডল। তাঁর কথায়, ‘‘কর্মীদের আগামী দিনের কাজের মূল্যায়নের জন্যই আমরা এই ব্যবস্থা নিয়েছি। এতে অন্যায় কী আছে?’’ হলদিয়া রিফাইনারি টাউনশিপ মেনটেনেন্স কন্ট্র্যাক্টর্স ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দীপেন্দুবাবুরও বক্তব্য, ‘‘এর মধ্যে কোনও অন্যায় দেখছি না! ভোটের সময়ে আমাদের কর্মীরা কে কী ভাবে কাজ করেছেন, তার পর্যালোচনা আমরা করতেই পারি।’’
ভোটের আগে আইওসি-র কারখানার সামনে প্রচারে গিয়ে তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারী পরিষ্কার বলে এসেছিলেন, ‘‘কারখানায় আইএনটিটিইউসি করবেন আর গ্রামে গিয়ে সিপিএম করবেন, এই দ্বিচারিতা করবেন না! যা করার এক রকম করুন। এটা আমার নির্দেশ নয়, যৌক্তিকতা থেকে বলছি।’’ সেই যুক্তি থেকেই কি তা হলে ভোটের পরে দলের কর্মী সংগঠনের রাজনৈতিক আনুগত্য মেপে নিতে চাইছেন তৃণমূল নেতারা? প্রকারান্তরে তা মেনেই নিয়েছেন দেবপ্রসাদবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘কিছুটা তো বটেই। এর ভিত্তিতেই তো পরে পর্যালোচনা করা হবে।’’
তবে সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য অচিন্ত্য শাসমলের অভিযোগ, ‘‘কোনও গণতান্ত্রিক দেশে এমন নির্দেশ জারি হতে পারে কি? আসলে এর মাধ্যমে ভয় দেখানো হচ্ছে কারখানার কর্মীদের।’’ একই অশনি সঙ্কেত দেখছেন কারখানার কর্মীদের একাংশও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মীর কথায়, ‘‘আইওসি-র আবাসন রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগে তো আইএনটিটিইউসি ছাড়া আর কিছু নেই। তাই যদি কেউ অন্য কাউকে সমর্থন করেও থাকে, তা হলে তার কাজ হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। সেটাই ভয়ের।’’ যদিও আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দীপেন্দুবাবুর দাবি, ‘‘শুভেন্দু অধিকারী কারও কাজ কাড়ে না, কাজ দেয়! তাই এমন ভয় অমূলক।’’