এম ওয়াহেদুর রহমান, আপনজন: ভারতসহ সমগ্ৰ বিশ্ব মাঝে আজ শিশুশ্রম একটি অমানবিক সামাজিক সমস্যা। এই সমস্যার নিরসনে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্ৰহন করলে ও তা আজ ও সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়নি বরং ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেয়েছে। যে- কোন ধরনের শোষণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপন্থী। কেননা গণতন্ত্র এবং শোষণ পরস্পর - বিরোধী। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনরকম শোষণ থাকতে পারে না।ভারত বিশ্বের একটি অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ। ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিতকে আরও মজবুত করে তোলার জন্য তথা সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বার্থে ভারতীয় সংবিধানের ২৩ এবং ২৪ ধারায় শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার একটি মূল্যবান অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই অধিকারটি তাৎপর্যপূর্ণ একটি মৌলিক অধিকার। বস্তুতপক্ষে সকল রকম শোষণের হাত থেকে মুক্তি না পেলে কখনই প্রকৃত স্বাধীন নাগরিক গড়ে উঠা সম্ভব নয়। সুদীর্ঘকাল যাবৎ ঔপনিবেশিক শোষণে নিষ্পেষিত ভারতে স্বাধীনতার পর সংবিধানে শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার লিপিবদ্ধ হলেও আজকের দিনে বেগার শ্রম সর্বোপরি অভিশপ্ত শিশুশ্রম বহাল তবিয়তে রয়েছে। হাজার হাজার শিশুশ্রম বিপজ্জনক কাজে নিয়োজিত রয়েছে। অল্প মজুরি দিয়ে স্বার্থান্ধ কিছু মালিক গোষ্ঠী তাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনাশ করে চলেছে। একুশ শতাব্দীর এই উন্নত প্রযুক্তির সভ্যতায় ভারতে নারী পাচার আজ শুধু একটি সামাজিক সমস্যা নয়,এ হল এক জ্বলন্ত অভিশাপ। তাই কি সংবিধান - বিশেজ্ঞ কে ভি রাও বলেছেন, ‘ শোষণের বিরুদ্ধে অধিকারের কথা ঘোষিত হলেও বাস্তবে ভারতীয় সংবিধানে এই অধিকার স্বীকৃত হয়নি।’
আজকের শিশু আগামী দিনে জাতির ভবিষ্যৎ তথা কর্ণধার। আগামী দিনে দেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে আজকের শিশুরাই। শিশুদের দক্ষ নাগরিক ও যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের। কিন্তু আমরা সেই দিকে লক্ষ্য করিনা বরং তাদেরকে অর্থ উপার্জনের পথে নামিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করি না। ফলে তারা শিশুশ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। এই শিশুশ্রম মূলত মানবতাবিরোধী কাজ। অভাবের তাড়নায় বাবা - মায়েরা শিশুদের কাজে পাঠিয়ে যদিও সামান্য সুফল ভোগ করে, তবে আসলে তার কুফল অত্যন্ত ভয়াবহ। অভাবের তাড়নায় বাবা - মা সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে, পাঠিয়ে দিচ্ছে কর্মক্ষেত্রে। অপরিণত শিশুরা কঠিন পরিশ্রমে নিয়োজিত হচ্ছে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করছে। হাজার হাজার শিশু শ্রম দিচ্ছে কলকারখানায়, গ্যারেজে , রিকশা - টোটোর ওয়ার্কশপে। ফুল বিক্রেতা,কুলি, হকার, বাসের হেলপার,ইটভঙা, ময়লা পরিষ্কার, পলিথিন ও বোতল সংগ্ৰহ ,মাদক বাহক , হোটেল শ্রমিক,বুনন কর্মী , পোশাক শ্রমিক প্রভৃতি কর্মে নিয়োজিত অপরিণত বয়সের শিশুরা।
ভারতীয় সংবিধানের ২৩(১) ধারানুযায়ী মানুষ ক্রয়বিক্রয় ,বিনা মজুরিতে বেগার কাঠানো এবং বলপূর্বক শ্রমদানে বাধ্য করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এখানে মানুষ ক্রয়বিক্রয় বলতে দাসপ্রথা এবং নারী ও শিশু ক্রয়বিক্রয় নিষেধের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ২৪ ধারায় ১৪ বছরের কম বয়সের শিশুদের খনি , কারখানা বা অন্য কোন বিপজ্জনক কাজে নিয়োগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাছাড়াও এই অধিকারকে বাস্তবায়িত করার জন্য পার্লামেন্ট ‘ Factories Act 1948 ‘, ‘ The Mines Act,1952’, ‘ Banded Labour System Abolition Act ,1976,Equal Remuneration Act ,1976,’ The Child Labour ( Prohibition and Regulation ) Bill ,1986 ‘ এবং ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর ভারত সরকারের শ্রমমন্ত্রক শিশুশ্রম নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ আইনের একটি আদেশ জারি করেছেন, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ‘ Child Labour Prohibition and Regulation Act ‘পাশ হয়েছে। তবু ও তা বাস্তবে সম্পূর্ণরূপে ফলপ্রসূ হয়নি। সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও শিশু শ্রমিকদের শোষণ ভারতে এখন ও চলে আসছে। বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ, কলকারখানা প্রভৃতি ক্ষেত্রে শিশু শ্রমিক বিদ্যমান। আজ ও শ্রমিক শ্রেণিকে মালিক শ্রেণির হাতে নির্দয়ভাবে শোষিত হতে হয়। বেগার শ্রম বন্ধ করার নামে নামমাত্র মজুরি দেওয়া হয়। আজ ও নারী ও শিশু পাচার কিংবা কেনাবেচা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
অনেকেই দারিদ্র্যের কারণে শিশুসন্তানকে কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক আবার পারিবারিক ঋণের দায়ে শিশু সন্তানকে কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। কখনো বা পিতৃ বিয়োগ কিংবা মাতৃ বিয়োগ অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ও শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শিশুশ্রম শিশুদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করেছ। একইসঙ্গে শিশুরা শিক্ষার অধিকার থেকে ও বঞ্চিত হচ্ছে। শিশুশ্রমের ফলে শ্বাসকষ্ট, মানসিক অবসাদ, রক্তাল্পতা, অপুষ্টি, পিঠের শিরদাঁড়ায় ব্যাথা প্রভৃতি রোগের প্রকোপের কবলে পড়তে হচ্ছে শিশুদের। অথচ এই বয়সে তাদের হাতে বই,কলম থাকার কথা। কিন্তু সেই বয়সেই তারা তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে কঠোর শ্রমের হাতিয়ার। নিজের কিংবা পরিবারের দু’মুঠো অন্ন জোগাতে তারা আজ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। আবার অনেকে বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও অর্থাভাবে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে না, মাঝপথে থেমে যায় তাদের পড়াশোনা। শিশুশ্রম একটি সমস্যা, যা দারিদ্র্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে দারিদ্র্যের দুষ্ট শৃঙ্খল তৈরী করে।
শিশুশ্রম যতই বৃদ্ধি পাবে, হয়তো দেশ ও জাতি ততই অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে পারে। শিশুশ্রম বন্ধের জন্য কেবল আইন প্রনয়ণ করলেই হবে না বরং এ ব্যাপারে সকলকে সচেতন হতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধের জন্য শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে সর্বোপরি দারিদ্র্য বিমোচনে উদ্যোগ নিতে হবে।এ সমস্যার নিরসনে আমাদের সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবে শুধুমাত্র এক্ষেত্রে আইন প্রনয়ণই যথেষ্ট নয়। সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা, নাগরিক সচেতনতা ও সকলের সার্বিক প্রচেষ্টা ছাড়া এই অধিকারটিকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct