জহির-উল-ইসলাম, লালগোলা, আপনজন: গত দুই মাস ধরে চলতে থাকা লালগোলার তারানগরে পদ্মা নদী-ভাঙ্গন এখনও অব্যাহত আছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে গৃহহারা পরিবারের সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। সর্বশেষ অঘটন হল, এই গ্রামের সঙ্গে লালগোলা ও রঘুনাথগঞ্জ ব্লকের আশেপাশের গ্রামগুলোর সঙ্গে সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটি বুধবার দুপুর নাগাদ নদীর গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে। যার কারণে বহির্জগতের সঙ্গে এই বিপর্যস্ত গ্রামের মানুষদের সহজ পথে যোগাযোগ অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হল। ভাঙ্গন দুর্গত পরিবারগুলির দুর্ভোগ আরও বেড়ে গেল। এতদিন প্রধানত এই রাস্তাটিকে গ্রামবাসীদের অনেকেই তাদের গৃহসামগ্রী নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য ব্যবহার করে আসছিল। এই রাস্তার পাশেই রয়েছে বিগত শতকের গোড়ার দিকে তৎকালীন ব্রিটিশ পুলিশ সার্ভিসের লালগোলা থানার পুলিশ প্রধান গ্রামের ভূমিপুত্র আইয়ুব হোসেন বেগ ও তাঁর সহধর্মিনী ক্ষতিমুন্নেসার কবর। আর একটিমাত্র চাপের মুখে দাঁড়িয়ে এই কবরস্তান। যে কোন মুহূর্তে তা পদ্মা গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে বলে গ্রামবাসীদের আশংকা।
উল্লেখ্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নূরজাহান মুর্শিদ আইউব হোসেনের চতুর্থ কন্যা। তিনি ১৯২৪ সালের ২২ মে এই মাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। সেকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে প্রথম মুসলিম মহিলা ঘোষিকা হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৬-৪৭ সালের ভয়াবহ দাঙ্গার সময় তিনি কলকাতার মন্নুজান হোস্টেলের সুপরিনটেনডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। দেশভাগের পর ঢাকা বেতারে যোগ দেন। একসময় ঢাকা ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল ও হলি ক্রস কলেজে শিক্ষকতা করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ভারতীয় লোকসভার যৌথ অধিবেশনে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে তিনি শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের স্বাস্থ্য ও সমাজ কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
চলমান সংকটে ইতিমধ্যে তারানগর ও তার পার্শ্ববর্তী রাধাকৃষ্ণপুর, দুর্লভপুর, রানীনগর, আটরশিয়া গ্রামসংলগ্ন শত শত বিঘা বহুফসলি উর্বর আবাদযোগ্য জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গত ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যার প্রাক মুহর্তে সংঘটিত স্মরণকালের ভয়াবহ ভাঙ্গন ডিআইবি-র সিভিক ভলান্টিয়ার অসিকুল ইসলামের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এন.ডি.আর.এফ.-এর কর্মীবাহিনী দু’দিন তল্লাশি চালিয়েও তার নিথর দেহ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। এদিকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’-র প্রভাবে বুধবার সন্ধ্য থেকে শুরু হয়েছে ব্যাপক বৃষ্টিপাত। ফলে আশেপাশের তাঁবুতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গৃহহারা মানুষজন আর এক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষত পরিবারের নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও রুগ্নদের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বিষহ।
একদিক কোন উপার্জন নেই, রান্নার জায়গা নেই, ঘরে খাবার নেই। অন্যদিকে সরকারি উদাসীনতা। সবদিক দিয়ে তারানগরের বিপন্ন মানুষজন এই মুহূর্তে চরম অস্তিত্বের সংকটে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct